কাজল ভট্টাচার্য সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:
কেউ এতটাই অবাঞ্ছিত যে মাতৃজঠর থেকে বেরনোর সুযোগটুকুই পায় না। খুন হয়ে যায় সেই জঠরেই। ভ্রূণ অবস্থায়। অপরাধ? ভ্রূণটি কন্যাসন্তানের।
কন্যার পিতৃত্ব নেওয়ার মতো পুরুষ মেলে না।
আবার এমন শিশুকন্যাও জন্মায়, যার দাবিদার তিন, তিনজন বাবা।
ভাগ্যবতী শিশুকন্যা। লাখে এক!
শিশুকন্যা যখন মহিলা, বাদ দিতে হয় জরায়ু। না, কোনও রোগভোগের জন্য নয়। সেরেফ পেটের তাড়নায়।
এমনটাই নিয়তি।
মাত্র
কয়েকদিন আগের কথা। এক হাড়হিম করা খবর দেখা গেছিল। উত্তরাখন্ডের এক জেলা।
নাম, উত্তরকাশি। গত তিন মাসে, সেখানকার তিনশো বাইশটা গ্রামে একটাও
শিশুকন্যার জন্ম হয়নি। সন্দেহ, কোন মা বাবাই মেয়েসন্তান চায় না।
ঠিক
উল্টো ছবি দেখা গেল কলকাতায়। শনিবার দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি
নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিলেন এক তরুনী। তাঁর নবজাতিকার দাবিদার ছিলেন তিন,
তিনজন পুরুষ। তিনজনই আলাদা-আলাদা ভাবে দাবি জানিয়েছিলেন, কন্যাটি তাঁর।
গত
শনিবার সন্তানসম্ভবা তরুণীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে এসেছিলেন জনৈক পুরুষ।
তিনি তরুণীর স্বামীর পরিচয় দিয়ে হাসপাতালে টাকাও জমা করেন। পরদিন তরুণী এক
কন্যার জন্ম দেন। আর ঠিক তখনই এসে হাজির হন দ্বিতীয় পুরুষ। তিনিও নিজেকে ওই
তরুণীর স্বামী এবং নবজাতিকার বাবা বলে দাবি করেন। শিশুকন্যার পিতৃত্ব নিয়ে
হাতাহাতি বেঁধে যায় দুই পুরুষে।
ঘটনার মধ্যস্থতা
করতে ছুটে আসে পুলিশ। দুজনের কাছেই তাঁদের দাবির স্বপক্ষে প্রমাণ চাওয়া হয়।
সেই ঝামেলা মিটতে না মিটতেই, সোমবার হাসপাতালে উপস্থিত হন তৃতীয় পুরুষ।
তাঁর দাবি, ওই তরুণী তাঁর স্ত্রী। সুতরাং বাচ্চাটিও তাঁর। ঘটনা নিয়ে জলঘোলা
শুরু হতেই সুযোগ বুঝে গা ঢাকা দেয় তিন নাম্বার।
এদিকে
দ্বিতীয় পুরুষ বিয়ের আইনি কাগজপত্র নিয়ে চলে আসে। তরুণীও তাঁকে স্বামী আর
কন্যার বাবা বলে স্বীকার করে। প্রথম পুরুষ জানায়, সে তরুণীর বন্ধু।
স্বামীকে শিক্ষা দিতেই তরুণী ওই গল্প ফেঁদেছিল বলে জানানো হয়। স্ত্রী
কন্যাকে পেয়ে আবেগে ভেসে যান দ্বিতীয় পুরুষ।
ছোট্ট
কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রথমেই যে কাজটা করে ফেললো তা হলো, মা-বাবার মন
কষাকষি মিটিয়ে দেওয়া। মেয়ে কোলে সাঙ্গ, স্বামী- স্ত্রীর মান অভিমানের পালা।
ঘটনার, মধুরেণ সমাপয়েত!
ওদিকে
এক আধুনিক বর্বরতার ছবি সমানে আঁকা হয়ে চলেছে উত্তরাখন্ডে। মা আছে, বাবা
আছে, মেয়ে নেই। উত্তরকাশি জেলার তিনশো বাইশটি গ্রামে মেয়ে জন্মানো নিষেধ।
জন্মানোর আগেই কন্যাভ্রূণ খুন করা হচ্ছে বলে সন্দেহ। তাঁর এই আশঙ্কার কথা
সরাসরি জানিয়েছেন সমাজকর্মী কল্পনা ঠাকুর।
ঘটনার খবর
ছড়িয়ে পড়তেই, নড়েচড়ে বসেছে জেলা প্রশাসন। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আশিস চৌহান
জানিয়েছেন, গোটা ঘটনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত তিন মাসে একটিও মেয়ে না
জন্মালে কী হবে, পুত্রসন্তান কিন্তু জন্মেছে। তার সংখ্যাও খুব একটা
হেলাফেলার নয় মোটেই- দুশো ষোলো।
একদিকে
মোদি সরকারের বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও, অন্যদিকে গোড়ায় গলদ। জন্মের আগে
বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া, লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি হলেও কে শোনে কার কথা।
সমাজকর্মী কল্পনা ঠাকুরও স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভের কথা গোপন
করেননি।
আবার এরচেয়েও নৃশংস ঘটনা আকছার ঘটছে।
মহিলা
আছেন, মহিলার জরায়ু নেই। গর্ভধারণেই অক্ষম। শুধু দু'মুঠো অন্ন সংস্থানের
তাগিদ। চাপে পড়ে বন্ধ্যা হচ্ছেন মহিলারা। এই দলে সামিল হচ্ছেন নেহাত
তরুণীরাও।
মহারাষ্ট্রের এই নারকীয় খবর চাউর হতেই
হইহই। জরায়ুহীন এই মহিলারা সবাই খেটে খান। শ্রমিক শ্রেণি। আঁখ কাটার সময়
হলেই এরা গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়েন আড়কাঠিদের সঙ্গে। পৌঁছে যান অভিষ্টে।
কিন্তু অভিষ্টে পৌঁছনোর মূল্যও ধরে দিতে হয়। বাবুদের মর্জিমতো শরীর তুলে
দিতে হয় তাঁদের হাতে। যৌনকর্মের পরের পর্বটি নির্ঝঞ্ঝাট করতেই, জরায়ু বাদ
দেওয়ার শর্ত রাখা হয় মহিলাদের কাছে। পেটের ক্ষিদে মেটাতে বাদ যায় জরায়ু।
এমনকি বয়সে নেহাতই তরুণী, তাঁরাও জরায়ু বাদ দেন পেটের তাড়নায়।
অন্য
এক কারণও অবশ্য আছে। মাসিক ধর্মের সময় মহিলাদের কাজের গতি শ্লথ হয়ে যায়
বলে মত আড়কাঠিদের। জরায়ু না থাকলে এক ঢিলে দুই পাখি মরে। যৌনবিলাসের পরেও
নিশ্চিন্ত, আবার মহিলাদের কাজের গতিও মসৃণতর। নাগাড়ে ছ'মাস পুরোদমে কাজ
টানতে পারেন মহিলারা।
জরায়ু
বাদ দেওয়ার খরচও নেহাত মন্দ নয়। খরচ হয়ে যায় কমপক্ষে হাজার পঁয়ত্রিশ
টাকা। আড়কাঠি বা জোতদারের কাছে হাত পাতলেই মেলে টাকা। পরে তা শোধ দিতে হয়
নিজেদের রোজগার থেকে। মহাজনের ধার শোধ করতে গিয়ে দেনার দায়ে ডোবেন মহিলা
শ্রমিকরা।
এভাবেই চলছে
মহারাষ্ট্রের আঁখখেতের শ্রমিক মহিলাদের। ফি-বছর আড়কাঠিদের হাত ধরে
প্রত্যন্ত গ্রামের হাজারো মহিলা ছড়িয়ে পড়েন কোলাপুর, সোলাপুর, বিদের মতো
বহু জায়গায়, যেখানে ঢালাও আঁখের খেত। জরায়ুহীন ওই মহিলাদের হাতে কাটা
আঁখেই এত মিষ্টি করে তুলছে আমার আপনার রসনা। চলছে, চা কফির কাপে এক চামচ না
দু চামচ চিনি মেশানোর ফরমায়েশ। কিন্তু ওই মিষ্টির তলানিতে লুকিয়ে যে
কাহিনি, তা বড্ড তেতো।
স্থান
কাল পাত্র ভেদে কতই না ফারাক মেয়েদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে। কোথাও
তাদের জন্মানোয় নিষেধাজ্ঞা। কোথাও বা এক কন্যার পিতৃত্বের দাবিদার তিনজন।
আবার কোথাও মহিলাদের গর্ভধারণেই ফতোয়া।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours