fiture
অনুপ চক্রবর্তী, নাট্যকার, কলকাতা: একথা সর্বজনগ্রাহ্য যে, যে কোন মাধ্যমেরই কলাশিল্প হোক না কেন তাকে নান্দনিক অর্থাৎ সুন্দর হতে হবে। এবং কলাকৈবল্যবাদী যাঁরা নন তাঁরা মনে করেন যে শিল্পের দায়বদ্ধতা আছে মানুষের কাছে, কারণ মানুষের জন্যেই শিল্প,শুধু শিল্পের জন্যেই শিল্প নয়। এবং এ ভাবনা সর্বাংশে সঠিক। কারণ শিল্প সৃজনের অবসর মানুষ পায় সমাজের অর্থাৎ মানুষের আনুকূল্যেই। শিল্পীকে যদি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে উদয়াস্ত কঠিন পরিশ্রম করে যেতে হোত সে শিল্প সৃষ্টি করার অবসর পেত না। তাই সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা শিল্পী অস্বীকার করতে পারে না। সমাজ ও মানুষের মঙ্গল ও প্রয়োজনের ব্যাপারটা সে উপেক্ষা করতে পারে না। এই বিষয়টা তাই সরাসরি মানবিকতাবোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই মানবিক হওয়ার সঙ্গে শিল্পীর নিজস্ব দার্শনিক বিশ্বাসের বিরোধ নেই। রবীন্দ্রনাথ বা তলস্তয় ভাববাদী হলেও তাঁরা মূলত মানবতাবাদী হওয়ার জন্যে সমাজ বাস্তবতা এবং মানুষের কল্যাণ ও চাহিদাকে তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে বিধৃত করে মহান শিল্পের জন্ম দিয়েছেন। আর এই বাস্তবতার ব্যাপারটা আপেক্ষিক। শিল্পতো সত্যিই প্লেটোর তৃতীয় বাস্তব নয়। তা সৃজিত হয় রক্তমাংসের মানুষ, সামজিক কাঠামো ও তার উপরিসৌধ এবং প্রকৃতি নিয়ে। তবুও এই বাস্তবতাকে সঠিকভাবে নির্ণয় করা ও উপলব্ধি করা নির্ভর করে মানবিক ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণের ওপর। কীভাবে কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বা কোন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে আমরা এক বা একাধিক মানুষকে বা একটা ঘটনাকে দেখছি বা ব্যাখ্যা করছি তার ওপর। কোনটা বাস্তব? একথা অনস্বীকার্য যে কোন মানুষ বা কোন ঘটনাকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে তার ইতিহাস ও বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতির আলোয় তা করতে হবে। 
নাহলে বিশ্লেষণ হবে ত্রুটিপূর্ণ। কেননা সেক্ষেত্রে আমরা পাব খণ্ডিত বাস্তব। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গী এই বাস্তবতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করার ব্যাপারে এক মূল্যবান আয়ুধ। যদিও শেক্সপীয়ার,রবীন্দ্রনাথ,তলস্তয়, ভিক্টর হুগো প্রমুখের মতো মহান স্রষ্টারা তাঁদের যুক্তিবাদী গভীর অন্তর্দৃষ্টির কারণে তা অনায়াসেই করেছেন। যে কোন শিল্পমাধ্যমে তাই ত্রুটিপূর্ণ খণ্ডিত বাস্তবতাকে বিম্বিত করলে তা হবে অনান্দনিক। কেননা কোন কিছু নান্দনিক অর্থাৎ সুন্দর হতে হলে তার গঠনকারী নানা অংশের মধ্যে সুষম ঐক্যের প্রয়োজন। এই ঐক্য বিনষ্ট হলে তার সৌন্দর্যহানি হবে। তাই খণ্ডিত বাস্তব দিয়ে যথার্থ নান্দনিক শিল্প সৃজন হয় না। থিয়েটারে রিয়ালিজম,এক্সপ্রেশনিজম,ইমপ্রেশনিজম,সুররিয়ালিজম ইত্যাদি যে কোন আঙ্গিকেরই প্রয়োগ করা হোক না কেন, ফোটোগ্রাফিক রিয়ালিজম প্রয়োগ করলে তা কখনোই শিল্পসম্মত হতে পারে না। কারন ফোটোগ্রাফিক রিয়ালিজম কখনোই সঠিক বাস্তব নয়। তা বাস্তবের খণ্ডিত রূপ এবং তা বাহ্যিক বাস্তবের মধ্যে নিহিত ভেতরের বাস্তবতাকে ছুঁতে পারে না। তাই মঞ্চে ঐ ফোটোগ্রাফিক বাস্তবের যথেচ্ছ ও অনিয়ন্ত্রিত প্রদর্শন শ্লীল হতে পারেনা। কারণ তা অনান্দনিক। এবং তাই মঙ্গলজনক নয়। এর সঙ্গে থিয়েটার শিল্পীর সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপারটাতো আছেই। কারণ অন্যান্য শিল্পের মতোই থিয়েটার শিল্পও মানুষের জন্যেই। যে থিয়েটার মানুষ ও সমাজের মঙ্গল আনে না তা অনান্দনিক ও থিয়েটার শিল্পীর কাছে তাই বর্জনীয় হওয়া উচিত। থিয়েটার কী ও কেন ও কীভাবে তা নির্মাণ করা যায় তা হাজার হাজার বছর ধরে মানুষকে ভাবিয়েছে। দেশ ও কাল ভেদে এবং আর্থসামাজিক ব্যবস্থা ও মানুষের ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত চাহিদা ও রুচির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা বদলে গেছে, বদলে চলেছে ও বদলে যাবেও, যদিও কখনো কখনো সমাজ কাঠামোর অনড়ত্বের কারণে বহুকাল ধরে তা অনড়ও থেকেছে। তার প্রকরণ ও প্রকর্ষ কখনো কখনো অবক্ষয়িত হয়েছে বা কখনো কখনো উন্নততর হয়েছে। তবে থিয়েটার যেরকমই হোক তার সাফল্যের মূল চাবিকাঠিটা লুকিয়ে আছে কিন্ত নাটকটার মধ্যে। অজস্র অর্থব্যয় করে থিয়েটারকে আড়ম্বর করে যতই জমকালো করে সাজানো হোক মূল নাটক দুর্বল হলে তা শেষপর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে পারে না বা গভীরভাবে ছুঁয়ে যায় না, যদিও এই ছুঁয়ে যাওয়াটা দর্শকের বৌদ্ধিক ও রসগ্রহণের ক্ষমতার ওপরও ভীষণভাবে নির্ভর করে। এই ক্ষমতার অভাব থাকলে বুদ্ধিদীপ্ত ও পরীক্ষামূলক নাটক তার মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যায়। তাকে ছুঁয়ে যেতে পারে না। বিশ শতকে প্যারিসে একসময় ইয়োনোস্কোর চেয়ার নাটকের শো তে মঞ্চে ফাঁকা চেয়ারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে অডিটোরিয়ামেও ফাঁকা চেয়ারের সংখ্যা বাড়তে থাকত। চিত্রকলায় ইম্প্রেশনিজম,এক্সপ্রেশনিজম,সুররিয়ালিজম,কিউবিজম,সাংকেতিকতা ইত্যাদি নানা আন্দোলনের উদ্ভব সরাসরি মঞ্চশিল্পকে প্রভাবিত করে পরিবর্তিত করেছে এবং এটা অনস্বীকার্য ও বলাই বাহুল্য যে তা থিয়েটারে প্রচণ্ড বিচিত্রতা দান করেছে ও তাকে বহুল পরিমাণে উৎকৃষ্ট করে দর্শককে ভীষণভাবে বিস্মিত,আলোড়িত ও হৃষ্ট করেছে। থিয়েটার জগত সমৃদ্ধ হয়েছে পিসকাটর,গর্ডন ক্রেগ,উৎপল দত্ত ইত্যাদি বহু বিদেশী ও ভারতীয় মহাপ্রতিভাধর নাট্যশিল্পীদের সৃজনশীল ও নব নব প্রয়োগকলার অবদানে। কিন্ত এটাই, মঞ্চমায়ার এই ঐশ্বর্যময় বৈচিত্র্য ও আড়ম্বরই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। উন্মুক্তস্থানে দিবালোকে অভিনীত গ্রীক নাটকে মুখোশের ব্যবহার ছাড়া বিচিত্র মঞ্চস্থাপত্য নির্মাণ করে মঞ্চমায়ার সৃজন বা বিচিত্র আলোকায়নের দ্বারা মায়ার সৃজন করা হোত কি?। তাহলে গ্রীক থিয়েটারের সাফল্যের রহস্য কোথায় সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। এবং উত্তরটা হল জোরালো গ্রীক নাটক ও নিঃসন্দেহে তার জোরালো অভিনয়। আহার্য,আঙ্গিক,বাচিক ও সাত্ত্বিক অভিনয় ছাড়া প্রাচীন সংস্কৃত নাটকেও ওসব মায়া সৃজনের আয়োজন ছিল না বলেই মনে হয়। ছিল না নানা ভারতীয় লোকনাট্যে বা চীনা ও জাপানী নাটকে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও থিয়েটারওয়ালা এবং আধুনিক ভারতীয় থিয়েটারের জনক। তিনি তাঁর ‘’রঙ্গমঞ্চ’’ প্রবন্ধে লিখছেনঃ ‘‘ শকুন্তলার কবিকে যদি রঙ্গমঞ্চ দৃশ্যপটের কথা ভাবিতে হইত, তবে তিনি গোড়াতেই মৃগের পশ্চাতে রথ ছোটানো বন্ধ করিতেন। অবশ্য, তিনি বড়ো কবি--রথ বন্ধ হইলেও যে তাঁহার কলম বন্ধ হইত তাহা নহে; কিন্তু আমি বলিতেছি, যেটা তুচ্ছ তাহার জন্য যাহা বড়ো তাহা কেন নিজেকে কোনো অংশে খর্ব করিতে যাইবে? ভাবুকের চিত্তের মধ্যে রঙ্গমঞ্চ আছে, সে রঙ্গমঞ্চ স্থানাভাব নাই। সেখানে জাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে। সেই মঞ্চ, সেই পটই নাট্যকারের লক্ষ্যস্থল, কোনো কৃত্রিম মঞ্চ ও কৃত্রিম পট কবিকল্পনার উপযুক্ত হইতে পারে না।‘’ কয়েক বছর আগে দেখেছিলাম প্রভূত অর্থব্যয় করে নির্মিত এক অতি আড়ম্বরপূর্ণ প্রযোজনা। যেখানে দেখলাম জমকালো আলো,স্টেজক্রাফট,পোশাক ও মিউজিক সহযোগে মঞ্চমায়া সৃজনের বিশাল আয়োজন। এসব যে খুব ভালো আয়োজন তা বলাই বাহূল্য। কিন্তু এসবের চেয়ে বেশী প্রয়োজন মূল নাটকের জোরের। ঐ জোর না থাকলে প্রযোজনা সামগ্রিকভাবে খুব একটা সাফল্য অর্জন করতে পারে না ও সামগিক আবেদন উপযুক্ত মানের হয় না ও ফলতঃ প্রযোজনাটা শেষপর্যন্ত ছুঁয়ে যায় না। যেটা হয়েছে ঐ প্রযোজনাটার ক্ষেত্রে। মূল নাটকের রচনায় দুর্বলতা,ত্রুটি এবং নাট্যসংঘাত ও নাট্যোৎকন্ঠার ঘাটতি থাকার জন্যে। যা পূরণ করা যায় নি আড়ম্বরপূ্র্ণ মঞ্চসজ্জা,আলোকায়ন,পোশাক ও মিউজিকের প্রয়োগ ও সামগ্রিক অভিনয় ভাল হওয়া সত্ত্বেও। সাহিত্যের সৃজন যদি দীপ্তিময় অনল হয় তাহলে তার জ্বালানী কী? প্রেরণা? তারই বা উৎস কী? অভিজ্ঞতা? হ্যাঁ। এটাই। এ উত্তর কারোর অজানা নয়। বিশেষ ও নির্বাচিত নব নব অবজেকটিভ ও সাবজেকটিভ অভিজ্ঞতার জ্বালানী পুড়ে পুড়ে জন্ম হয় সাহিত্যের।
কবিতা,নাটক,গল্প,উপন্যাসের। এই অভিজ্ঞতার উৎস যদি স্রষ্টার নিজের জীবন হয়? আত্মজৈবনিক উপন্যাস ব্যতীত সাহিত্যের অন্য কোন ফর্ম, যার ফুয়েল যদি হয় রচনাকারের নিজস্ব অন্তর্দাহ বা অন্তর্লীন রক্তক্ষরণ? তার অন্তরজগতের গভীরতম বেদনা ও অবচেতনার নির্বেদের উৎস থেকে সৃজিত হওয়া সেই সাহিত্যকর্ম পাঠ করে উপযুক্ত পাঠকের প্রত্যাবর্তন ঘটে স্রষ্টার চেতন ও অবচেতন মনোজগতের সেই আবেগ ও অনুভূতির উৎসে, যেখান থেকে সৃজিত হয়েছিল সাহিত্য। তখনই হয় পাঠকের ক্যাথারসিস। সার্থক হয় সৃজন। তাই মনে হয় নাটককারের নিজস্ব অবজেকটিভ ও সাবজেকটিভ অভিজ্ঞতাই জন্ম দিতে পারে রসোত্তীর্ণ নাটকের। দর্শক বা পাঠকের কাছে অজানা থেকে যায় রচনাকারের নিজস্ব জগৎ। তেল পুড়ে প্রদীপ জ্বলে। আলোর দীপ্তিতে ঋদ্ধ হয় পৃথিবী। নিঃশেষ হওয়া তেলের খবর কেউ রাখে না। পায় না। জানে না। পৃথিবী লাভ করে শিল্পমণ্ডিত সার্থক নাটক।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours