fiture
দেবাশিস ভট্টাচার্য, যুক্তিবাদী লেখক, কলকাতা: জীবনের নানা দুঃখের মধ্যে কথাটা হয়ত বড্ড খাপছাড়া শোনাবে, তবু বলি, এ জীবনটা কিন্তু আসলে খুব মজার । রাস্তা থেকে লোক ধরে যদি জনে জনে জিজ্ঞেস করা যায়, আচ্ছা মশায়, অচ্ছোদপটল মানেটা ঠিক কী বলুন তো, তাহলে বেশিরভাগ লোকই খুব ঘাবড়ে যাবে । কিন্তু আবার ওই একই লোকেদের ‘অলৌকিক’ মানে জিজ্ঞেস করলে প্রশ্ন শেষ করার আগেই উত্তর এসে যাবে । অথচ দেখুন, এই অচ্ছোদপটল, যাকে ইংরিজিতে বলে কর্নিয়া, সেটা আমাদের সবার চোখেই আছে । খুব দরকারি জিনিস । আর অলৌকিক কিন্তু কেউ কোনওদিন চোখে দেখেনি । অবশ্য এটুকু শুনেই খুব শোরগোল পড়ে যাবে । অলৌকিক কেউ কোনওদিন দেখেনি, বললেই হল ? এই যে চিরকালের ফেলটুস পাঁচুগোপাল ঠিক পরীক্ষার আগে নারায়ণের সিন্নি দিয়ে দিব্যি মাধ্যমিকটা উৎরে গেল, এই যে ফার্স্ট বয় নিত্যানন্দ সরস্বতী পূজোর আগে কুল খেয়ে ফেলেছিল বলে অ্যানুয়ালের ঠিক আগেরদিন ম্যালেরিয়ায় পড়ল, এই যে সাত সক্কালে হরিনাম করবার সঙ্গে সঙ্গে খেন্তিপিসির নড়া দাঁত পড়ে গেল আর সেই সন্ধেবেলাতেই কাজের মাসি বেলতলায় বাসন মাজতে বসে বেহ্মদত্যির মূর্তি দেখে দাঁত কপাটি লেগে মুচ্ছো গেল, এসব কি তবে কিছুই নয় ? উঁহু, না । আমি মোটেই বলিনি যে এসব কিছুই নয় । 
আমি শুধু ভাবার চেষ্টা করছি, এই ঘটনাগুলো যদি ঘটেই থাকে, তো তার মধ্যে অলৌকিকটা রয়েছে ঠিক কোন জায়গায় ? ওই প্রথম কেসটা, মানে ফেলটুস পাঁচুগোপালের কথাই ধরা যাক । সে যে বরাবর ফেল করত, পরীক্ষার আগে নারায়ণের সিন্নি খেয়েছিল এবং তারপর পাশও করেছিল, এর একটাও তো অলৌকিক নয় ! তবে কি অলৌকিকতা আছে ওই সিন্নির সাথে পরীক্ষা পাশের এক ধরে নেওয়া সম্পর্কের মধ্যে ? পুরোটা নয়, কারণ কোনও উচ্চাকাঙ্খী বিজ্ঞানী যদি সিন্নি বিশ্লেষণ করে পরীক্ষা-তারণ পদার্থের সন্ধানে নেমে পড়তেন তো সেটা যতই খাজা গবেষণা হোক তাকে মোটেই অলৌকিক আখ্যা দেওয়া যেত না । তাহলে নিশ্চয়ই, ওই যে সিন্নি-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঠাকুর-দেবতাদের কথা আসছে, সেইটাই হল গিয়ে অলৌকিক ? ঠিক তাও নয়, কারণ যদি এমন হত যে স্বর্গের দেবতারা পাঁচুর কেসটা নিয়ে একটা বোর্ড মিটিং-এ বসে শেষকালে সিদ্ধান্ত করতেন যে ওকে পাশ করানো হবে না এবং তার ফলে পাঁচু ফেলটুসই থেকে যেত, তখন আর একে কেউ অলৌকিক বলত না । তাহলে দেখতে পাচ্ছি, অলৌকিকের তিনটি অপরিহার্য উপাদান : এক, একটি আপাতভাবে বিস্ময়কর ও অপ্রত্যাশিত বাস্তব ঘটনা বা তার দাবি । দুই, সে ঘটনা সম্পর্কে কোনও যৌক্তিক ব্যাখ্যার অভাব । এবং তিন, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য থেকে নেওয়া নানা ধ্যানধারণার সাহায্যে যৌক্তিক ব্যাখ্যার অভাব পূরণ । এই তিনটে উপাদানকে ভাল করে চিনে নিতে পারলে বিজ্ঞানের সঙ্গে তুলনায় এর বৈপরীত্যটা খুব পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠবে । বিজ্ঞান আগে নিশ্চিত হয়ে নেয় বিস্ময়কর দাবিটি সত্যি কিনা, তারপর তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে এবং তখুনি তা না পারলে ব্যর্থতা স্বীকার করে নেয় তবু অযৌক্তিক ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয় না । 
আর এই নিয়েই বিজ্ঞানের সাথে অলৌকিকের চিরন্তন লড়াই । প্রাচীন কুসংস্কারকে হঠিয়ে বিজ্ঞান আজ পেয়েছে নিজের আসন, সে গল্প আমরা জানি । কিন্তু বিজ্ঞানের আলো আজও বড় কুণ্ঠিত, আজও সে পৌঁছয়নি অনেক অন্ধকার গুপ্ত কুঠুরিতে । অলৌকিকের বিরুদ্ধে লড়াই তাই সমানে চলেছে আজও । কীভাবে ? সে গল্প পরের দিন । (চলবে)


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours