কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ


- 'আমি ডাক্তার হয়ে গরীবের সেবা করতে চাই!' 
উচ্চ মাধ্যমিকের সেরারা এরকমই বলে থাকেন। ডাক্তারীর পরেই পছন্দ এঞ্জিনিয়ারিং। এঞ্জিনিয়াররাও দেশসেবার কথা বলেন। তবে দশের সেবা করার কথাটা পাবলিক খায় বেশি। আর রোগভোগের সঙ্গে জড়িয়ে বাঙালির জীবন। তাই ডাক্তারির মহিমাই আলাদা। ঠিক এরপরেই কদর এঞ্জিনিয়ারদের।

সেরা স্টুডেন্টস তো, কম বয়সেই বুঝে ফেলে অনেক 'নাবলা' কথাও। তারপর দেশসেবা। বেশ লাগে শুনতে, উচ্চমাধ্যমিক সেরাদের মিষ্টি মিষ্টি কথা। আমাদের ভবিষ্যত।

'চাইল্ড অফ টুডে, ইজ দ্য ফাদার অফ টুমরো!' 

উচ্চমাধ্যমিকের কৃতীরা দেশ ও দশের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। সব স্বামী বিবেকানন্দ আর সিস্টার নিবেদিতার মানসসন্তান। সেবাই তাদের ব্রত। এমনি করেই চলছে দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ।

তবু এই রত্নগর্ভা বাংলার এমন ছিরি কেন? প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। পাবলিক ডাক্তার পেটায়। হুড়মুড়িয়ে পাবলিকের মাথায় ভেঙে পড়ে ব্রিজ। 
কেন? 
জবাবটা হতে পারে ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ারদের অপদার্থতা। চিকিৎসায় বিভ্রাট। কর্মে গাফিলতি। এবং সর্বশেষ সম্ভাবনা দুর্নীতির।
প্রশ্ন আরেকটাও। দেশদশের সেবাকাজ করার জন্য এই দুই পেশাই কেন পছন্দ সেরাদের? রোজগারের সহজ সরল সুযোগ বলে।

সংস্কৃতিবান বাঙালি। আদর্শ ঐতিহ্য নিয়ে বাঙালির জাত্যাভিমান তো উপচে পড়ছে। আর সেই ঐতিহ্যের চূড়ায় বসে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নেতাজি, স্বামীজি, নিবেদিতা। তাদের পরের সারিতেই সত্যজিত, রবিশঙ্কর, উত্তম, সুচিত্রা, মান্না, আরতি, হেমন্ত বা সুনীল, সমরেশ। আবার সৌরভের নাম বলতে তো বাঙালি অজ্ঞান। এরকম আরও কত শত যুগ বদলে দেওয়া বাঙালির সমাহার। যাদের নাম মুখে আনতে না আনতেই, পেটরোগা বাঙালির ছাতিও মোদিজির মাপের ছাপ্পান্ন ইঞ্চি। 

কই একজন তরতাজা নবীন, নবীনাতো বিগ বি হতে চান না! বা রেখা। ধরে নিলাম বিগ বি, রেখারা সত্য যুগের। তাহলে শাহরুখ সলমন কঙ্গনা রানাওয়াত আলিয়া ভাটরাতো আজ সবার হার্টথ্রব। এদের মতোও ত তো কেউ হতে চায় না! 
বাঙালি শখে গান শেখে। ছবি আঁকা শেখে। রবিবার সকালে শিখতে যায় বোলিং, ব্যাটিং। নাম কিনতে মঞ্চে আবৃত্তি শোনায়। নবীন বাঙালি তখন জিত বা মিমি। কখনও শ্রীজাত, আবার আরতিও। তবে টার্গেট কিন্তু সেই জয়েন্ট।

তাহলে কি ধরে নেব, সেরারা ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার হবেন আর ঝড়তি পড়তিরা রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি? নিদেনপক্ষে ওই সত্যজিত সৌরভ। 
তাহলে উচ্চমাধ্যমিক সেরাদের নিয়ে এত লাফালাফি কেন? কিসেরই বা এত গর্ব। নাকি গোটাটাই নিখাদ ভন্ডামি?

একেই বলে দ্বিচারিতা। যাদের মাথায় তুলে নাচি, তাদের মতো হতে চাই না। আর যাদের মতো হতে চাই, তাদের মাথায় তুলে নাচি না। পাখির চোখ, এক জমজমাট জীবন। কাড়ি কাড়ি টাকা, বড় বাড়ি বড় গাড়ি, পয়সাওয়ালা স্বামী বা সুন্দরী বউ, দুন বা দার্জিলিংয়ের কনভেন্টে পড়া সন্তান। ব্যাস তাহলেই জীবনে মোক্ষলাভ। এমবিবিএসের পর এক আধটা স্পেশ্যালিস্টের ডিগ্রি থাকলেতো একেবারে সোনায় সোহাগা। জমিয়ে প্র্যাকটিস।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য দরকার একজন ডাক্তার। সেখানে প্রতি এক হাজার তিনশো তিরিশজন বঙ্গবাসীর জন্য আছে, একজন চিকিৎসক। গতবছর সংসদে পেশ হওয়া ওই পরিসংখ্যানেই পরিষ্কার, ডাক্তার হতে পারলে পেশেন্টের অভাব নেই। রোজগার-পাতিরও গ্যারান্টি।

সেই তুলনায় এঞ্জিনিয়ারদের বাজার মন্দা। রাজ্যে তেমন কল-কারখানা নেই। তাই মোটা মাইনের চাকরিও নেই। তবু আশা, বেড়ালের ভাগ্যে একদিন শিকে ছিঁড়বে। ব্যাস তাহলেই বাজিমাত। দিব্য ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং নাচিয়ে কেটে যাবে সেরাদের জীবন।

উচ্চ অথবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। লালসার বিজ প্রোথিত হয়ে গেছিল সেই এমব্রায়োতেই। আবার ফিডিং বোতল চোষার সময় থেকেই, গেলানো হয়েছে আদর্শের বুলি। সাবধানী চরিত্র সব। স্কুলের খাতায় ভাব সম্প্রসারণ করেছে বটে। কিন্তু পাবলিকলি মনের ভাব সম্প্রসারণ করার মতো হিম্মত কোথায়? 

দেখুন মশাই বাথরুম চেপেও পড়াশোনা করেছি। স্কুল থেকেই টিউশনে ছোটা। ছ'টা টিউশন। তারপর খাওয়াদাওয়া। ঘুমের সময়টাও সেন্সার করতে হয়েছিল। তবেই না উচ্চমাধ্যমিকের সেরা!

এবার জয়েন্টের হার্ডল টপকে মেডিক্যালে অ্যাডমিশন। সামনেই আবার ব্যাপক খাটাখাটনি। যেদিন গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে ডাক্তারি শুরু করবো, সেদিন সুদে-মূলে সব উশুল করে নেব। 
তবে পাইকারি হারে রুগি দেখবো না। মনোযোগ দিয়ে রুগি দেখব। পড়তায় পোষাতে একটু বেশি ভিজিট নেব। আর হ্যাঁ, কমিশন খেয়ে ওষুধ লিখবো না। দরকার না হলে এই থুতু হিসু রক্ত পরীক্ষার জন্যও পাঠাবো না।'

এই কয়েকটা সত্য কথা বললেই তো হয়। ওসব দেশসেবা- টেবা তোমাদের কম্ম নয় বাপু। তোমরাও রোজগার করো। আমাদের রোজগার নির্বিঘ্ন করতে, ঠিকঠাক নিদান দাও। এই কথাগুলি মুখের ওপর বলে, এমন বাপের ব্যাটা কেডা?

নির্মম সত্যি কথাগুলি বলতে সাহসে কুলায় না হবু ডাক্তারদের। পাতি মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট। তাই জলে দুধ। ওদিকে ফলঘোষনা হতেই রাতারাতি স্টার ভ্যালু সেরাদের। রীতিমত ছিনতাই হয়ে যায় উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়রা। সৌজন্যে নিউজ চ্যানেল। টিআরপি বাড়ানোর কেরামতি। তারপর সেই গতে বাঁধা ইন্টারভিউ।
- 'ভবিষ্যতের স্বপ্ন কী?' 
মুখের সামনে নিউজ চ্যানেলের বুম। ক্যামেরার সামনে কৃতী সন্তানের মুখে রসগোল্লা গুঁজে দেয় মা- বাবা। ছোটবেলায় শেখা আদর্শের বুলিগুলি মগজ থেকে কিলবিল করে বেরিয়ে আসে। ইচ্ছে হয় একটু ভালমানুষ সাজার। আদর্শবান বংসন্তান। পাবলিক ধন্য ধন্য করবে। আর গায়ে জ্বালা ধরবে, উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের পারমিতাদির। গতবার এন্ট্রান্স ক্র্যাক করতে পারেনি। এবারেও চেষ্টা করবে। পড়শির গায়ে জ্বালা ধরানোর মজাই আলাদা।

তারপর আছে বই প্রকাশনী সংস্থারা। 
- 'আমি অমুক প্রকাশনীর বই পড়ে সাফল্য পেয়েছি।' টিভি'র পর্দায় নিজের মুখ! ফাটাফাটি সব ব্যাপার-স্যাপার। বিজ্ঞাপন। সব মিলিয়ে বেশ একটা সাফল্যের সেলিব্রেশন। উৎসবের মেজাজ। দু-তিনদিন চুলচেরা বিস্ফোরণ রেজাল্টের। ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়ানো। একেবারে যুদ্ধজয়ের আনন্দ। মেডিয়া হাইপ। 
এরপরেই ব্যাপারটা থিতিয়ে আসে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় কৃতীদের উজ্জ্বল মুখগুলো। আর তাদের দেখা মেলে না। কেউ কথা রাখে না। গোটাটাই আসলে, সেরাদের সেরা ভন্ডামি।

আচ্ছা মনে করে দেখুন তো, এই সেরাদের কেউ কখনও দেশের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার কথা বলেছেন? জোর দিন মগজের ওপর। আরও জোর। কি, মনে পড়লো নাতো? মনে পড়বেই বা কী করে, কারণ ওরা কখনওতো এরকম কিছু বলেননি। দেশসেবা, দশের সেবার মোড়কে আত্মসেবা। গোটাটাই ভন্ডামি। তবে ব্যতিক্রমিরা সব জায়গাতেই আছেন। কিন্তু তাঁদের দিয়ে সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করা চলে না।

দেশ ও দশের সেবা করার মতো নিষ্ঠা থাকলে ডাক্তারি বা এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেও এয়ার ফোর্স, নেভি, আর্মিতে যোগ দেওয়ার অঢেল সুযোগ। পড়াশোনার জন্য খোলা আছে ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমির রাস্তাও।
আছে প্রেস্টিজিয়াস আইএ এস, আইপিএস। কিন্তু কেউ ওমুখো হতে চায় ন। কেন হতে চায় না? কেনই বা এয়ার ফোর্স, নেভি, আর্মিতে যেতে চায় না? সেখানে তো আরও বেশি দেশসেবা।

দেশসেবা করাই যখন উদ্দেশ্য, তখন রাজনীতির রাস্তাই বা ব্রাত্য হবে কেন? মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য রাজনীতির বিকল্পই বা কোথায়? দেশের সার্বিক উন্নতির জন্য রাজনীতি। কিন্তু সেরা পড়ুয়ারা যে ওসবের আশপাশেও নেই, তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রোহতাকের মহর্ষি দয়ানন্দ ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা। 
'ঠিক কজন রাজনীতিতে যোগ দিতে চাও?' জানতে চেয়েছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম। দু'হাজার পড়ুয়ার মধ্যে হাত উঠেছিল মাত্র একটি।
ভারতের 'মিশাইল ম্যান' বলে খ্যাত, এই রাষ্ট্রপতি কিন্তু চাইতেন কলেজ ইউনিভার্সিটির সেরারা রাজনীতিতে আসুক। 
'শুধুই বাণিজ্যিক সংস্থার সিইও না হয়ে সিএম হওয়ার স্বপ্নও দেখ।' আহমেদাবাদের ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্টের ছাত্রদের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। 

বাংলার সেরাদের সম্ভবত ওসব কথা জানা নেই। তাদের জগত সংসার বড্ড ছোট। ওই উচ্চমাধ্যমিকের সিলেবাসের মধ্যেই আটকে। যেই দেশ দশের সেবা করার কথা বলেন, সেই দেশ দশেরও ঠিক কতটুকু খবর তাঁরা রাখেন, তা নিয়েও ঘোর সন্দেহ আছে। 

তবু বড্ড ভয়াবহ রকমের মিল খুঁজে পাই, এই উচ্চমাধ্যমিক সেরাদের সঙ্গে আমাদের রাজনীতির চলতি ধারার কারবারীদের।
একজন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সেরা হয়ে দশের সেবা, দেশের সেবার গল্প শোনান।
আরেকজন নির্বাচনী পরীক্ষার সেরা হয়ে দশের সেবা, দেশের সেবার গল্প শোনান।
দেশসেবার এ কী হিড়িক মশাই!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours