কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ
পলিগামি। বহুগামিতা। নাকি সেই 'এক মানুষ' খুঁজে চলা? মনের মানুষ। মন মহাজন। একের সন্ধান পেতে হাজারজনকে ছুঁয়ে যাওয়া।
'আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনে মানুষ যে রে'
যেখানে দেখ ছাই উড়াইয়া দেখ তাই। অমূল্য রতন তবুও মেলে না। অধরা রতনের খোঁজে চেহারা শুধুই ভস্মময়। বহুগামিতার কলঙ্কে ঢাকা।
পুরুষের
ঝোঁকই বেশি বহুনারীতে। আদি অনন্তকালের এমনটাই ধারনা। এমনকি ধর্মশাস্ত্রেও
বহুগামি চরিত্রের দেখা মেলে। মানুষ হিসেবে তাঁরা হেলাফেলার নয় মোটেই। তবে
এই মহামতিদের সবারই একাধিক স্ত্রী। বাস্তবে ঘটনা অর্ধসত্য। নারীর অন্তরেও
বহুপুরুষের কামনা। তবে ওই যে কথা আছে, শাক দিয়ে মাছ ঢাকা। তার ওপরে আছে
সভ্য সমাজের ছড়ি ঘোরানো। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের অনেক কথাই রয়ে গেছে
'না-বলা'।
পুরুষরা খুশি
হবেন শুনে, বায়োলজিক্যালি নাকি আমি ও আপনারা নির্ভেজাল মনোগামি। তা আমাদের
রকম-সকম যাই ইঙ্গিত করুন না কেন। সম্প্রতি কিছু গবেষক এরকমটাই বলেছেন। শুধু
তাই না, যৌনতার ব্যাপারে নাকি আমরা রক্ষনশীলও বটে। কনজারভেটিভ। তবে
বিজ্ঞান কখনও শেষকথা বলে না।
এদিকে আবার উল্টো সুরে
গেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের বায়োলজিস্ট ডেভিড পি বারাশ। তাঁর মত,
পুরুষের প্রকৃতিতেই সুপ্ত থাকে পলিগামির বিজ। অধিকাংশ জীবকূলেও তাই।
তা
বলিহারি বারাশ সাহেব, চারপেয়েদের সঙ্গে দোপেয়ে পুরুষপুঙ্গবদের এক সারিতে
দাঁড় করিয়ে দিলেন যে! নইলে আপনি কিভাবে বলেন, শৈশব, কৈশোর পেরোতে না
পেরোতেই ছেলেদের সবুজ মনে হিংস্রতার ছোঁয়া লাগে।
আর
মেয়েদের ইডেনের পরী বানিয়ে ছাড়লেন। তাঁদের মনে শুধুই প্রজাপতির রং। কবে
কৈশোর ছাড়িয়ে নারী হয়ে ফুটবে। তবে এটা হককথা, দু'পক্ষই চায় তাড়াতাড়ি বেড়ে
উঠতে।
কিন্তু শিশুর বেড়ে
ওঠাটা কি ওই কমপ্লানের মতো? দেখ, আমি বাড়ছি মাম্মি! বাড়ুক। যতো খুশি বাড়ুক,
তবে ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে নয়। শান্ত এক নীড়ে। বেড়ে চলার পথ হওয়া চাই মসৃণ।
পথ যদি উবরো-খেবরো হয় তো শিশুর ভবিষ্যতও ঝরঝরে।
যে বাচ্চা ছেলেটার শৈশব অস্থির, বড় হলে তার ঝোঁক থাকতেই পারে পলিগামির দিকে।
ফাস্ট লাইফই হবে তার পছন্দ। তার গোটাটাই আজ। বর্তমানেই বাস। ভবিষ্যতের জন্য কোনও কিছু ফেলে রাখতে চাইবে না সে।
আবার
ঠিক এর উল্টো ছবি অন্য পুরুষের বেলায়। ছেলেবেলাটা সুস্থির কাটলে তাদের
পছন্দ স্লো লাইফ। যে কোনও লক্ষ্যপূরণে, পরিকল্পনা করে পা মেপে এগোয়।
দীর্ঘমেয়াদী টার্গেট। কোনও তাড়াহুড়ো থাকে না জীবনে। স্বভাবেও নম্র।
একনারীতেই সন্তুষ্ট থাকে এরা।
মেয়েদের বেলাতেই একই নিয়ম খাটে। অশান্তির আবহে বেড়ে ওঠা মেয়েটাও হয় অশান্ত। ঝড়ের মতো জীবন কাটে তার।
পুরুষদের
বদনাম ঘুচতে বসেছে আরেক সমীক্ষায়। মদনদেবের তাড়নায় পুরুষমানুষ যতোই অস্থির
হয়ে উঠুক না কেন, কখনও পশুর মতো হিংস্র আচরণ করে না। বরং নারীঘটিত
কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েই পশুর মতো তারা খুনোখুনিতে নামে। লড়াই বাঁধে পুরুষের
সঙ্গে পুরুষের। ইতিহাস সাক্ষ্মী, যুদ্ধে জিতে পুরুষরা সম্পদ লুঠ করার
সঙ্গে, লুঠ করতো নারীও। যে পুরুষ যত বেশি শক্তিশালী তার হারেমে তত বেশি
নারী। মানেটা কী দাঁড়ালো? যে পুরুষের শৌর্য বীর্য যত বেশি, সে পুরুষ তত
বেশি বহুগামি।
এই যেমন
আমাদের কেষ্টঠাকুরের কথাই ধরুন না। নরকাসুরকে বধ করে বন্দিদশা থেকে মুক্ত
করলেন ষোল হাজার একশো সুন্দরীকে। তাঁরা সবাই চাইলো শ্রীকৃষ্ণকে বিয়ে করতে।
ব্যাস কানাইও গলে জল। আগেই ছিল আট স্ত্রী। এবার হলো ষোল হাজার একশো আট।
বহুগামিতার মাস্টার স্ট্রোক।
দেবদেবীর কথাতে যখন এসেই
পড়েছি সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি ঋষি ব্রহ্মার কথা না বললে পাপ হবেই হবে। তিনি
অবশ্য দুটিতেই খুশি। দেবাদিদেব মহাদেবেরও মাত্র দুই ঘরনী।
বহুগামিতায়
দেবদেবীরা পাত্তাই পাবেন না আমাদের রাজা-রাজড়াদের কাছে। তাদের ভয়ঙ্কর
যৌনবিলাসের কথা শুনলে, স্বর্গের চোখও কপালে উঠবে। মহারানি, সুয়োরানি,
দুয়োরানি- রানিতে রানিতে ছয়লাপ। আর বাদশাহরা তো আরও এক কাঠি ওপরে। তাদের
ছিল হারেম ভর্তি নারী।
না, নাক সিঁটকোলে চলবে না।
বহুগামিতার ব্যাপক ঐতিহ্য ভারতীয় ইতিহাসে। এদিকে আবার জোরদার চেষ্টা চলছে
ভারতে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার। পুরুষোত্তম রামচন্দ্রের জয়জয়কার। সেই
রামচন্দ্রের পিতৃদেব রাজা দশরথেরও ছিল তিন স্ত্রী। কৌশল্যা, কৈকেয়ি,
সুমিত্রা।
এবার মহাভারতে
যান। দ্রৌপদীর বাস্তব অবস্থাটা ছিল ভাগের বউয়ের মতো। অবস্থার ফেরে তাঁর
পঞ্চস্বামী। বহুগামিতায় বাধ্য করা হয়েছিল তাকে। স্বামীদের মধ্যে প্রথমেই
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। তা তিনি যতোই ধর্মরাজ হোন না কেন, তাঁরও ছিল আরেক
স্ত্রী। নাম দেবীকা। ভিমেরও এক জোড়া স্ত্রী, এক্সক্লুডিং দ্রৌপদী। অর্জুনতো
আরও এককাঠি ওপরে। দ্রৌপদী ছাড়াও আরও তিন সুন্দরীর সঙ্গে ছাদনাতলায় গেছিলেন
তিনি। বাস্তবে পিতৃদেবের মার্গদর্শনেই যেন তাঁদের এই বহুবিবাহ। রাজা
পান্ডুরও ছিলেন দুই মহিষী। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের খাতায়-কলমে একটি স্ত্রী,
গান্ধারী। কিন্তু মহারানির সহচরী সুগধার সঙ্গেও যৌনরসে ডুবতেন তিনি।
ওদিকে
আবার কুন্তি, মাদ্রিও কিন্তু বহুগামি ছিলেন। একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌনসুখে
তৃপ্ত হতেন অম্বিকা, অম্বালিকাও। তারা, সত্যবতী সবাই একাধিক পুরুষের সঙ্গে
ভোগ-বিলাসে অভ্যস্ত ছিলেন।
সোজা কথায়, স্বর্গ মর্ত সব ভেসে গেছিল বহুগামিতার সোঁদা গন্ধওয়ালা চ্যাটচেটে রসে।
তবে
যৌনতার ব্যাপারে মেয়েরা অনেক বেশি গোছানো। আর হবে নাই বা কেন? ছেলেরা তো
শরীরের ভোজ খেয়েই খালাস। মুখ মুছে ফেললেই হলো। কিন্তু রতিক্রিয়ার পরবর্তী
দায়টা পোয়াতে হয় মেয়েদেরই। ছেলেদের আগেই তাদের পড়া হয়ে যায় যৌনতার প্রথম
পাঠ। আর ছেলেরা তখন সবে শিক্ষানবিশি শুরু করেছে প্রেম পাঠশালায়। গোড়ার
দিকটায় থাকে একটু 'কেলাকার্তিক' মার্কা। ঠিক কিভাবে শুরু করবে ভেবে উঠতে
পারে না। সব কেমন যেন জট পাকিয়ে যায়। সব উলটো-পালটা করে ফেলে। কেতাবি ভাষায়
যাকে বলে, বিহেভেরিয়াল প্রোব্লেম।
তবে
একবার লাইনে নেমে পড়তেই যা দেরি। তারপর তো সকালে এক তো বিকেলে আরেক।
প্রেমের বাজার এখন তুঙ্গে। আর সমাজ তো চিরদিনই পুরুষের বহুগামিতার প্রশ্নে
একেবারে কাছা খোলা। তার যত শাসন নারীদের বহুগামিতায়।
তবু অহল্যারা হয়। মুহূর্তের দুর্বলতার শিকার হয়ে কাটায় অভিশপ্ত জীবন।
আর
সমাজ যেখানে মেয়েদের বহুগামিতায় প্রশ্রয় দিয়েছে, সেখানে অবশ্যই 'চোলি কে
নীচে কেয়া হ্যায়'। পাছে পরিবারের জমি, সম্পত্তি ভাগ হয়ে যায়! সেই ভয়ে নারীর
একাধিক পুরুষে আসক্তিকে মেনে নিয়েছে সমাজ। যেমন হিমালয়ঘেঁষা বেশকিছু
অঞ্চল যেখানে চাষের জমি তৈরি করা রীতিমত দুরূহ, সেখানে নারীদের বহুগামিতাও
স্বীকৃত। একাধিক ভাইয়ের স্ত্রী এক নারী। বিশেষ করে হিমাচল প্রদেশের
কিন্নোরে মেয়েরা একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তেই পারে। আবার দক্ষিণ
ভারতে নীলগিরি অঞ্চলে টোডা উপজাতিদের মধ্যেও নারীদের বহুগামিতায় কোনও বাধা
নেই।
যৌনতার স্বাদবদলের রস চাখে নারীও। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে, জমিজমা, সম্পত্তি ভাগাভাগির হাত থেকে নিস্তার পায় পরিবার।
পুরুষের
বহুগামিতায় শুধু যে পুরুষরাই আনন্দ পায়, তা কিন্তু মোটেই নয়। মহিলারাও সেই
আনন্দের ভাগিদার হন। একঘেঁয়ে যৌনতার স্বাদ বদল হলে মন্দ কি? একঘেঁয়েমি
কাটে।
তাহলে কি মনমানুষের
খোঁজ? নাকি শুধুই শরীরের স্বাদ বদলানো। কিসের খোঁজে একের পর আরেক যৌনসঙ্গী
বদলানো? সেই আদিকাল থেকেই বহুগামিতায় আক্রান্ত মানুষ। তবে আধুনিক যুগে
বহুগামিতায় রাশ টেনেছে অনেক দেশ। ভারতবর্ষেও তাই। 1956 সালে আইন করে
নিষিদ্ধ করা হয় বহুগামিতাকে। তাই কলির কেষ্ট হওয়ার বাসনা থাকলেও, সামলে
চলুন।
দুনিয়ার নানা দেশে
পলিগামি নিয়ে নানান দৃষ্টিভঙ্গি। বাইবেলের কথায় আসি। ওল্ড টেস্টামেন্টে
মোজেসের দুই বউ আব্রাহামের তিন। আবার কিং সলোমনের সাতশো। এরকম অজস্র
বহুগামিতার কথা ছড়ানো ছেটানো আছে মানব ইতিহাস, ধর্মশাস্ত্রে। তবে এই
বহুগামিতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে, সোজা আঙুল তুলেছে বাইবেল। সতর্ক করেছে
মানবজাতিকে ।
ওদিকে
সৃষ্টির আদিমানব আদমও জয়গান গেয়েছে একমুখী প্রেমের। ইভের সঙ্গে দেখা হওয়ার
পরে সে বলছে- this is now bone of my bones, and flesh of my
flesh...therefore shall a man leave his father and mother, and shall
cleave unto his wife, and they shall be one flesh.
কী মনে পড়ছে,
'যদিদং হৃদয়ং তব
তদিদং হৃদয়ং মম!'
নাকি
সেই কবে ওই মন্ত্রোচ্চারণ করেছিলেন, আজ আর তা মনে পড়ে না দু'জনের কারুরই।
ঝুল জমেছে দাম্পত্যেও। যৌনখাদ্য খাদকের সম্পর্ক। ঝুলে ফেঁসে শুধুই ছটফট!
এখন আর ঘর টানে না। অফিস থেকে ফিরতে হামেশাই দেরি হয়ে যায় স্বামী-স্ত্রীর।
মন বসে না ঘরেও। সুযোগ পেলেই টুক করে বাইরে বেরিয়ে পড়া। বাইরে যদিও না হন, মনে-মনে আপনারা দু'জনেই আজ বহুগামি।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours