politics
 জীবন রায়, প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ, রাজ্যসভা: (দেশের প্রবাদপ্রতিম বামপন্থী নেতা জ্যোতি বসুর স্মরণে বিশেষ প্রতিবেদন) গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজোতে জ্যোতিবাবুকে গতকাল নতুন করে পেলাম তার সাথে জনগনের গনতন্ত্রিক মঞ্চের অভিমুখটিকে জীবনবোধের অভিমুখে। অনেক সময় মনে হোত, আমরা নিচুতলার কর্মীরা হয়তো বা নিজেদেরকে সর্বজনে নিয়ে যাওয়ার তাত্বিক এবং সামাজিকবোধের অযোগ্যতাকে ঢাকতে গিয়ে জ্যোতি বাবু তো বটেই, অন্যান্য নেতাকেও একটা 'দেবত্ব' আরোপ করে থাকি। এতে একটা সুবিধা আছে তো বটেই, কিন্তু সর্বনাসের পথে নিজেদেরকে 'আকাট মূর্খ' বানিয়ে রাখার চিরন্তনতার পথটিকে যেমন খোলা রাখি, তেমনি 'দেবতা' টিকেও ক্রমে ইতিহাসের এক কোনায় ফেলে রেখে, 'অনৈতিহাসিক' বানিয়ে দিই। কাল বলছিলাম, আমরা জ্যোতিবাবুকে ব্যবহার করি, কদাচিত তাকে খোজার চেষ্টা করি। দোষের কিছু নেই,এটা অনাধুনিকতার প্রবৃত্তি। 
১৫০ বছরেও যদি রবীন্দ্রনাথকে কিংবা নেহেরুকে খুজে পেতে চেষ্টা না করে থাকি তবে জ্যোতি বসুকে খুজতে যাবো কেন? -------এই যে ইতিহাসের প্রতিটি বাকে অতীতকে খুজতে গিয়েই, এসব ব্যক্তিত্বকে যে নতুন করে খুজতে হয়, সেই ধারনাটা যখন থাকে না, তখন সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় - যেদিন রবীন্দ্র-নেহেরু বধের পর 'জ্যোতি বধের' পালা শুরু হবে। এটা নিশ্চিত লিখে রাখুন, যদি রবীন্দ্র বা নেহেরু বধ, যা ২০১৯ শে ঘটেছে, সেটা যখন জনগনতন্ত্রের নেতা- কর্মীরা খাটো করে দেখতে শুরু করবে, ------- তখন তাদের ধরে নিতে হবে, 'জ্যোতি বধের' পালাটা শুরু হোল বলে। ইতিমধ্যে এটা যে ফেসবুকের পাতায় দেখা যায়, সেটাই হয়তো, শ্রীমতি মমতা ব্যানার্জীর জীবনের 'সব থেকে বড় সাফল্য' । আসলে, শুধু সাম্যবাদীদেরকেই নয়, সাম্য-বা কমিউনিষ্ট বিরোধী কিন্তু গনতন্ত্রক টিকে থাকুক সেটা চান - ইতিহাসের প্রতিটি বাঁককে যদি বুঝতে হয়, আধুনিক বিশ্বকে যখন ডুবিয়ে দেওয়াটাই যখন এখন বিশ্ব স্বরযন্ত্র, তখন সেই বাকগুলিকে বুজতে গেলেই কমিউনিষ্ট মানিফেষ্টোর আলোকে বুঝতে হবে। কিন্তু যাদের ম্যানিফেষ্টোকে সামনে আনার কথা, তারাই যদি না জানেন, 'বাইবেলের' পর 'ম্যানিফেস্টোই' বিশ্বে সর্বাধীক প্রচারিত সাহিত্য, এবং ইতিহাসকে পরিমাপের একমাত্র মানদন্ড -- তারা কি করে ইতিহাসের ব্যক্তিত্ব সমুহে ইতিহাসের বাকে বাকে পরিমাপ করবে কিংবা গনতন্ত্রিদের কাছেও ম্যানিফেস্টোকে নিয়ে যাবেন। কাজেই, আমরাও কমরেড জ্যোতি বসুকে একজন অতিসফল মূখ্যমন্ত্রির বাইরে কদাচিত দেখি এবং তেমন আচরন করি দেশের সাম্যবাদী ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে। এটা যখন করি, পদা পিষো এবং পাদি মাসি - রাস্তা বানানেওয়ালা, পুকুর কাটনে ওয়ালা, কিংবা ক্লাবকে টাকা বিলি করার মতো মুখ্যমন্ত্রীরাও চৌ-মাথায় রবীন্দ্রসংগিত গাইয়ে দিইয়েও, 'কালজয়ীত্বের' প্রতিযোগীতায় লেগে যান। যদি মেনে থাকি, জ্যোতি বাবু সর্জনের শ্রদ্ধা পেয়েছিলেন, তাই আমরা তাকে সামনে রেখে, অন্য কারুর কাছে না হোক, নিজের মধ্যে নিজের মাহাত্মের সন্ধান করেছি -----, তবে তো সেটাও খুজতে হবে কেন তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় এবং এই সর্বজন শ্রদ্ধেয়তা কেন ও কিভাবে বাংলা এবং ভারত ছাড়িয়ে বিশ্বভাব জগতকে কিঞ্চিত হলেও আলোকিত করতে পেরেছিলো। একথাও বুঝতে হবে, কিভাবে যখন কোন মানুষ নিজেকে মানবিকতার এই উচু ধাপে উঠে আসার পথে, একটা সহজাত প্রবৃত্তি হিসেবে নিজে থেকে --- দল-ট্রেড ইউনিয়ন-বিশ্ব সাম্য এবং জনগনতান্ত্রিক সম্পর্ক, ব্যক্তি ও মানুষের সম্পর্কগুলির সাথে সাথে কর্মী-নেতা সম্পর্কগুলি ক্রমাগত নিচু থেকে উচু সামাজিক সম্পর্কে বদলে যেতে থাকে। ---- সেটা না হলে, তৎকালিন মূখ্যমন্ত্রী ধর্মঘট সংক্রান্ত বিরুপ মন্তব্যগুলির পর, নিজে মনুমেন্ট ময়দানে গিয়ে, ঘোষনা করতে পারতেন না, - আমরা চাইলেও 'ধর্মঘটের অধিকার কিছুতেই ছাড়বেন না" । দেখেছি, বোধহয় এই 'সার্বজনীনতার কারনেই সম্ভবতঃ সে কালের অন্য দিকপালদের মতোই তিনি 'সম্ভাবনাময়' নতুন অল্পবয়সী কর্মীদের প্রতি জ্যোতিবাবু অনুরক্ত ছিলেন। ভালো লাগে স্মরন করতে, ১৯৭০ এ দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট ভেংগে যাওয়ার পর, জ্যোতিবাবুকে জামসেদপুরে এক সারারাত কথোপতনে আটকে রেখেছিলাম। 'বদ্ধ' নিজে এবং উঠতি কমরেডরা খুব খুশি হয়েছিলেন। -- ১৯৮৯ তে দুর্গাপুরে 'কাজের অধিকারের সারভারত সম্মেলনের প্রশ্নে, রাজ্যে কিছু দোলাচল ছিলো। কমরেড জ্যোতি বসুর আসাটাও কিছুটা অনিশ্চিত, । তৎকালিন সর্বভারতীয় সম্পাদক, চিত্তদা (চিত্তব্রত মজুমদার) আমায় বল্লেন কথা বলতে। জ্যোতি বাবু তখন দিল্লীতে। বুক ঠুকে, উনার পিএ এর সাথে যোগাযোগ করাতে, উনি উনার হাতেই ফোন ধরিয়ে দিলেন। রাজী হয়ে গেলেন। তিনি যদি ১৯৯৪ সালের দুর্গাপুর শিশু মহাউৎসবের তাৎপর্য্য না ধরে ফেলতেন, তখন আঞ্চলিক দলে সেই উৎব নিয়ে যেসব সমস্যা ছিলো, কিছুতেই আসতেন না। এখনো কষ্ট হয়, খোল স্টেডিয়ামে সেদিন ৪ ঘন্টা বসিয়ে রেখেছিলাম । এই সর্বজন শ্রদ্ধেয় রুপটাকেই যদি স্টেটসম্যানসিপ বলে মেনে নিই, তবে মানতে হবে, সমকালিন ইতিহাস, দেশ এবং আন্তর্জাতীক সাম্যবাদী আন্দোলনের বিশ্ব বিস্তৃতি, লন্ডনে থাকাকালিন রজনী পাম দত সমেত ভারতীয় সমাজতন্ত্রি এবং আন্তর্জাতীক খ্যাতি সম্পন্ন দার্শনিক ইত্যাদির সাথে সম্পর্ক ------ জ্যোতিবাবুতে জনগনের জন্য যে ভূমীটি নির্মান করে দিয়েছিলো, তার কর্ষনে, তিনি সাম্যবাদী পার্টীটাকেই সব থেকে প্রকৃ্ত মঞ্চ বলে চিনেছিলেন। তাই, লন্ডন থেকে কোলকাতা বিমান বন্দরে নেমেই যে পার্টি দপ্তরে সোজা গিয়েছিলেন, শেষ দিনের শেষ শোভাযাত্রা পর্য্যন্ত সেখানেই ছিলেন। ---- তিনি যেদিন আলিমুদ্দিনে ঢুকলেন, তাকে আমরা অতি অল্পবয়সীরা কমিউনিষ্ট আন্দোলনের 'রাজপুত্র' বলে চিনেছিলাম, যখন শেষ যাত্রায় গিয়ে শুনলেন তাখন পেলাম তাকে ---- ভারতের মাটি থেকে সাম্যবাদি অভিমুখের সুত্র হিসেবে প্রথম বিশ্ব আলো বা কমিউনিষ্ট অথচ বিশ্বস্বিকৃ্ত স্টেটসম্যান হিসেবে। এই স্ট্যাটসম্যান বা সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রাজ্ঞ পুরুষ হয়ে উঠতে আরো দুটি উপাদান গুরুত্বপূর্নভাবে অনুঘটকের কাজ করেছেঃ প্রথমতঃ বাংলায় যখন, চিরস্থায়ী ব্যবস্থার কারনে কংগ্রেস দল জমিদার পরিবেষ্টিত হয়ে,থাকার কারনে, আধুনিক কংগ্রেসে দেশবন্ধুর উত্তরাধিকার হিসেবে বাংলায় কমিউনিষ্ট জ্যোতি বসুর আত্মপ্রকাশের সুযোগ হয়ে উঠেছিলো। দ্বিতিয়তঃ তার নেতৃত্বে এবং হরেকৃষ্ণ কোনার ও বিনয় চৌধুরীর সহযোগে তিনিই হয়ে উঠলেন এসিয়ার সর্বশ্রেষ্ট ভূমী সংস্কারের সারথী। তার নেতৃত্বে ২০০ বছরের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা ভেংগে দেওয়াই শুধু নয়, এই ভেংগে ফেলায়, বাংলা তথা সারা পুর্ব ভারতে কৃ্ষক ও জন মুক্তিতে এক মহাজাগরনে নেতৃ্ত্ব দিয়ে ইতিহাসের পুরুষ হয়ে গেলেন। মানতে হবেঃ যদি এই মহাজাগনের সৃজনের পথকে কোন 'ভবিষ্যতহীন, ভূমীচ্যুতদের চক্রান্তে রুদ্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তবে একটা বিস্ব স্বরযন্ত্র তার জন্যে অন্যকে দায়ী করার পূর্বে নিজেদেরকেই দায়ী করতে হবে এবং দায়ী করলেই হবে না, --- নিজেদেরকে সমাজে সর্বজন শ্রদ্ধেয় হয় উঠতে, গঙ্গার শত ধারার মতোই সৃজনীর সমস্ত পথ উন্মুক্ত করতে হবে। ২০১৯ উত্তর ইতিহাসকে খুজে পেতেই জ্যোতি বসুকে নতুন করে আবিস্কার করতে হবে ---- সি আর দাসের ধারাবাহিক হিসেবে, ২০০ বছরের পাপের বিনাসে সারথি হিসেবে, শিখতে হবে এই পাপ মুক্তির পথেই বাংলায় কি করে শিক্ষা থেকে পঞ্চায়েত, সেখান থেকে নারীমুক্তি, ১৮ বছরের ভোটাধিকার এবং সেখন থেকে প্রশাসনিক সংস্কার এবং তার সাথে ----- কিভাবে এই সব সংস্কার ১৯৭৭ সালের অল্পসময়ের মধ্যে জনতা চিরতরে ভারতে এক দলীয় এক কেন্দ্রিক শাসনকে ভেংগে দিতে চেয়েছিলো--- কী ভাবেই বা ২০১৯ সেটাকে ফিরিয়ে আনলো; সব শেষে বুঝতে হবে, জ্যোতি বাবু , একটা অতিপশ্চাতপদতার মধ্যেও স্টেটসম্যান হতে পারার কারন, মান্ধাতা চিন্তা এবং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামের কারনে, তিনি এই পথে 'সর্বজন শ্রদ্ধেয়' হতে পেরেছিলেন। একেই জানা যাবে, জনগনের মঞ্ছ সারথী। 
এভাবেই প্রতিটি গ্রামে, শহরে এবং কারখানা গেটে যখন প্রত্যেক কমরেড সর্বজন শ্রদ্দেয় হতে পারবেন জ্যোতিবাবুর প্রদর্শিত পথে, বুঝতে হবে, ---- তিনিই তখন জনগনতন্ত্রের সারথীর যায়গাটি পেয়ে গেছেন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours