fiture
পার্থ বসু, লেখক, হাওড়া: হিন্দি সিনেমার দৌলতে এক সময় ভারতে গানটি আজকের ডিজিটাল ভাষায় যাকে বলে ভাইরাল হয়ে গেছিল। লিখেছিলেন পিতা হরবন্স রাই বচ্চন। নেচেছিলেন পুত্র অমিতাভ বচ্চন। গানটি নিয়ে কিছু বলব বলে কলম ধরলাম। তার আগে এর মুখড়াটা গেয়ে নিই। বাড়ির সামনে মন্দিরতলার মাঠে ফাংশন হচ্ছিল। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লিখলাম না। কারণ এখুনি টের পাবেন। গীটার, গান আর নাচের ককটেল। আমি বাড়ির বারান্দা থেকে শুনতে পাচ্ছি। আমার দরজার সামনে দিয়ে বয়ে গেছে সাধন মজুমদার লেন। মিশেছে মন্দিরতলায়। সাগরে। এখন জন জোয়ারে টই টম্বুর। চাঁটিফাটা রোদ।ভ্যাপসা গরম। গীটার বাদক আয় বৃষ্টির বাজনা শুরু করলেন। আল্লা মেঘ দে, পানি দে। নীচের রাস্তায় কয়েকটি তরুণ বা সদ্য যুবক উচ্চকিত কণ্ঠ দিল-- দে দে পেয়ার দে, পেয়ার দে। শচীন কর্তা বা সলিল সবাই হিন্দি সুরের জগতটিকে পুষ্ট করেছেন বাংলার মাটির গন্ধে। হায়, বাংলার আজকের প্রজন্ম এই সুরে তার নিজের লোকগীতি, তার গন্ধটিকেই চিনতে পারে না। তা হোক। সোজাসাপটা গানটা না হোক সুরটা সারা ভারত খাচ্ছে। হিন্দির হাত ধরেই না ? জগা এই কথাটাই আমায় বুঝিয়েছিল সেই কবে আশীর দশকে। জগা মানে জগন্নাথ। আমার ব্যাঙ্কের ক্যামাক স্ট্রীট শাখার কর্মচারী। হোক সে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মী। তার ভাষা হিন্দি। আর হিন্দি তো রাজভাষা। ভাষার গর্বে সে প্রথম শ্রেণীর কেউকেটা। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন সে বছর সারা ভারতের সব সরকারী অফিসে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। শুধু ব্যাঙ্কে নয়। তাই নিয়ে আমরা কজন খুব নিচু স্বরে ক্ষোভ বিনিময় করছিলাম। জগা হামলে পড়ল। খুব বিনয়ের সাথেই অবশ্য--- সাহাব! রবীন্দরনাথ বহোত বড়া পোয়েট থে ক্যা ? আমরা হতচকিত। জগা সেটা বুঝেই প্রশ্নটা খোলসা করল-- মতলব , রবীন্দরজী হরবন্স রাই বচ্চনসে ভি বড়া পোয়েট থে ? কি বলি একে ? বাঁশ বনে মুক্তো ছড়াব ? লাভ? শুধু বললাম-- হরবন্স রাই বচ্চন ? তিনি কিনি ? জগাকে খেপানোর জন্য বলা। নতুবা এটুকু জানাই ছিল ভদ্রলোক ফিল্মস্টার অমিতাভের বাবা। নেহরুর কাছের লোক ছিলেন। কিছু কবিতার বই আছে। সাংবাদিক। হিন্দি সাহিত্যের একজন স্বীকৃত কবি। জগা রীতিমত আঁতকে উঠল আমার কথায়-- হায় রাম !
আপলোগ হরবন্স রাই কো নহি জানতে !হিন্দি কা মহান কবি। সারা হিন্দুস্তান পহচানতে উনকো। ইয়ে হিন্দুস্তান হ্যায় ন ? হিন্দি হমারা ভাষা হ্যায়। রবীন্দরজী ইতনি লিখে, ইতনি লিখে, লেকিন বাংলা মে লিখে কিউ? হিন্দি মে অগর লিখতে উনকো কিতনি শান প্রতিষ্ঠা হোতি, প্রচার হোতা শোচিয়ে ! রবীন্দ্রনাথ কেন হিন্দিতে লিখলেন না জগার সে কি আফসোস। অফিসের একটি ছেলেকে দিয়ে হরবন্স রাইয়ের মধুশালা আনিয়ে পড়লাম। ওমর খৈয়ামের অনুকরণে কিছু হিন্দি রুবাই। বাংলায় খুব বলিষ্ঠ কলমে অনুবাদ করেছিলেন নরেন দেব। তার সাথে তুলনায় যাচ্ছি না। তুলনার বিষয়ও না। শুধু বলব অনুকরণ মৌলিক সাহিত্য নয়। এই মাল মশলায় উনি বাংলায় পাত্তা পেতেন কিনা সন্দেহ। আমি অবশ্য তার সব লেখা , বা আরও কিছু লেখাও পড়ি নি। আমার মন্তব্য চাল টিপে ভাতের হাল বোঝার মত। তবে হরবন্সজীকে আরও জানার সুযোগ করে দিল আনন্দবাজার। রবিবারের পাতা। একটু বয়স্ক যারা, অন্তত মধ্য বয়সী, মনে করে দেখুন । 'আমার ছেলে অমিতাভ” বা ' আমার চোখে অমিতাভ' এইরকম শিরোনামে অমিতাভের বাবা ধারাবাহিক লিখলেন। রাম না থাকলে রামায়ণ হয় না। তাই অমিতাভকে আসতে হলে আগে তার মা তেজীর কথা এসে গেছে। হরবন্সজী তার সুবচনে শুনিয়েছিলেন, স্মৃতি থেকে বলছি, ' আমার স্ত্রী শ্যামা তখন পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। তেজী এলেন আমার জীবনে। তার সাথে প্রথম দেখা হওয়ার দিনটি ভুলি নি। ' বচ্চনজী এর পর নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে জানাচ্ছেন- ' সেই চোখে চোখ মেলার মুহূর্ত আমার সেই বিখ্যাত কবিতায় ধরে রেখেছি, আবার শুনুন-- যব দেখা থা উনকো তৎকাল ম্যায় সমঝ গয়া মুঝকো ফাঁসানে কি লিয়ে বিছায়া যাতা জাল।' পড়ে আমার জগার কথা মনে পড়ল। এই না হলে কবি ! এইরকম পরিস্থিতিতে আমাদের কবি লিখেছিলেন-- প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস। তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ। আমরা সেই বয়সে এই সর্বনাশের কামনা করেছি। বৈয়াকরণ শব্দের অর্থ সংকলন করেন। কবি শব্দে অর্থ সঞ্চার করেন। এমন বুঝেছি। হরবন্সজীকে পড়ে বুঝলাম পৌরুষ কাকে বলে। তিনি এমনি হরিদাস পাল তাঁকে ফাঁসানোর জন্য নায়িকা জাল বিছাচ্ছেন। পাতি বাঙালীর রুচি ছি ছি করতে পারে , এতে মেয়েটিকে অপমান করা হচ্ছে। এই জন্যেই না লাথ খায় বাঙালী। মেনে নিলাম জগার কথা। আমাদের কবির এই এলেম ছিল না। এবার গানে আসি। যিসকি বিবি মোটি। গানের সুর, এমনকি কথাও নকল হওয়া নতুন কিছু নয়। উত্তম জমানার একটি বিখ্যাত গানের লিরিক চল্লিশের দশকের ছায়াছবি ' দেশের মাটি ' প্রভাবিত। কি আশায় বাঁধি খেলাঘর। এ গানটি সবাই জানেন। দেশের মাটি ছায়াছবিতে কে এল সায়গল যে গানটি গেয়েছিলেন কিছুটা শুনুন বাঁধিনু মিছে ঘর ভুলের বালুচরে উজান ধারা আসি ভাঙিল চিরতরে। হরবন্সজী তার আলোচ্য গানে একটি বাংলা গান, পুরুলিয়ার আঞ্চলিক ভাষার গান টুকলেন। আর জগা ওই যে বলেছিল হিন্দিতে টুকলেন বলেই না বিখ্যাত হল।
পুরুলিয়ার মেছানিদের গানটি নীচে দিলাম। পাঠক মিলিয়ে নিন জাকর ঘরে ডাঙ্গা বহু হো তাকর বেরি নাম, লাফাই লাফাই কঁচরা পড়াই ডাঁড়িক কেথিক কাম। জাকর ঘরে ছুটু বহু হো তাকর বেরি নাম , ঘঁঘাই ঘঁঘাই পানি আনই , হাঁড়িক কেথিক কাম। জাকর ঘরে কানা বহু হো তাকর বেরি নাম , আঁধার ঘরে মিটিক পাড়ই, আলোক কেথিক কাম। জাকর ঘরে খড়া বহু হো তাকর বেরি নাম , হুড়চুক হুড়চুক ঢেঁকি কুটই ইলকেব কেথিক কাম। মানে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ? বারবার শুনুন। জাকর ঘরে ডাঙ্গা বহু হো--- কাঠামোয় জিস কি বিবি লম্বি চেনা যাচ্ছে তো ? 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours