সুবীর পাল, এডিটর, দ্য অফনিউজ:
তিনি যে মা। তাই এখানেও যে ঈশ্বরী পাটনী মনে করেন, “সন্তান আমার যেন থাকে দুধে ভাতে।"
আসলে এ এমন পৃথিবীর ভূখন্ড যেখানে পিতৃত্বটাই গুরুত্বহীন। এখানকার পুরুষেরা নামে মাত্র জীবনধারার শুধুই প্রাকৃতিক সহায়ক। নারী প্রধান ঈশ্বরী পাটনীরাই এখানে শুধু পূজিতা। তাঁরা কখনও বা মা। আবার কোনও সময়ে তাঁরাই কর্ত্রী। আবার প্রয়োজনে তাঁরা অভিভাবিকা। দরকারে তাঁরাই সমাজে দন্ডমুন্ডের কর্তা। আর সামাজিক জীবনযাপনে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা? বিশ্বজনীন এই সুসভ্য রীতির পরোয়া করেন না তাঁরা। এমন জনজাতির নারীসমাজে একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে।
লাল সেনার দেশ চীন। অনেকটা তিব্বত সীমান্তের গা ঘেঁষা এক প্রান্তিক জনপদ। ভৌগলিক মানচিত্রে চিনের সিচুয়ান ও ইয়ুনান প্রদেশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকায় আজও রয়ে গিয়েছে এক দৃষ্টান্তহীন “মোসুও” জনগোষ্ঠীর উপজাতিরা। মোসুওরা অনেক সময় নিজেদের “না” বলেও পরিচিতি দেন। সমুদ্রপৃষ্ট থেকে আনুমানিক ২৯০০ কিলোমিটার উচ্চতায় লগু লেকের ধার ঘেঁষে মোসুওরা বসবাস করেন আদিকাল থেকে। চিনের জনসংখ্যার নিরিখে এরা এতই ক্ষুদ্রাতীত যে লাল সেনার দেশ এই উপজাতিকে ধর্তব্যের মধ্যেই রাখে না।
তবু তাঁরা প্রাকৃতিক নিয়মে আজও নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছেন। নয় নয় করে অঙ্কের গণনায় তাঁরা যে আজও প্রায় পঞ্চাশ হাজার গণদেবতার ক্ষুদ্র গোষ্ঠী।
আক্ষরিক অর্থে এই জনজাতির নিজস্ব সমাজে পুরুষদের কোনও প্রভাবই চলে না কোনদিনই। কারণ মোসুওরা সাধারণত মাতৃতান্ত্রিক সমাজেই বিশ্বাসী ও অভ্যস্থ। আর মাতৃতান্ত্রিকতার এই প্রবল বিরাজ কিন্তু সাম্প্রতিক কালে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই নারীমর্দিনীর নিরঙ্কুশ আধিপত্য এই জনগোষ্ঠীকে গ্রাস করেছে আদিলগ্ন থেকেই। এদের সমাজে পরিবারের পছন্দ ও অপছন্দ, সমাজের রীতি রেওয়াজ, জীবনযাত্রার যাবতীয় দায়বদ্ধতা সবই সামলান মহিলারা। এমনকি সমাজ ও পরিবারের প্রশাসনিক দিকেও ক্ষমতায়নের চাবিকাঠি থাকে স্থানীয় প্রমীলাদের হাতেই। এককথায় পরিবারের মহিলারাই এখানে “হাইকমান্ড”।
অবাক হবার তালিকা এখানেই শেষ হয়নি। হতবাক হবার আরও উড়ন্ত অবসর বিশ্ববাসীর রয়ে গিয়েছে এই জনগোষ্ঠীর রীতির ডানায় ভর করে। চমকে যাবার মতো তথ্য মনের মনিকোঠায় উঠে আসবেই মোসুওদের সামাজিক প্রথার কথা ভাবলে। কি সেই প্রথা যা বিশ্বসমাজের উল্টো স্রোতে আজও বহমান এই পঞ্চাশ হাজারি অস্তিত্বে? আসলে এদের সমাজে বিয়ের রীতিরেওয়াজ বলে কিছুই মান্যতা নেই। নেই পুরুষের নিজস্ব কোনও পছন্দের অগ্রাধিকার। এই সমাজে নারীরাই বেছে নেন তাঁদের পছন্দের পুরুষদের। বিয়ের পর যেমন পুরুষের ঘর করতে মেয়েরা যান শ্বশুরবাড়ি। এটাই তো দস্তুর। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করেন না মোসুও নারীরা। তাঁদের কোনও পুরুষকে পছন্দ হলে ওই পুরুষকে আসতে হয় সেই নারীর গৃহেই।
ধীরে ধীরে। এখনও বিষ্ময়ের শেষ হয়নি। বৈচিত্রের আলাপচারিতার রাত যে এখনও অনেক বাকি। মোসুও নারীর সবুজ সংকেত পেলে “না” পুরুষরা আসেন নারীর গৃহে। কিন্তু স্রেফ একটি রাতের জন্য। তারপর? তারপর আর কি, পুরুষটির নিজের বাড়ি ফিরে যাওয়া। এইভাবেই যে অনন্তকাল যাবৎ চলে আসছে লগু লেকের এক সামাজিক মান্যতা। যা তাঁদের একেবারেই নিজস্ব মিলন-পেটেন্ট। হয়তো কোনও নারী অতি আকৃষ্ট হলে বারংবার তাঁর পছন্দের একই পুরুষকে আহ্বান করেন। কখনও বা না-পছন্দ হলে নির্দ্বিধায় পাল্টে নেন পরিবর্তিত পুরুষকে।
না না, একদমই এসব গর্হিত গসিপ নয় তাঁদের সমাজে। আদিকালের এই এক রাত্রিকালীন বহমান সামাজিক নিয়মের মধ্যেই জারি রয়ে গিয়েছে ডারউইন মতবাদের নিরন্তন জন্মবৃত্তান্ত। এখানেও জন্ম নেয় মাতৃক্রোড়ে। কিন্তু সেই সন্তান পালনের পূর্ণ দায় যে মোসুও নারীদের উপরেই বর্তায়। এই সমাজ ভ্রূক্ষেপ করে না সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের। সন্তানকে যে মাই এখানে দুধু ভাতু খাইয়ে পালন করেন। তাহলে পুরুষেরা কি শিশু লালনপালন করেন না এখানে? করে করে। তাঁরাও বাড়ির শিশুকে বড় করে তোলেন পরম স্নেহ যত্নে। বোন বা দিদির সন্তান অর্থাৎ ভাগ্নে বা ভাগ্নিকেই যে তাঁরা নিজস্ব বাড়িতে নিজের সন্তানের মতো আদর কাড়া ভালোবাসা দিয়ে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে বলতেই হয় শিশুর বড় ওঠার গোকুলধাম যে তারই মামাবাড়ি।
চৈনিক দেশের এই উপেক্ষিত জনজাতির সমাজ যে এক রাত্রির ফুলশয্যায় জীবনচক্রেই আত্মনির্ভর।
বিশ্বের দরবারে তাঁদের প্রথা নিয়ে আবালবৃদ্ধবণিতা ভ্রূ কোঁচকালেও মোসুও পুরুষের কাছে আজও মর্যাদার ও সম্ভ্রমের আসনে অধিষ্ঠাত্রী “মসিহা” নারী । প্রকৃতপক্ষে সিচুয়ান ও ইয়ুনান প্রদেশের হিমশীতল পরিমণ্ডলে “না” নারীরা এখনও শুধুই উপেক্ষার চাহিদা-যন্ত্রে পরিগণিত হননি। এই অঞ্চলে তাঁরা এখনও ধর্ষিতা হন না। এমনকি শ্লীলতাহানির সাক্ষীও হতে হয় তাদেরকে। সমাজে ভুলেও এখানকার কে তুমি নন্দিনীকে একবারও “মাল” বলে টিটকারি দেন না। এখানে এটাই সামাজিক রীতি। তাই এলাকার নারীরা এখানে আদিকাল থেকে রয়ে গিয়েছেন পুরুষের সমীহ আদায়ের এক বিচিত্র আধার। আসলে "না"এর দেশে মহিলারা এখানে যথার্থই যশং দেহি রূপং দেহি।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours