fiture
মতিয়ূর রহমান, অধ্যাপক, কলকাতাঃ  যুগযুগ ধরে মানুষ দেবদেবীর সন্ধান করেছে। আকারে বা নিরাকারে তাঁকে পেতে চেয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক চাওয়া ও অভ্যাসের সেই অন্ধ চাওয়াটা চাইতে গিয়েই মানুষ নিজে হয়েছে পুরো অন্ধ। ধরাছোঁয়ার বাইরে যা তাকে কল্পনা আর আপন মনের মাধুরি মিশিয়ে করেছে রচনা। তাই জীবনের বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে প্রত্যক্ষ ঋণ যাঁদের কাছে রয়ে যায় তাদেরকে সে আর দেখতে পায়না। পাবে কী করে ! ততদিনে তো কল্পনার দেবতা তাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে। তাই আজ হোক মর্তের দেবদেবীদের মধ্যে সামান্য দু একজনের কথা। যাঁরা মর্ত্যের অগনন দেবদেবীর প্রতিনিধিও। এক দেবতার কুমন্ত্রনায় বদলে ফেল্লুম ইস্কুল । কূয়োর ব্যাঙ সমুদ্রে গেলোনা ঠিকই, তবে মোটামুটি একটা বড়সড় নদীতে এসে পড়লো । ডেপুটেশন ভ্যাকান্সি ট্যাকান্সি ওসব তখন বুঝতাম না। হঠাৎ হঠাৎ শিক্ষক আসেন আবার চলেও যান। কেন আসেন আর কেন যান তা বুঝতাম না তখন। তা ওই ডেপুটেশন ভ্যাকান্সিতে আসা এক দেবতা, সহঃ শিক্ষক শ্রী বৈকুণ্ঠবিহারী দাশ মহাশয়ের বিশেষ কৃপাদৃষ্টি পড়েছিল আমার উপর । ষষ্ঠ শ্রেণীর বাৎসরিক পরীক্ষার ফলাফল পত্রে অনেককিছু ভালো কথার সাথে লেখা ছিল একটি বাক্য - " Promoted to Class - Vll." তাই খাতায় কলমে তখন সপ্তম শ্রেণী । জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ, শীত পড়েছে জব্বর। প্রচুর সর্ষেতেল মালিশ করেও জননী রোধ করতে পারছেনা তার দুবলা ছেলেটার গায়ে পৌষের তীব্র শীতের খড়ি ওঠা দাগগুলোকে । সোয়েটার ঢাকা সেই শরীর নিয়ে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে এক বালক সূয্যিমামার থেকে উত্তাপ নিচ্ছে পুরো একলা । পঠন-পাঠন, কেলাস- ফেলাস ওসব নেই । বেশ একটা গা ছাড়া গা ছাড়া ভাব । স্কুলে তখন পুস্তক তালিকা, যাকে বলে "বুক লিস্টি" দেওয়া হচ্ছে। স্কুল বেশ ফাঁকা ফাঁকা । ছাত্র এলে ভালো না এলে কোন অসুবিধা নেই । তার পরিবর্তে তার পিসতুতো কিম্বা মাসতুতো ভাই এসে 'বুক লিস্ট'টা নিয়ে গেলেও কোনো অন্যায় হবেনা । বকের পালকের মত সাদা ও টানটান ধুতির উপর খদ্দরের পাঞ্জাবি এবং তার উপরে কাশ্মীরি শালে তিনি উদয় হলেন শীতার্ত সেই সদ্য কিশোরটির সামনে। কাছে ডেকে নিজের সংস্পর্শে টেনে নিলেন । তারপর গলা নামিয়ে ধীরে ধীরে বললেন, " তোকে একটা কথা বলি, মন দিয়ে শোন। তুই অমুক নামী স্কুলটায় পড়তে যা । আমার মনেহয় একটু বড় জায়গায় যাওয়া তোর দরকার । এখানে থাকলে তোর মনে হবে তুই ' বন দেশের শিয়াল রাজা '। তবে একটি কথা, আমার কথা শুনিস আর না শুনিস সে যা পারিস করিস । কিন্তু বাবা, দেখিস - কথাগুলো যা তোকে বললাম তা যেন 'হেড স্যার ' কোনভাবেই জানতে না পারেন । তাহলে আমার ভীষণ ক্ষতি হবে ! " সবে 'সাত কেলাস' মানে সপ্তম শ্রেনী, হলে কীহবে সব বুঝতে পারলাম ।
স্যার কী বলছেন, কেন বলেছেন। স্যারের কীসের ভয়, কেন ভয়- সবই । তখন শুধু জানতাম না আর বুঝতাম না - 'বৈকুন্ঠবিহারী ' নামের অর্থটা কী। পরে বুঝেছিলাম আর এও বেশ বুঝেছিলাম সত্যিই তিনি বৈকুণ্ঠধাম থেকেই এসেছিলেন শুধু আমারই জন্য । ওই স্কুলে সাকুল্যে দশ মাসের মত ছিলেন তিনি এবং আমাকে যখন কথাগুলো বলছেন তখন সেই মেয়াদ শেষ হয় হয় । আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম মোচড়ে যাঁর প্রত্যক্ষ হাত তিনি এই প্রণম্য ব্যক্তি । ইনি যদি দেবতা না হন তাহলে দেবতা কে ? বাড়ি থেকে ঠিক তিন মিনিট দূরত্বের স্কুলকে রেখে এমন একটা স্কুলে যেতে চাই যেখানে বাড়ি থেকে যাতায়াত করা সম্ভব নয়। থাকতে হবে সেখানে। সব শুনে মা বাবার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল আর মুখ হল ভার । গোপনে বাবা এসে দেখা করলেন সেই দেবতা, বৈকুণ্ঠবিহারী দাশ মহাশয়ের সাথে । কী আলোচনা হয়েছিল জানিনা । ফিরে এসে বাবা মাকে বললেন, " ওর স্কুল বদল দরকার " । অবশেষে আমার জননী, প্রথাগত শিক্ষা এবং ডিগ্রি ও সার্টিফিকেটের নিরিখে যিনি বিদুষী নন তিনিই স্বল্প কথায় বাবাকে বললেন, " মণির পড়াশোনার ব্যবস্থা ওই স্কুলেই কর "। পরিবার ও পাড়ার সবাই নামটা সংক্ষেপ করেছিল ' মতি'তে কিন্তু আমি ছিলাম আমার জননীর 'মণি' । এ বিশ্বের সব মায়ের কাছে তাদের নিজ সন্তান তাদের নয়নের মনি। একথা কী আর কেমন বেশিকথা বা নতুন কথা! তাঁর সংক্ষিপ্ত ওই নির্দেশই ছিল চূড়ান্ত, যা একেবারেই 'ফাইনাল' । সংসারে তিনি সববিষয়ে সবসময় নির্দেশ দিতেন না কিন্তু যদি কোন সিদ্ধান্ত একবার নিতেন এবং নির্দেশ দিতেন তাহলে সেটা হয়ে যেত পুরো 'ফাইনাল'। তাঁর সাড়ে ছয় দশকের সংক্ষিপ্ত জীবনে আমৃত্যু এর ব্যত্যয় ঘটেনি কোনিদিন । শিক্ষাবর্ষের শুরু, চারদিকে স্কুল ভর্তির কাজ চলছে । বাবা এলেন স্কুলে, দেখা করলেন হেড স্যারের সাথে । বাবার বাসনা শুনে প্রধান শিক্ষক শ্রী মেঘনাদ হালদার, এম.এ, বি.টি মেঘগর্জনে বললেন, "এ হতে পারেনা। ট্রান্সফার সার্টিফিকেট আমি দেবই না । সাহেব, আমার স্কুল ছোট হতেপারে কিন্তু আপনার ছেলের কী সমস্যা বলুন, আমি তা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করব। কিন্তু ওকে আমি আমার স্কুল থেকে যেতে দেবনা । " এরপর বাবার সাথে তাঁর কিছুক্ষণ কথাবার্তা ও আলাপ আলোচনা পর তাঁকে বেশ স্তিমিত দেখালো । অবশেষে তিনি বললেন, " যাবি, তাহলে যা! আমার তো জুনিয়র স্কুল, দু বছর পরেই তো ছাড়তেই হত, তা দুবছর আগেই না হয় ছেড়েই দিলাম তোকে ! " যে মানুষটি স্কুলে একেবারে সার্থকনামা 'মেঘনাদ ' ছিলেন তাঁর সেদিনের সেই কন্ঠস্বরে বাপ- বেটা দুজনের চোখে জল এলো । ট্রান্সফার সার্টিফিকেট লেখার সময় আমার সাধারণ বাবা, যিনি কোন তথ্য বিকৃতির কথা ভাবতেই পারেন না কী যেন একটা লেখা দেখে স্যারকে কিছু একটা বলতেই আমার দেবতুল্য প্রধান শিক্ষক তাঁকে বাধা দিয়ে বললেন," না না, আমি যা লিখেছি ঠিক লিখেছি, ওতে ওর মঙ্গল হবে আর পরে ও আমার কথা মনে রাখবে । আপনি এ নিয়ে কিছু ভাববেন না । আমি যা লিখেছি ওর জন্যই লিখেছি । ও তো আমারও ছেলে, ঈশ্বর ওর মঙ্গল করুন । " এক দেবতার আশিস নিয়ে জীবনের যাত্রা হলো শুরু। দশকের পর দশক পেরিয়ে গেল সেই দেবতাকে ভুলতে পারলাম কই ! মনে তো রেখেছিই। পেশাগত কারণে বরঞ্চ আজকাল আরো বেশিবেশি করে মনে পড়ে সেই দেবতাকে । যাইহোক, এক দেবতার কুমন্ত্রনায় ও অন্য এক দেবতার বদান্যতায় শেষমেষ স্কুল বদল করেই ফেললাম । নতুন স্কুল, কাউকে চিনিনা, কেউ তখনো বন্ধু হয়নি। স্কুলের গভীর নলকূপ থেকে একা একা জল পানের চেষ্টা করছি কিন্তু তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিনা। হঠাৎ পিঠে একটা মৃদু ধাক্কা, ভীষণ স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল আজকের ভাষায় যাকে বলে স্মার্ট এক সমবয়সী বালিকা বললো, " হ্যান্ডেলটা ছাড়ো, সামনে যাও, জল খাও । " সেসময় প্রথম পরিচয়ে অপরিচিত কাউকে ছোটোরাও ' তুই ' বলতো না । এটাই ছিল তখনকার রীতিনীতি । জল পান শেষ হল । তারপর সে নিজেই সব বলে গেল - সে আমার ক্লাসে পড়ে । এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তার বাবা এবং তার রোল নম্বর দুই, কেননা সে ওই ক্লাসের সেকেন্ড গার্ল । এই সুন্দর বালিকার আসল নাম যা তা দেবী সরস্বতীর অপর নাম । তাই এখানে তার নাম দিলাম- সরস্বতী । সে এক অদ্ভুত মেয়ে। প্রচলিত গন্ডির বাইরের এক বালিকা। এই স্কুলের ছাত্র সংখ্যা প্রচুর। আগের স্কুলের চেয়ে দশগুণেরও বেশি । ধীরেধীরে সরস্বতী ছাড়া ক্লাসের অন্যান্য সবার সাথেও বন্ধুত্ব হল । স্কুলের বড়রা হল দাদাদিদি, ছোটোরা হল ভাইবোন। আর সরস্বতী সে সবার থেকে আলাদা । প্রাণবন্ত এক বালিকা । তার ব্যবহার, পড়াশোনা,ব্যক্তিত্ব ও ব্যক্তিগত পরিচিতি সব মিলিয়ে সবার কাছে তার আলাদা মর্যাদা। সবার সে স্নেহের পাত্রী। পড়াশোনা চলতে লাগল ৷ সব ভালো, কেবল সমস্যা একটাই - দূরের এই নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির কোন ছাত্রাবাস নেই । তাই থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত ঠিকমতো হয়না, যা হয় তা মনেরমত নয় । সেখানে নানা ধরনের সমস্যা । মা বাবা, পরিবার পরিজন ছেড়ে থাকা একটি ক্লাস সেভেনের ছাত্রের কাছে তা অনেক ভারী একটি বিষয় । মাঝেমাঝে ভীষণ হতাশায় মন খারাপ হয় । মনেহয়, কেন যে আসলাম সব ছেড়ে । সেইসব চিন্তার ও বিষন্নতার একটা ছায়া সবসময় মুখে লেগেই থাকে যা সবাইকে খুব একটা কাছে ডাকেনা বরঞ্চ কিছুটা দূরেই সরায় । কিন্তু সরস্বতী, মনোজ, রবিশংকর, অসীম, শিবানী, পূরবী, কৃষ্ণা, জয়ন্ত, জাকির ও রফিক ইত্যাদিরা কাছেই থেকে গেল বরাবর। সরস্বতীদের বাড়ি স্কুলের একেবারে কাছেই । টিফিনের সময় ইচ্ছেমত সে বাড়ি যায়। একদিন সে বললো, " চল্ আমাদের বাড়ি যাই।" ততদিনে তুই বলাবলি শুরু হয়েগেছে। গেলাম তার সাথে তাদের বাড়ি । মেয়ের সাথে অপরিচিত এক কিশোরকে দেখে বিশেষ প্রসন্না হলেননা সরস্বতী জননী। ভীষণ বিরক্তি ও অবজ্ঞায় খুব সংক্ষেপে জিজ্ঞেস করলেন, " ও কে রে ? " সরস্বতী আমার নাম সহ যা যা বলার সব বললো । আর যায় কোথায় ! মুসলমানের পোলাকে বাড়ি নিয়ে তোলার জন্য সেই ফর্সা মানুষ ক্ষেপে একেবারেই লালে লাল । খাঁটি বরিশালের ভাষায় যা বললেন তাতে মনে হল ধরণী দ্বিধা হও । তোমাতে প্রবেশ করে এ যাত্রায় মরে যাই এবং বেঁচে যাই । কোনক্রমেই পালিয়ে এলাম স্কুলে । মান-অপমান যা কিছু সব পড়ে রইল পিছনে। সরস্বতীর উপর রাগ হল খুব। নিজের বাড়ি না বুঝে কেন আমাকে সে নিয়ে গেল সেখানে । টিফিনের পর সমস্ত ক্লাস হল কিন্তু সেগুলোতে আর কিছুতেই তেমন মন দেওয়া গেলনা । ছুটির সময় যেন কিছুই হয়নি তেমনি করে সরস্বতী বলল, " কিছু মনে করিসনা " । কোন ব্যাখ্যা না, কোন অপরাধবোধও না, কোন সংকোচও না। শুধুই ছোট্ট একটা বাক্য, " কিছু মনে করিসনা " । যেন কিছুই হয়নি । অনেকদিন গড়িয়ে গেল। ইতিমধ্যেই "হাফ ইয়ারলি" পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল। নতুন স্কুলের প্রথম পরীক্ষা । ভাগ্যের এমনই পরিহাস সরস্বতীর জায়গা মানে পজিশনটা গেল আমার জন্যই । সে একধাপ নামল আর তিন নম্বর মনোজ, সে নামল আরো আর একধাপ। সরস্বতী যে বিশেষ রুষ্ট হয়েছে তা বোঝা গেলনা । তবে সে তার হারানো জায়গা ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে যুদ্ধ চালাতে লাগলো । আর এক নম্বর ? সে হল রবিশংকর দে । অসম্ভব তার আত্মবিশ্বাস, বয়সে একটু বেশিও। ক্লাসেই তো তাকে দাদা মনে হতো । সবার মুখে মুখে শুনতাম, সে নাকি বাংলাদেশে উঁচু ক্লাসে পড়তে পড়তে এদেশে এসে একটু পিছিয়ে ভর্তি হয়েছিল । ওদেশে থাকে তার বাবা মা । এদেশে সে তার আত্মীয়ের বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করছে । সাত ও আটের দশকে এমন ঘটনা এবং এমন ছাত্রের সংখ্যা ছিল এপারে ভুরিভুরি । নবম শ্রেণীতে পেলাম কালো মেয়ে কৃষ্ণাকে । সেও একইভাবে ওদেশ থেকে এসেছিল আর দেখিয়েছিল তার পড়াশোনার ধার । যদিও শত চেষ্টায়ও সে প্রথম বৃত্তে ঢুকতে পারেনি একথা সত্য । তেমনি একথাও সত্য যে প্রথম বৃত্তের খুব কাছেই সে তার নিঃশ্বাস ফেলেছিল । অনেকের বুকে ভয় ঢুকিয়ে ছিল। যাইহোক রবিশংকর ছিল চীনের প্রাচীর । খুবই ব্যতিক্রমী মেধার এক ব্যতিক্রমী ছাত্র । ইংরেজি বাংলা দুটি হাতের লেখা একেবারে মুক্ত । লেখাপড়ার কোন সমস্যা তার কাছে কোন সমস্যাই না। তার স্থানচ্যুত করা প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি, মানে যাকে বলে next to impossible. সে প্রথম হতো দ্বিতীয়ের সাথে অনেকটাই ব্যবধান রেখেই । নাহলে যে তার জাত থাকেনা ! সে সত্যিই ছিল নির্বাচিত জাতের ' স্টুডেন্ট ' । তার সাথে ধাক্কা লাগার কোন সম্ভাবনাই সে রাখত না । স্কুলে ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সবার সমীহ সে আদায় করে নিয়েছিল নিজগুণেই । এই স্কুলে সে যে সেরার সেরা ছেলে ও সেরা শিক্ষার্থী। একদিন টিফিনের সময় হেড স্যারের খাশ বেয়ারা সন্ন্যাসীদা এসে বলে গেলেন, " হেড স্যার তোমাকে ডাকছেন। দেখা করে এসো । " ভয়ে দুরুদুরু বুক আর কাচুমাচু মুখ নিয়ে হেড স্যার শ্রী নারায়ণ চন্দ্র রায়চৌধুরী , এম.এ,(ইংরাজি), এম.এ. (দর্শন), বি.টি-র রুমে ঢুকে প্রণাম করলাম । কী যেন একটা করছিলেন তাই মুখ না তুলে বললেন, " বসো "। কাছাকাছি একটা টুলে বসলাম । বললেন, " তুমি এবার ক্লাস সেভেনে সেকেন্ড হয়েছ । তাহলে তো দেখছি, তোমাকে ইস্কুলে নিয়ে ভুল করিনি । যাক, মন দিয়া পড়াশুনা করো । " আগের কথাগুলোর উত্তর দেওয়া যায়না তাই চুপ করে ছিলাম। শেষের কথায় বাঁচলাম। বললাম, " আজ্ঞে, হ্যাঁ স্যার । " খাতাপত্রের উপর চোখরেখে নিজের কাজ করে চলেছেন, আর অল্প সময় পরপর একটা একটা করে সই করছেন । এরমধ্যেই দু একবার মুখটা দেখে নিলেন ৷ কিছুক্ষণ নীরবতা,তারপর বললেন ক্লাসে যাও । ওঠে দরজা পেরোনোর আগে পিছন থেকে আবার হেড স্যার, "শোনো রবিবার বিকালে আমার বাড়ি আসবে । " ঘুরে বললাম, " আজ্ঞে, হ্যাঁ স্যার । " ক্লাস সেভেনের ঘরে ফিরছি কিন্তু মনের মধ্যে বইছে প্রবল ঝড়। রবিবার বিকালে স্যারের বাড়ি ! মানে আবার সেই মাসিমা, সরস্বতীর মায়ের সামনে আবার ! একেই কী বলে, " যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়! " হেড স্যারের আদেশ অগ্রাহ্য করার মতো বুকের পাটা ওই অঞ্চলের কারো ছিলনা সেখানে তাঁর ছাত্রদের কথা আর কী বলবো ! তাছাড়া আমার কথা তো আর ধর্তব্যের মধ্যে পড়েনা। যাইহোক ভয়ে ভয়ে রবিবার বিকালেই গেলাম স্যারের বাড়ি। না গিয়ে উপায় ছিলনা, আমার ঘাড়ে মাত্র একটাই তো মাথা ! ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হতোনা ! পাশে বসিয়ে সব বৃত্তান্ত শুনলেন তারপর একটি চিঠি লিখে হাতে দিয়ে বললেন, " জালালউদ্দিনকে এই চিঠি দেবে । সে আমার পুরানো এবং প্রিয় ছাত্র । আশাকরি তোমার সমস্যার সমাধান হবে । " কী আশ্চর্য! হোলও তাই, আমি একটা ভদ্রস্থ থাকার জায়গা পেয়ে গেলাম । খাওয়া দাওয়া পাশের এক হোটেলেই এবং তার মালিকের নামেও হেড স্যারের একটা চিঠি গেল যাতে তাঁর প্রতিও কিছু নির্দেশ ছিল ৷ দেবদেবীরা নিঃশব্দেই কাজ করে। কিন্তু যে কথাটা না বললে নয় তা হল সেই যাওয়াটাও কিন্তু স্যারের বাড়িতে শেষ যাওয়া ছিলনা। ওই স্কুলে অর্ধ যুগ পড়লাম, মানে বারো বছরে যদি এক যুগ হয় সেই হিসাবেই ! তা ওই সময়ের মধ্যে অজস্র বার, অগণিত বার ওই বাড়িতে গিয়েছি । আর যেতে যেতে বেশ বুঝলাম, সরস্বতী যতটা না তার মায়ের মেয়ে তার থেকে অনেক বেশি সে তার বাবার মেয়ে । মায়ের বোন মাসিকে বলা হয় মাতৃসমা । আজও ঠিকমতো জানিনা ঠিক কোন কোন কারণে সরস্বতীর মা, মাসিমা ধীরে ধীরে মাতৃসমা হয়ে যাচ্ছিলেন । সেকি আমার দেবতুল্য হেড স্যারের জন্য, না তাঁর দেবকন্যা সরস্বতীর জন্য, না আমার ব্যবহারের জন্য, না নাকি তাঁর নিজেরই দেবীত্বে উত্তরণের জন্য , নাকি সবটার জন্যই ! আমার কাছে তা ছিল এক গভীর রহস্যময় প্রশ্ন । দু এক সপ্তাহ কোনো কারণে যাওয়া না হলে সরস্বতী বলতো, " মা তোকে যেতে বলেছে । " সেদিনও অবাক হতাম এবং আজও এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারিনা , ঠিক কোথায় ছিল তাঁর পরিবর্তনের মূল কারণটা ! যাইহোক, দেব-দেবীদের নিবাস কোথায় জানিনা কিন্তু আমার চোখে আজও শ্রী বৈকুন্ঠবিহারী দাশ, শ্রী মেঘনাদ হালদার, শ্রী নারায়ণ চন্দ্র রায়চৌধুরী ও তাঁর সহধর্মিণী এবং তাঁর সুকন্যা সরস্বতী প্রত্যেকেই দেবতা কিম্বা দেবীর প্রতিমূর্তি । আজ যদি কেউ বলে তার ধর্মমতে যে বিশ্বাসী নয় তাকে 'কাফের ' ভাবতে হবে তার চেয়ে বড় ভণ্ড আর কেউ হতেপারে না । আরবী শব্দ 'কাফের' এর আভিধানিক অর্থ হল - 'অবিশ্বাসী' । তা মানুষ মাত্রেই তো কোনো না কোন ভাবেই অবিশ্বাসী । সবাই কী সব মতে আর সবস্থানে বিশ্বাস রাখে ?
 না তা রাখা সম্ভব ? যে যেখানে বিশ্বাসী সে সেখানেই ' ইমানদার ' । সেই অর্থে অন্যেরাও তাদের নিজ নিজ বিশ্বাসে - ' ইমানদার '। কিন্তু যে নিজের জীবনের স্বর্গীয় ঘটনা প্রবাহগুলো এবং বৃহত্তর সমাজের ব্যবহারিক অবদান ও প্রত্যক্ষ ঋণকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করে সে কীভাবে বিশ্বাসী বা ইমানদার থাকবে ? বিশ্বাসের ভিত্তি তো নির্মিত হয় গোড়াতেই । আর বিশ্বাসী নাহলে মাথার উপরে যিনি আছেন তিনি কি তাকে ক্ষমা করবেন ? তিনি নিজেই যে বলেন, " অকৃতজ্ঞ জনকে আমি মোটেও ক্ষমা করিনা । " পিতামাতা, শিক্ষক - শিক্ষিকা সহ এই জীবনে নানাস্তরের মানুষ বিভিন্ন সময়ে দেখা দেয় দেবদেবী হয়ে আমরা অন্ধজন তাই চিনতে পারি না। পারলে মঙ্গল হতো নিজের, মঙ্গল হতো দশের আর মঙ্গল হতো সমাজের ও দেশের। চলে যেতে পারতো ভেদাভেদের ছোট ছোট কুঠুরির সংকীর্ণতঅম দেওয়াল গুলোও ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours