fiture
রণজিৎ গুহ, প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী, লেখক ও সমাজকর্মী: ফরাসী বিপ্লবের সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতার এই আধুনিক ভাবনা ইউরোপ থেকে এল ভারতে।সমাজ জীবনে তুলকালাম আলোড়ন তুলল।আধুনিকতার প্রভাবে রামমোহন থেকে নবজাগরণের যে সূচনা তা ক্রমশই সমাজ জীবনে নানা কর্মকাণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন আনল।সমাজ জীবনে আধুনিকতার ভাবনা ও প্রয়োগ বৈষয়িক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সমগ্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও প্রভাব বিস্তার করল যথেষ্ট পরিমাণে। ঐতিহ্যবাদীদের পিছুটান সত্বেও আধুনিকতা নিজের জোরেই ঢুকে পড়ল শিল্প সাহিত্যের সংসারেও। অনেকেই আশা করেছিলেন যে সমসাময়িক সমাজ ব্যাবস্থা যেমন তার নিজস্ব শিল্প সংস্কৃতি গড়ে তোলে একই ভাবে শিল্প সংস্কৃতিও পারে সমাজ শরীরকে প্রভাবিত করে ঠেলে দিতে নতুনতর দিশায়।
কিন্তু গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরে নতুন নতুন প্রযুক্তি বা প্রায়োগিক কৌশল ধাক্কা দিতে পারল না আমাদের আর্থ-সামাজিক ভাবনা চিন্তায়। প্রকৃত পক্ষে সাহিত্য শিল্পে এক উন্নাসিক ঔদাসিন্য, শুদ্ধতার কল্পনা বিলাস আধুনিকতাকে আটকে দিল ভদ্রের বৈঠকখানায়।আধুনিকতা এড়িয়ে চলল শূদ্রের ছেঁড়া কাঁথা। আধুনিকতা সর্বত্রগামী হলো না।সাংস্কৃতিক জীবনে শ্রমিক অনুপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখা হলো। দলিতরা আধুনিকতার স্বাদ পেলনা। ভদ্র ও শূদ্রের বিনোদন সম্ভার পৃথকই রয়ে গেলো। প্রযুক্তির অমিত শক্তি হয়তো বা নিম্নবর্গের জীবনে ছিটেফোঁটা হেরফের ঘটাল কিন্তু সত্য, ন্যায় ও সৌন্দর্যর যে আধুনিক ধারণা তা তাদের অধরাই থেকে গেল। গোটা সমাজে আধুনিক মনস্কতা জারি হলনা। অনেকে মনে করেন সর্বত্রগামী না হওয়ার জন্য আধুনিকতার নিজস্ব আভ্যন্তরীণ রক্তাল্পতাই দায়ী, বা জন্মসূত্রে পাওয়া এক অশোভন পঙ্গুত্ব আধুনিকতাকে অভিমানী করে বেঁধে রেখেছে কয়েকজন বিলাসী মানুষের খেয়ালীপনায়। এরা মনে করেন যেহেতু আধুনিকতার বহু সীমাবদ্ধতা তাই আধুনিকতার বিরোধিতাই প্রগতিশীল আন্দোলনের নয়া পরিচয়। সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার বিরোধিতা তো সব অর্থেই প্রগতি বিরোধী। যেহেতু আধুনিকতা সাব-অলটার্নদের দৈনন্দিন যাপনের ইতর বিশেষ ঘটাতে পারেনি অতএব আধুনিকতার বিরোধিতা করতে হবে, এই বিভ্রান্তি আমাদের পিছিয়ে দেয় অনেকটা। এই বিভ্রান্তি আধুনিকতা বিরোধীদের বিভিন্ন শিবিরে বিভক্তও করে দেয়।আধুনিকরণ ও আধুনিকতার সহজ পার্থক্যটুকু ধরতে না পেরে প্রযুক্তি নির্ভর উন্নয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কেউ বা বলে ওঠেন ' দাও ফিরে সে অরণ্য '। সব বুঝেও কেউবা আধুনিকতা আমাদের দেশে অপ্রাসঙ্গিক বলে চালাবার চেষ্টা করেন। আর্থিক বৈষম্যের অজুহাতে প্রযুক্তিকেই দায়ী করেন।তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ঘড়ির কাঁটা পিছনের দিকে চালাতে চান।এবং নানা স্তরে সমর্থনও পেয়ে যান।আধুনিকরণের বিপদজনক দিকগুলিকে আধুনিকতার বিপদ বলে চালিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র প্রশয় পেয়ে যায়। আর্থসামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের প্রতি সহানুভূতিশীল সুজনেরাও এই অস্পষ্টতায় ভোগেন। আধুনিকতা আজও সর্বাংশেই আধুনিক। প্রকৃত সমাজকর্মীর দায়িত্ব এটুকুই যে আধুনিকতাকে এলিটদের কবল থেকে বের করে এনে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া। ' যত মত তত পথ' বা 'শত পুষ্প বিকশিত হোক' --- এসব আধুনিকতার উচ্চতর পাঠ।সমাজ পরিবর্তনের আগুয়ান কর্মীর আশু কর্তব্য এর বাস্তব প্রয়োগ সাধন করা। সতর্ক থাকতে হবে পদে পদে। মনে রাখতে হবে যারা বিকল্প হীন সমাজতত্ত্বর কথা বলে তারা অন্য অর্থে জেদি মৌলবাদের নামান্তর। কবি বা ভাস্কর কিংবা সঙ্গীতজ্ঞ বা ক্রীড়াবিদ অধিকাংশই উদাসীন ভাবনায় উপভোক্তাদের গ্রাহ্যে আনেন না।অথচ শৈল্পিক আয়োজন যদি প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে না হয় তবে তা সর্বত্র পৌঁছাবে কি ভাবে?।
নিজের গেরস্থালী গুছিয়ে উপভোক্তার দিকটি অবশ্যই সযত্নে দেখতে হবে। ঐতিহ্যবাদীদের আগ্রাসন থেকে আধুনিকতাকে বাঁচানোও এক অতি জরুরী কাজ।প্রগতিকে সাধারণ্যে পৌঁছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের বিরোধিতা, আধুনিক কৃষ্টির বিরোধিতা খুবই ঝুঁকির হতে পারে।এলিট বা ভদ্রের যাপনের নিন্দা মন্দ কিন্তু আধুনিকতা বিস্তারে বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে। অন্ধকার আবহে আলোর ছটা পৌঁছাতে আলোকে তো অস্বীকার করা যায় না।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours