fiture
 মুজতবা আল মামুন, সাংবাদিক, কলকাতা : কোনও সুস্থ মানুষের পক্ষে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সমর্থনযোগ্য নয়। তাই সারা বিশ্ব আজ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধ নানান ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু সন্ত্রাস মোকাবিলার নামে যদি আপনার ব্যক্তিস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হয় ? সেই ষড়যন্ত্র যদি খোদ রাষ্ট্রের তরফ থেকে আসে ? আসে নয়, এসে গেল। বিরোধীদের প্রবল আপত্তি নস্যাৎ করে, কয়েকদিন আগে, সংখ্যাধিক্যের জোরে কালা কানুন ‘বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ) সংশোধনী বিল’ পাশ করিয়ে নিল কেন্দ্র সরকার। এতে আগামী দিনে যে কাউকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে গ্রেফতার করতে পারবে সরকার। সে ক্ষেত্রে তথ্য-প্রমাণ থাকতে হবে এমন নয়। স্রেফ সন্দেহ হলেই হবে। সংশোধনীর ওই ধারাটি নিয়েই মূলত আপত্তি তুলেছিলেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, মানবাধিকার সংগঠনগুলোরও বক্তব্য, রাষ্ট্রের কোনও কাজের বা নীতির বিরোধিতা করলে, বা কাউকে অপছন্দ হলে, তাকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে গ্রেফতারের অধিকার চলে এল সরকারের হাতে। যা এ দেশকে পুলিশি রাষ্ট্রের দিকে আরও এক ধাপ ঠেলে দিল। গণতান্ত্রিক কোনও রাষ্ট্রে এমন বিধি থাকা উচিত নয়। মনে হতেই পারে, আগে থেকে এমন নেতিবাচক ভাবনা কেন ? এর জবাব খুঁজতে খুব বেশি দূর যেতে হবে না। খুব সাম্প্রতিক সংবাদ, ২৩ বছর জেলে পচার পর, তিন কাশ্মীরীকে বেকসুর খালাশ দিল রাজস্থান আদালত। জঙ্গি সন্দেহে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। রাষ্ট্র ওই তিনজনের জঙ্গিপনার আধখানা প্রমাণও পেশ করতে পারে নি। নগর-নকশাল বলে দেশের বহু পরিচিত সমাজকর্মীদের জেলে পচানো হচ্ছে। অভিযোগ, এবার এই অনৈতিক ব্যাপারগুলোর ব্যবহার হবে লাগামছাড়া। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সমাজের প্রতি। ১৯৯৬ দৌসা বাস বিস্ফোরণ মামলায় দোষী সাব্যস্ত ৬ সংখ্যালঘু মানুষকে মুক্তি দিল রাজস্থান হাইকোর্ট। ষড়যন্ত্রের কোনও প্রমাণ না মেলায়, ২৩ বছর পর মুক্তি মিললো ওদের। দৌসা জেলায় বাস বিস্ফোরণে ১৪ যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল। আহত হয়েছিল ৩৯ জন। এই ৬ ব্যক্তি বিগত ২৩ বছর বিনা জামিনে জেল বন্দি রয়েছেন।
 তাঁরা ২০১৪ সালে নিম্ন আদালতে দোষী সাব্যস্ত হন। তারপর যাবজ্জীবন কারদণ্ড হয়। রাজস্থান হাইকোর্টে আপিল করা মামলার রায় হতে এত বছর পার । অবশেষে প্রমাণাভাবে মুক্তি পেলেন তাঁরা। স্রেফ সন্দেহবশত গ্রেফতার এবং পরে বেকসুর খালাশের ঘটনা এই একটা নয়। বহুদিন ধরে হয়ে আসছে। তার কয়েকটা : ক) ১৯৯৩-এ হায়দারাবাদের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিস্ফোরণ, পুলিশ কর্ণাটকের গুলবার্গের বাসিন্দা নিসারুদ্দিন আহমেদকে, পরে তার দাদা পেশায় সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জহিরুদ্দিনকেও গ্রেপ্তার করে। দীর্ঘদিন পুলিশ গ্রেপ্তার দেখায়নি। পরে টাডা প্রয়োগে দুই ভাইকে বহু মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দেয়। ২৩ বছর পর তিনি বেকুসুর খালাস পান। খ. ১৯৯৮-এ জনৈক আমির খানকে গ্রেপ্তার করা হয় এক বিস্ফোরণ মামলায় । ১৪ বছর পর মুক্তি। অপরাধ, পুলিশের চাহিদা মত অন্য দেশের বিরুদ্ধে চর বৃত্তি করতে রাজি হননি। গ. ২০০১-এ আলিগড়ের পিএইচডি ছাত্র গুলজার আহমেদ ওয়ানিকে সবরমতি এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ কাণ্ডে গ্রেপ্তার । দিল্লি, মহারাষ্ট্রে ও উত্তরপ্রদেশ সহ আরো দশ বিস্ফোরণ কাণ্ডে তাঁকে জড়ানো হয়। ২০১৭ সালে অর্থাৎ 16 বছর পর সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে মুক্তি পান। ঘ. ২০০৬ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর গুজরাটের অক্ষরধাম মন্দিরে হামলায় মৃত ৩৩, আহত ৮৬। বলা হয়, পাক মদত পুষ্ঠ হামলা। তাতে মুফতি আব্দুল কাইয়ুম সহ ৬ জন গ্রেপ্তার হন , ১১ বছর পর সুপ্রিম কোর্টে নির্দোষ প্রমাণ হয়ে মুক্তি পান। অপরাধ, তিনি গুজরাট দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্থদের পুণর্বাসনের ব্যবস্থা করছিলেন। ৫. ২০০৩-এ সন্ত্রাসবাদী অভিযোগে পোটায় দিল্লিতে গ্রেপ্তার হন অাঞ্জুম জামারুদ হাবিব। ৫ বছর পর ছাড়া পান। ইনি ছিলেন এক মুসলিম নারী সংগঠনের সভানেত্রী। ৬. ২০০৫-এ দিল্লির তিনটি স্থানে বিস্ফোরণে মারা যায় ৬৭ জন। সন্দেহবশত তিন কাশ্মীরী মুসলিমকে কাশ্মীর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১০ বছর পর বিচারক রিতেশ সিং নির্দোষ ঘোষণা করে মুক্তি দেন। ৭. ২০০৬-এ সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার ইরশাদ আলি ও মৌরীন কামার। ১০ বছর পর নির্দোষ প্রমাণ। ৮. ২০০৬-এ মুম্বাইয়ে লোকাল ট্রেনে অল্প সময়ের ব্যবধানে পরপর বিস্ফোরণে ১৮৮ জন মৃত। এক সংখ্যালঘু যুবক গ্রেপ্তার এবং ৯ বছর পর নির্দোষ হিসেবে মুক্তি। ৯. ২০০৬ সালে মালেগাঁওয়ের হামিদিয়া মসজিদের কাছে বিস্ফোরণে ৩৭ জন মৃত। ছ'জন মুসলিম গ্রেপ্তার, ১০ বছর পর বেকসুর খালাস পান। এসব জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সামনে থাকায়, বিলটি লোকসভায় পেশ করার ব্যাপারেই আপত্তি জানিয়েছিলেন বিরোধীরা। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানোর দাবিও ওঠে। তা উড়িয়েই বিলটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় কাল। গোটা বিলে মূলত দু’টি সংশোধনী নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিরোধীদের। প্রথমত, আগামী দিনে স্রেফ সন্দেহের বশেই কাউকে সন্ত্রাসবাদী হিসেবে গ্রেফতার করা যাবে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না-থাকলেও কাউকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করা যাবে। সংশোধনীর ওই শর্তে আইনের অপব্যবহারের আশঙ্কা করছেন বিরোধীরা। তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র বলেন, ‘‘এর ফলে সরকার বিরোধিতা করলেই সন্ত্রাসবাদী বলা হবে। জাতীয় সুরক্ষা থেকে অন্য অনেক বিষয় নিয়ে কারও মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তা হলেই দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হবে? হয় সরকারের সঙ্গে সুর মেলাও, না-হলেই দেশদ্রোহী— এই তত্ত্বে মানুষ বিশ্বাস করেন না। সরকারের সঙ্গে ভিন্নমত হলেই কেউ দেশদ্রোহী নন। হতে পারে তিনি প্রবল ভাবে জাতীয়তাবাদী।’’ কংগ্রেসের মণীশ তিওয়ারি থেকে এনসিপি-র সুপ্রিয়া সুলে কিংবা এমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি, সকলেরই প্রতিবাদ জানান। তাঁদের মতে, এটা আসলে বিরোধী স্বরকে স্তব্ধ করার কৌশল। মূলত ‘শহুরে নকশালপন্থীদের’ এবং সংখ্যালঘুদের কথা ভেবেই আইনটি আনতে চলেছে সরকার। তা ধরা পড়েস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের কথায়। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা শহরে বসে তত্ত্বকথা আউড়ে মাওবাদীদের সাহায্য করেন, তাঁদেরও বরদাস্ত করা হবে না।’’ সংশোধনীতে এও বলা হয়েছে, যে কোনও নাগরিকের বাড়ি তল্লাশি ও তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার থাকবে এনআইএ-র । 
আর মতো সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশের অনুমতি লাগবে না। এটা তো সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় আঘাত। সন্দেহবশত গ্রেফতারের পরিসংখ্যান দেখার পরও কী মনে হয় না, এই সংশোধনী আইন মুক্তকন্ঠ ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতায় যথেচ্ছ ব্যবহারের অস্ত্র মুঠোয় নিয়ে নিলেন মোদি-অমিতের অক্ষশক্তি।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours