fiture
শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:   ইতিহাস কখনই কল্পকাহিনী হতে পারে না। ভারত গবেষণার ঐতিহাসিকরা, তিনি বিদেশীই হন বা এদেশের, কোনও না কোনও তথ্যসূত্র সংগ্রহের মাধ্যমে গবেষণা করেই ভারতবর্ষেের প্রাচীন ইতিহাস লিখেছেন। ভারতীয় প্রাচীন ইতিহাসের উপাদান বলতে আমরা প্রধানত দুই ধরনের উপাদান বুঝি। 
 ১) প্রত্নতাত্ত্বিক উপদান : প্রাচীন শিলালিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি নিদর্শন এবং ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ প্রভৃতি হল ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। 
২) সাহিত্যিক উপাদান : সমকালীন ঐতিহাসিকদের রচনা ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক সাহিত্যকীর্তি হল মূলত ইতিহাসের সাহিত্যিক উপাদান। এই সাহিত্য আবার দেশীয় সাহিত্য ও বৈদেশিক বিবরণ দুই ধরণের হতে পারে। দেশীয় সাহিত্যকেও কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, 
ক) ধর্মীয় গ্রন্থ : যেমন বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ন, মহাভারত, ত্রিপিটক, জাতকের কাহিনী, কল্পসুত্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আবার বিভিন্ন স্মৃতিশাস্ত্রগুলি যেমন নারদ স্মৃতি, 'মনুস্মৃতি ইত্যাদি। 
খ) ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থ : যেমন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, পতঞ্জলির মহাভাষ্য, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকম, বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস ইত্যাদি। 
গ) জীবন চরিত : যেমন বাণভট্ট রচিত হর্ষচরিত, সন্ধ্যাকর নন্দী রচিত রামচরিত, বিলহন রচিত বিক্রমাঙ্কদেবচরিত ইত্যাদি। 
ঘ) আঞ্চলিক ইতিহাস : যেমন কলহন বিরচিত রাজতরঙ্গিনী ইত্যাদি। বৈদেশিক বিবরণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মেগাস্থেনিস, ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ, আল বেরুনী ইত্যাদির বিবরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। 
 এইসব থেকে প্রাচীন ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থ‍া সম্পর্কে একটা ধারনা উপলব্ধি করা যায়। এখন যদি কেউ এইসব গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যসূত্র থেকে রচিত ইতিহাসকে অসত্য বলেন তাহলে প্রস্তর যুগ থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকে পর্যন্ত সমস্ত ইতিহাস যার মধ্যে রয়েছে কুষাণ যুগ, মৌর্য যুগ, গুপ্ত যুগ থেকে সুলতানি আমল বা মুঘল আমল - সবকিছুই অসত্য বলে অগ্রাহ্য করা যেতে পারে। রণদীপম বসু লিখেছেন, "পৃথিবীতে যতগুলো কথিত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার মধ্যে মনে হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ (Manu-smriti) বা ‘মনুসংহিতা’ (Manu-samhita)। ব্রাহ্মণ্যবাদের (Hinduism) আকর গ্রন্থ শ্রুতি বা ‘বেদ’-এর নির্যাসকে ধারণ করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা।" (ভারতীয় দর্শনের বিকাশ, রণদীপম বসু, মুক্তমনা ব্লগ) প্রাচীন ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় আপনি যদি শূদ্রের সামাজিক অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে চান মনুসংহিতার তথ্যসূত্র বাদ দিয়ে, তাহলে তা রাম-বিহীন রামায়ণ রচনার মতো দাঁড়াবে। যদিও মনুস্মৃতিকে ধর্মগ্রন্থ ঠিক বলা যায় না, বরং একে সামাজিক রীতিনীতির শাসনতন্ত্র বলাই ভালো, তবুও বারোটি অধ্যায়ে বিভক্ত ২৬৮৩ শ্লোকের এই গ্রন্থটির প্রতি পাতায় যে শ্লোকগুলি লেখা আছে সেগুলো পড়লে বোঝা যায় তাদের যখন সমাজে পালন হত, সেই সমাজে কোনো মানবিকতা বলে শব্দই বোধহয় ছিল না। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতার রচনাকাল ন্যূনতম দুইহাজার বছর পূর্বে। তবে সুকুমারী ভট্টাচার্য এবং আধুনিক ঐতিহাসিকরা বলেন মনুস্মৃতি কুষাণ যুগের রচনা। আসুন, মনুসংহিতা থেকে শূদ্র সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা যাক। 
 ১) "লোকানান্তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহূরুপাদতঃ। ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিযং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নিরবর্ত্তয়ৎ॥" অনুবাদ - সৃষ্টিকর্ত্তা পরমেশ্বর ভূলোকাদি প্রজা বৃদ্ধি করিবার মানসে আপন মুখ, বাহু, উরু ও পদ হইতে ক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি বর্ণের সৃষ্টি করিলেন, অর্থাৎ মুখ হইতে ব্রাহ্মণ, বাহু হইতে ক্ষত্রিয়, উরু হইতে বৈশ্য ও পদ হইতে শূদ্রের সৃষ্টি করিলেন। (শ্লোক নং ১/৩১, পৃষ্ঠা ২৫, মনুসংহিতা, উপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় সম্পাদিত, বসুমতী সাহিত্য মন্দির) 
২) "এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ। এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া॥" অনুবাদ - ভগবান প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রদিগের পক্ষে এই কর্মের ভার সমর্পণ করিলেন যে,তাহারা অসূয়াবিহীন হইয়া প্রাধান্যরূপে এই বর্ণত্রয়ের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য) সেবা শুশ্রূষা করিবে। (শ্লোক নং ১/৯১, প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৪৬) 
 ৩) "শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ। শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে॥" অনুবাদ - শূদ্র ধনার্জনে সমর্থ হইলেও পোষ্যবর্গপ্রতিপালন ও পঞ্চযজ্ঞাদিসাধনোপযুক্তের অধিক ধন সঞ্চয় করিবে না, যেহেতু, শাস্ত্রানভিজ্ঞ দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে শুশ্রাদি না করিয়া ব্রাহ্মণের পীড়ন করিতে পারে। (শ্লোক নং ১০/১২৯, প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৯০২) 
৪) "শূদ্রন্তু কারয়েদ্দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা। দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা॥’" অনুবাদ - শূদ্র ভক্তাচ্ছাদনাদি দ্বারা প্রতিপালিত হউক বা না হউক, উহাকে দাস্য করাইবেন, যেহেতু, বিধাতা দাস্যকর্ম নির্ব্বাহার্থে উহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন। (শ্লোক নাং ৮/৪১৩, প্রাগুক্ত পৃষ্ঠা ৭৫১) উপনিষদের উত্তরসূরী বেদাঙ্গের একটি অন্যতম ভাগ হল গৃহ্যসূত্র। ওই গৃহ্যসূত্র প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে 'প্রাচীন ভারত' প্রবন্ধে সুকুমারী ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, "শূদ্রের কোনও গৃহত্যাগ (দশকর্ম) নেই; তার উপনয়ন নেই, অর্থাৎ বেদপাঠ নেই। বেদ যদি সে কানেও শোনে তাহলে সীসে গলিয়ে তার কানে ঢেলে দিতে হবে, বেদ উচ্চারণ করলে তার জিভ টেনে ছিড়ে ফেলতে হবে।" (পৃষ্ঠা ২৯, প্রবন্ধ সমগ্র ১ম খণ্ড, সুকুমারী ভট্টাচার্য, গাংচিল) অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে সুকুমারী বলেছেন, আরও বলেছেন, "একটি জায়গায় পড়ি, কেউ যদি বেশি খরচের যজ্ঞ শুরু করার পর দেখে তার অর্থে কুলোচ্ছে না তখন সে অনায়াসে শূদ্রের ধন কেড়ে নিতে পারে, এতে কোনও পাপ হয় না। অন্য এক জায়গায় শুনি, শূদ্রের স্ত্রীকে অন্য বর্গের পুরুষ যথেচ্ছ ভোগ করতে পারে।’ এই সব শাস্ত্রই তখনকার আইন এবং এ আইনে শূদ্র ও নারীকে মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৯) সমসাময়িক 'গৌতম ধর্মসূত্র' (১০/৫৪-৫৭) থেকে উদাহরণ দিয়ে রামশরণ শর্মা দেখিয়েছেন, "এই যুগের ধর্মসূত্রে সুস্পষ্টভাবে এবং জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে শূদ্রদের কর্তব্য হল উচ্চতর তিন বর্ণের সেবা করা এবং এইভাবেই আশ্রিতদের ভরনপোষণ করা।" (পৃষ্ঠা ৯২, প্রাচীন ভারতে শূদ্র, রামশরণ শর্না, কে পি বাগচি এ্যান্ড কোং) গৌতমের ধর্মসূত্রের ১০/৫৯ সূত্রে বিধান আছে - 'শূদ্রভৃত্যরা খাবে উচ্ছিষ্ট।' উত্তরাধিকার বিধিতে শূদ্রার পুত্রের ভাগ সম্বন্ধে বৈষম্যমূলক নিদর্শন তুলে ধরেছেন রামশরণ বৌধায়ন ধর্মসূত্রের ২/২/৩/১০ সূত্র থেকে। "বৌধায়নের মতে, বিভিন্ন বর্ণের স্ত্রী-জাত সন্তানদের ক্ষেত্রে চারভাগ পাবেন ব্রাহ্মণ, তিনভাগ ক্ষত্রিয়, দুভাগ বৈশ্য, একভাগ শূদ্র পুত্র। ঐ ধরণের একটি ক্ষেত্রে বশিষ্ঠ শূদ্রাপুত্রাকে বাদ দিয়ে কেবল উচ্চতর তিন বর্ণের পুত্রদেরই ভাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন (বশিষ্ঠ ধ সূ ১৮/৪৭-৫০)।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১০৬) ব্যভিচার ঘটিত বিধানে শূদ্রদের জন্য কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা আছে। অপস্তম্ব ধর্মসূত্রের ২/১০/২৭/৮-৯ সূত্র উদ্ধৃত করে রামশরণ দেখিয়েছেন, "আপস্তম্বের বিধান অনুযায়ী কোনো শূদ্র যদি আর্য‍া, অর্থাৎ প্রথম তিন বর্ণের রমণীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হন তাহলে তাকে বধ করা হবে। ...... কিন্তু ঐ একই লেখক বলেছেন যে, কোনো আর্য যদি শূদ্রার সঙ্গে একই অপরাধে লিপ্ত হন তবে তাকে নির্বাসিত করা হবে।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ‍১১২) ধর্মসূত্রের ১২/৪-৬ সূত্রে গৌতম স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেছেন, "বেদ উচ্চারণ করলে শূদ্রের জিহ্বাচ্ছেদ করা হবে, এবং সেই মন্ত্র স্মরণ রাখলে তার দেহ করা হবে দ্বিখণ্ডিত।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১২৩) 'সংস্কৃত সাহিত্যে শূদ্র ও নারীর চিত্র : পঞ্চম থেকে একাদশ শতক' শীর্ষক প্রবন্ধে সুকুমারী ভট্টাচার্য স্পষ্টভাবেই লিখেছেন, "গুপ্ত সাম্রাজ্যের কালে মনুসংহিতার অনুশাসনই অলঙ্ঘ ছিল।" (পৃষ্ঠা ৪৩৪, প্রবন্ধ সমগ্র ২য় খণ্ড, সুকুমারী ভট্টাচার্য, গাংচিল) নিজের বক্তব্যের সাপেক্ষে সুকুমারী কালিদাসের 'রঘুবংশ' থেকে কয়েকটি শ্লোকের উল্লেখ করেছেন। সপ্তম শতকে রচিত বাণভট্টের 'হর্ষচরিত'-এও "চিরদরিদ্র শূদ্র তার দারিদ্র্য, শ্রম আর বঞ্চনা নিয়ে উপস্থিত।" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩৬) সুকুমারীর মতে, অষ্টম শতকে ভবভুতির 'উত্তররামচরিত' এবং নবম শতকে ক্ষেমেন্দ্রের 'দশাবতারচরিত' কাব্যেও একইভাবে সমাজে শূদ্রের অসহায় অবস্থার প্রতিফলন ঘটেছে। সুকুমারী একাদশ শতকে রচিত কলহনের 'রাজতরঙ্গিনী' প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছেন, "রাজপ্রাসাদে আগুন লাগল, কলহনের মন্তব্য : 'ডোমচন্ডালের সংসর্গে দুষিত রাজাদের পাপ পুড়ে গেল।' (৬/১৯২)" (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৪৩৯) গুপ্তযুগ ও এর পরবর্তী মুহূর্ত থেকে শূদ্রদের সামাজিক অবস্থানের বা মর্যাদার কিছু উন্নতি অবশ্যই লক্ষনীয়। বর্ণগত বিধিনিষেধের কাঠিন্য লঘু করা হয় ও শূদ্রদের বিরুদ্ধে অনেকটা সামাজিক নির্মম প্রথা লাঘব করা হয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours