দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম: আকাশে ছিটে ফোঁটা মেঘের চিহ্ন নেই! বৃষ্টিই তো নাই! এদিন রামপুরহাটের ভাঁড়শালাপাড়ায় এক সবজি বিক্রেতার দোকান থেকে সবজি কেনার পর ছাতাটা দোকানে রেখেই, যেই না এক ক্রেতা এগিয়েছেন—দাদা, বর্ষার ছাতা ফেলবেন না! দোকানদার এগিয়ে দিলেন, ক্রেতা হাত বাড়িয়ে নিলেন। আর আক্ষেপে বললেন, এক সময় পড়েছি- কালিদাস রায়ের লেখা--‘বর্ষাসাথী আমার ছাতি আজকে তুমি নাই, যাচ্ছে ফাটি বুকের ছাতি তোমার শোকে ভাই’। ছিঁটেফোটা বৃষ্টি নেই, তো আবার ছত্রবিয়োগ!
ক্রেতা হসপিটাল পাড়ার বাসিন্দা চাঁদ মণ্ডল। তাঁর হাতেও ছিল এক ছেঁড়া ছাতা। বাজার সেরে পায়ে পায়ে ছাতা সারাতে এসেছেন রামপুরহাটের ভাঁড়শালাপাড়া মোড়ের এক গলিতে। সেখানেই বসেন বছর পঞ্চাশের ছোটকা মুনসরি। বাড়ি রেলপাড় লোকোপাড়া।
রামপুরহাট পুরসভার-১ নং ওয়ার্ডে বাড়ি। ২৫ বছর ধরে ভাঁড়াশালার এই গলিতে ছাতা সারাইয়ের কাজ করেন। ছাতার সামগ্রী স্থানীয় দোকান থেকে কেনেন। বর্ষার একমাস আগে ছাতা সারাইয়ের কাজ শুরু করেন। কোনদিন ৬০ টাকা, কোনদিন ৭০ টাকা, আবার কোনদিন কোন আয় হয় না। দুদিন আগে আড়াইশো টাকার কাজ হয়। তার মধ্যে ৫০ টাকা ছাতা সাড়ানোর সামগ্রীর খরচ বাদে, হাতে ২০০ টাকা থাকে। সেটা অবশ্য ওই একদিনই হয়েছে। ছোটকা মুসসুরি জানান, এবার বৃষ্টি না হওয়ায় বাজার খুব খারাপ। আষাঢ পেরিয়ে গেল। শ্রাবন চলে এল। বৃষ্টি কই? এবার জিনিসের দাম বাড়বে। আর এই অনাবৃষ্টির কারণে গৃহস্থের বাড়ির ছাতা তোলায় আছে। এখন তো আগের মত বেতের ঢাউস ছাতা আর পাওয়া যায় না। যে ছাতা মাথায় নিয়ে রাস্তায় চললে, কে আসছে সেটা দেখা যেত না। এখন ফেন্সি ছাতা। টেকেও কম। তবে ইতিমধ্যে কেউ কেউ বর্ষার ছাতির ছেঁড়া ফাটা বা ঘোড়া সব সারিয়ে নিয়েছেন। যারা ছাতা হারিয়েছেন এখনও কিনে ফেলেন নাই। সবাই যেন চাতকের মত ফটিক জল ফটিক জল করছে। চাষিদের মাথায় হাত। আর সেই সাথে মাথায় হাত ছোটকা মুনসুরির মত মানুষের! মনসুরি মূলতঃ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ভূক্ত। গ্রীষ্মের দুপুরে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে খোলামাঠে এদের ধুনুরি হাতে লেপ বানাতে দেখা যায়। শীতের লেপ এরাই অর্ডারমাফিক দোকানে ও বাড়িতে সরবরাহ করে থাকে। নুন আনতে পানতা ফুরায় এই পরিবারের। এক কথায় অভাবের সংসার। পরিবারে মোট সাত জন সদস্য। তিনটি মেয়ে। রামপুরহাটের হাজী মৌলা বক্স মাদ্রাসায় বড় মেয়ে পড়ে। এক ছেলে হোসেন মুনসুরি। ভারীর কাজ করে। বাড়ি বাড়ি জল সরবরাহ করে। তাতে যা আয় হয়, সংসারের সাশ্রয়। সম্প্রতি সরকারি প্রকল্পের আওতায় বাড়ি পাওয়ার কাগজ হাতে পেয়েছেন। তাই মনে একটু নিশ্চিন্ত ভাব। দুটাকা কেজি চাল পান। তাতেই ভাতের জোগার হয় কিছুটা। বড় ছেলে কাজ করতে পারলেও, ছোট ছেলে সুলতান মুনসুরি দুই চোখে অন্ধ। জন্ম থেকে একটা চোখ অন্ধ ছিল। পরে আরেকটাও পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়। তার প্রতিবন্ধী কার্ড আছে।
তবে এখনও ভাতা পাওয়া যায় নি। ছাতা সারাতে সারাতে খদ্দেরের সাথে গল্প করে সময় কাটতো তাঁর। এখন সেটাও কাটে না! আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে আছে – মন বলছে ফটিক জল!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours