fiture
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা:

'ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে দেখে নেব।'
হুমকি দেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান।
'আমরাও কি হাতে চুড়ি পরে বসে আছি নাকি?'
পাল্টা হুমকি দেন রাজ্যের বিরোধী শিবিরের সভাপতি।

হুমকি, পাল্টা হুমকিতে গরম বাংলার রাজ্য রাজনীতি। টিভিতে এসব দেখেশুনে ভীষন ভয় পেয়ে যায় এক কিশোরী। কেমন কুঁকড়ে যায় যেন!

এ কিশোরী জয় গোস্বামীর 'মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয়'- এর ছাত্রী না। রাজ্যের এক শিল্পশহরের নামকরা ইংরেজি স্কুলের ছাত্রী। ক্লাস নাইন। 
দিন পাল্টেছে। বেনীমাধবকে বুঝে ওঠাটা এখন আর তেমন ফ্যাক্টর করে না। বরং নিজেদের কেরিয়ার নিয়ে এই প্রজন্ম বেশ ব্যস্ত। গ্লোবাল ভিলেজ। স্কুলেই কম্পিউটরে হাতেখড়ি। মাউজে হাত রাখলেই হলো। গোটা দুনিয়া হাতের মুঠোয়। এখনতো আবার একটা স্মার্ট ফোন থাকলেই হলো। কিশোরীমন তখন সবে দুনিয়াটাকে বুঝে উঠতে চাইছে।

কিন্তু তার আগেই আরেক ঘটনা গভীর ছাপ ফেলে গেছে কিশোরীর মনে। তার নিজের শহরেরই ওই ঘটনায় কেঁপে উঠেছিল সে। তখন অবশ্য কিশোরী নেহাতই শিশু। ঘটনাও তার নিজের স্কুলের না। সেই শহরেরই, অন্য আর এক স্কুলের। তবে ছোট শহরে যা হয়, কোনও ঘটনা ঘটলেই সেটা চাউর হতে বেশি দেরি লাগে না।

সারা শহর তোলপাড়।
নামকরা এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। 
তেমনই নামডাক সেই স্কুলের হেড মিস্ট্রেসের। একাই থাকতেন। পরপর দুটো শিশু পরিচারিকা মারা গেল তাঁর ঘরে। জনরব, হেড মিস্ট্রেসের অত্যাচারেই মারা গেছিল ওই দুই শিশু। প্রায় রোজ রাতেই সেই শিক্ষিকার বাড়ি থেকে চেঁচামেচি, আর্তনাদ, কান্নাকাটির আওয়াজ পেতেন পড়শিরা। কিন্তু তাঁর ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি। সেই ভয়ে কেউ তাঁকে ঘাঁটাতে সাহস পেতেন না। 
ছিলো আরও এক ব্যাপার। পড়শিদের অনেকেরই সন্তান ওই স্কুলেই পড়াশোনা করতো। তাই কেউই হেড মিস্ট্রেসের কোপে পড়তে চাইতেন না। পাছে তার আঁচ পড়ে সন্তানের ওপরে।

তবু শান্তিপ্রিয় সজ্জন পড়শিদের মধ্যে দু- একজন একটু বেয়াড়া নাগরিক থেকেই যান। তাঁদের মধ্যেই হয়ত কেউ পুলিশে খবর দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই যে বললাম, শিক্ষিকার সাঙ্ঘাতিক প্রতিপত্তি। দু চারদিন শিক্ষিকার বাড়িতে পুলিশের আনাগোনা। শিক্ষিকাকেও কোর্টে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছিল। ব্যাস, তারপরেই স্থিতাবস্থা। স্কুলে যাদের সন্তানরা পড়ত সেই মা বাবারা সন্তানদের সাবধান করে দিয়েছিলেন, হেড মিস্ট্রেসকে সামলে চলতে।

মুশকিল হলো তিন নাম্বার শিশু পরিচারিকা মারা যেতেই। খেপে গেলেন পড়শিরা। স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরাও ফেটে পড়লেন ক্ষোভে। দাবি জানালেন, ওই হেড মিস্ট্রেসকে কোনমতেই স্কুলে রাখা চলবে না। শেষ পর্যন্ত পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেন দাপুটে শিক্ষিকা। রেসিগনেশন দিলেন চাকরিতে। 

সবকথা কানে এসেছিলো সেদিনের, সেই প্রাক কিশোরীর। আর সেই সঙ্গে মনে ভর করেছিলো এক ভীতি। হেড মিস্ট্রেস মানেই যেন সাক্ষাৎ এক আতঙ্ক। তার নিজের স্কুলের হেড মিস্ট্রেসও সেই আতঙ্কের গন্ডি থেকে বাইরে থাকেনি। সেদিন থেকেই যেন স্কুলে যাওয়ার মজাটাই উবে গেছিল। ভয়ে ভয়ে স্কুল যাওয়া শুরু হয়েছিলো সেই প্রাক কিশোরীর। সে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। কিশোরী আজ অনেক স্বাভাবিক। তবে সেদিনের ওই ঘটনা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিল, তার শিশুমনের স্বপ্নের দুনিয়াটা। 

সুযোগ পেলেই সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটা নিজেদের বাড়ির কোনও এক ঘরকে নিজের ক্লাসরুম বানিয়ে ফেলতো। দেওয়াল হতো তার ব্ল্যাকবোর্ড। হাতে একটা বই ধরে সে হতো শিক্ষিকা। মা কখনও বাবা, হতো তার ছাত্র ছাত্রী। তারাও উৎসাহ দিত মেয়েকে। হোক, শিক্ষিকাই হোক মেয়ে। নির্ঝঞ্ঝাট পেশা। নিরাপদ, সম্মানের চাকরি। আর হেলথ অ্যান্ড এডুকেশন ইনডাসট্রির বাজার সর্বত্রই রমরমা।

হেড মিস্ট্রেসের পরিচারিকা খুনের কথা শোনার পর থেকেই, সেই ছোট্ট শিক্ষিকার ক্লাস গেছিল বন্ধ হয়ে। তাকে আর কোনদিন ক্লাস নিতে দেখা যায়নি। এমনকি মা বাবার বলাতেও, সে আর 'স্কুল স্কুল' খেলেনি। উল্টে হেড মিস্ট্রেসের নাম শুনলেই সে আঁতকে উঠতো। 

তার নিজের স্কুলের হেড মিস্ট্রেস কিন্তু বেশ নরম- তরম এক মহিলা। তাঁর মেয়ের সঙ্গেও বেশ খাতির কিশোরীর। দুজনেই ক্লাসে পাশাপাশি বসে। দুই বন্ধু। কিশোরী একদিন বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে বসেছিল- হ্যাঁরে তোর মাম্মিকে তুই খুব ভয় পাস?
আসলে দুনিয়ার সব হেড মিস্ট্রেসরাই তখন চলে এসছে, কিশোরীর সন্দেহের বৃত্তে।

মেয়েবেলা থেকেই মনে গেড়ে বসেছিল হেড মিস্ট্রেস ভীতি। কিশোরী বয়সে তাতে যোগ হলো রাজ্য- রাজনীতির ভীতি। টিভি, পেপার, ইন্টারনেটে চোখ রাখলেই হলো! পচে গলে যাওয়া এক সমাজ ব্যবস্থার স্পষ্ট ছবি। কোথাও ধর্ষন তো কোথাও মনুয়া হত্যাকান্ড। রাজনৈতিক খুনোখুনি। ক্ষমতাশিকারী শকুনেরা চক্কর মারে আকাশে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। খুনের পর খুন। পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ। কিশোরী মন চুপসে যায় হিংসার ছবি দেখে। পালাই পালাই করে। কিন্তু কোথায়? কিভাবে?

মনের ভেতর গুমরে মরে কিশোরী। সমাজ, রাজনীতি নিয়ে তখনও কোনও স্পষ্ট ধারনা জন্মায়নি নেহাতই কিশোরীমনে। তখন শুধুই আতঙ্ক। তার হাবভাবে বেশকিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করেন মা- বাবা। কপালে ভাঁজ পড়ে তাঁদেরও। মেয়ের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু এরপর কী? তাঁরা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না, কিভাবে মেয়ের ভীতি কাটানো যায়।

গুগল সহায়। পড়াশোনার জন্য নেট ঘাঁটার অভ্যাস ছিলোই। কিশোরীর সন্ধান শুরু হলো অন্য এক দুনিয়ার। যেখানে খুন জখম রাহাজানির ভয় নেই। কেউ কাউকে হুমকি দেয় না। কোনও হেড মিস্ট্রেসের বাড়িতে পরিচারিকা খুন হয়ে যায় না।

ডেনমার্ক।
মঙ্গলগ্রহে না। পৃথিবী নামের এই গ্রহেরই এক দেশ। লাফিয়ে ওঠে কিশোরী তার স্বপ্নের দেশের সন্ধান পেয়ে। উত্তর ইউরোপের ছোট্ট এক দেশ। মাত্র আটান্ন লক্ষ মানুষের বাস।
'ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল' নামের এক সংস্থা বিশ্বজুড়ে এক সমীক্ষা করে। সমীক্ষা শেষে তৈরি হয় এক তালিকা- করাপশন পারসেপশনস ইনডেক্স। সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত সভ্য দেশেটির জন্য মোট বরাদ্দ একশো নাম্বার। সেই ইনডেক্সের সেরা দেশটার নাম ডেনমার্ক। তার প্রাপ্ত নাম্বার অষ্টআশি। 

এরপরেই মাত্র এক নাম্বারে পিছিয়ে থাকা দ্বিতীয় দেশ নিউজিল্যান্ড। মোট পঁচাশি নাম্বার পেয়ে ফিনল্যান্ডের জায়গা তিনে। অগত্যা, বাংলার জল হাওয়াতে বেড়ে ওঠা কিশোরীর কাছে ব্রাত্য হয়ে গেল তার নিজের দেশ। আর হবেই বা না কেন? ওই ইনডেক্সে ভারতকে খুঁজে পাওয়াটা বেশ ঝকমারি ব্যাপার। সে সটান নেমে এসছে আটাত্তর নাম্বারে। প্রাপ্ত নাম্বার মাত্র একচল্লিশ। আপনি যতোই শোনান না কেন, আমার সোনার বাংলা! অথবা, ভারত আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে, কিশোরীর কিছু আসে যায় না। 
ভবি ভোলার নয়।

তবে আপনি হয়তো এরপরেই জানতে চাইবেন পাকিস্তানের জায়গাটা কোথায়? একশো সতেরোতে। মাত্র তেত্রিশ নাম্বার পেয়ে। আরেক প্রতিবেশি চীন। সেও খুব একটা ভদ্রস্থ জায়গায় নেই। উনচল্লিশ নাম্বার পেয়ে সে সাতাশি নাম্বারে। কিশোরীও জেনে ফেলেছে এসব কথা। আর সবকিছু দেখেশুনে সেরেফ ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে কিশোরী। আজ তার  ধ্যান- ধারনা জুড়ে শুধুই ডেনমার্ক।

এরপরেই দ্বিতীয় পর্ব। ডেনমার্কে পৌঁছনোর সহজতম রাস্তার সন্ধান। সেখানেও সহায় ইন্টারনেট, গুগল। দেখা গেল ওই দেশে সবচেয়ে বেশি চাহিদা আইটি'র। তারপর চিকিৎসক আর প্রাইমারি, সেকেন্ডারি টিচার। টিচারতো আগেই খারিজ হয়ে গেছে। এঞ্জিনিয়ারিং ব্যাপারটা আবার কিশোরীর ঠিক পছন্দ নয়। তাই হাতে রইলো পেন্সিলের মতো অবস্থা। মেডিক্যালই টার্গেট।

প্রশ্ন অন্যখানে। 
এ কোন দেশ? কেমনতরো সমাজব্যবস্থা! কোন রাজনীতি? এক পক্ষ উন্নয়ন ফাটিয়ে চলেছেন। অন্যপক্ষ ডিজিটাল ইন্ডিয়া। দুয়ে মিলে অবস্থাটা শাঁখের করাতের মতো হয়ে দাঁড়ায়নি তো? নইলে এই দেশেরই এক কিশোরী, এই দেশ থেকে সমানে পালানোর চেষ্টা করে চলেছে কেন? কিসের আতঙ্ক তাকে তাড়া করে বেড়ায়?

এ মুহূর্তে ঠিক কতজন কিশোরী এরকম ভেবে চলেছেন, তার খবর কেই বা রাখে? বেনীমাধবের কথা না ভেবে, তারা ভেবে চলেছে নিজেদের ভবিষ্যতের কথা। তাদের স্বপ্ন সন্ধানের মতো কোনও পরিবেশই আজও সৃষ্টি করতে পারেনি মহামান্য সরকার বাহাদুর। এ লজ্জা আমার। আপনারও।
 
 
Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours