fiture
অনুপ চক্রবর্তী, নাট্যকার, কলকাতা: সেটা ছিল পুরাকালের এক বসন্তের এক অপরাহ্নবেলা। গাছে গাছে সোনালী রোদমাখা রাশি রাশি প্রেমিক সবুজ পাতার হাতছানি। পাতার ফাঁকে ফাঁকে পরভৃতের মধুর কূজন। নানা রঙের কত ফুলের উপছে পড়া হাসি। প্রেমিকের হৃদয় আকুল করা মলয় পবন। এক বিখ্যাত প্রাচীন নগরীর রাজপথ দিয়ে অষ্টচক্রবিশিষ্ট ও সুসজ্জিত এক বিশাল উন্মুক্ত গোশকটে আরোহণ করে বশিষ্ঠ,বিশ্বামিত্র,ভরদ্বাজ,পরাশর,কণ্ডু,প্রমতি,জাবালি ইত্যাদি বেশ কয়েকজন পক্ককেশবিশিষ্ট প্রবীণ অথচ বলশালী ঋষি গমন করছিলেন। শকট চলাকালীন কোন এক সময়ে পথপার্শ্ব থেকে দুই উচ্ছল তরুণ ও তরুণী শ্লথগতিসম্পন্ন ঐ শকটে আরোহণ করল। ঋষিরা তির্যক দৃষ্টিতে তা লক্ষ্য করলেন। তারপর তাঁরা শাস্ত্র ও যজ্ঞসম্পর্কীয় চিন্তায় নিমগ্ন হলেন। হঠাৎ তাঁরা লক্ষ্য করলেন যে ঐ দুই তরুণ ও তরুণী ভাবে বিহ্বল হয়ে পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে আছে। জাবালি ব্যতীত অন্যান্য ঋষিরা তা দর্শন করে অতীব রোষাবিষ্ট হয়ে গর্জন করে তাদের বললেন, ‘তোমরা এসব কী করছ!’ ওরা বিস্ময়াবিষ্ট হয়ে প্রত্যুত্তর করল, ‘আমরা কী করছি?’ কুপিত ঋষিরা আরো গর্জন করে বললেন ‘তোমরা আবার তর্ক করছ? অর্বাচীন, লজ্জাহীন, অসভ্য! তোমাদের স্পর্ধা তো কম নয়। এই সনাতন দেশে প্রকাশ্যে আমাদের মতো প্রবীণ মুনি, ঋষিদের সামনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আছ ! এইভাবে অন্যায় ও অপরাধ করছ!’ অতি বিনয়ী ঐ তরুণ ও তরুণী নির্ভীক, নিষ্কম্প অথচ মৃদুস্বরে স্মিতমুখে বলল, ‘এতে কী অন্যায় বা অপরাধ হয়েছে? আমরা পরস্পরের প্রেমিক। আমরা পরস্পরকে আমাদের হৃদয় দিয়েছি । আমরা পরস্পরকে গভীরভাবে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসি। তাই পরস্পরকে আলিঙ্গন করে আছি। আপনারা কি প্রেম বা ভালবাসা বিষয়টি সম্পর্কে কিছু জানেন না? ভালবাসা শব্দটার সঙ্গে আপনারা পরিচিত নন?’ । তখন ঋষিরা আরো প্রবল ক্রুদ্ধ হয়ে ভয়ংকর গর্জন করে ওদের ও ওদের পিতামাতাদের উদ্দেশ্যে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি দিতে থাকলেন। এইসব লক্ষ্য করতে করতে জাবালি কৌতুকের সঙ্গে প্রেমিক যুগলকে বললেন, ‘ওহে তরুণ ও তরুণী! এই ঋষিরা তো আর তোমাদের মতো তরুণ নন।
তাই হৃদয় বা ভালবাসা বিষয়গুলি বা শব্দগুলি উপলব্ধি বা অনুভব করতে পারবেন না।’ তখন ঋষিরা জাবালির ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে বেদবিরোধী, পাষণ্ড ,নাস্তিক বলে গালাগালি দিতে থাকলেন ও প্রচণ্ড ক্রোধে ঐ তরুণ ও তরুণীকে শকট থেকে বলপ্রয়োগ করে অবতরণ করিয়ে তাদের ভয়ংকরভাবে প্রহার করতে লাগলেন। ভয়ানকভাবে আহত ও রক্তাক্ত ঐ প্রেমিকযুগল অশ্রুভেজা চোখে প্রতিবাদ করতে করতে বলল, “ আমরা পরস্পরকে ভালবাসি বলে আলিঙ্গন করেছি। আপনারা বলছেন যে আমরা অন্যায় করেছি। আর আপনারা যেসব ঋষি গোপনে অপ্সরাদের বিন্দুমাত্র ভাল না বেসে শুধু তাদের দেহকে উপভোগ করে নিজেদের কামনা চরিতার্থ করেন ও তাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করে নিজেদের ঔরসজাত সেসব সন্তানদের পরিত্যাগ করেন সেসব কর্ম কি ন্যায় কর্ম? ঐ যে পরাশর মুনি কুমারী সত্যবতীকে গোপনে ভোগ করে তাঁর গর্ভে ব্যাসদেবের জন্ম দিয়ে তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন, ঐ যে ভরদ্বাজ মুনি,বশিষ্ঠ মুনি, প্রমতি মুনি,কুশানভ মুনি অপ্সরা ঘৃতাচীকে গোপনে ভোগ করে তাঁর গর্ভে দ্রোণ,কপিঞ্জল,রুরু ও বহু কন্যা সন্তানের উৎপাদন করে তাঁদের পরিত্যাগ করেছেন,ঐ যে বিশ্বামিত্র মুনি অপ্সরা মেনকাকে ভোগ করে তাঁর গর্ভে কন্যা শকুন্তলার জন্ম দিয়ে তাঁকে পরিত্যাগ করেছেন, ঐ যে কণ্ডু মুনি অপ্সরা প্রম্লোচ্চাকে ভোগ করে তাঁর গর্ভে কন্যা মারিষার এবং জাবালি ঋষি অপ্সরা রম্ভাকে ভোগ করে তাঁর গর্ভে কন্যা ফলবতীর জন্ম দিয়েছেন ---- এইসব প্রেমহীন যৌন উপভোগ কি এই সনাতন দেশে ন্যায় কর্ম? আর অবশিষ্ট যেসব ঋষি তাঁদের পত্নীদের সঙ্গে শয়নকক্ষে মিলিত হন তাঁদের হয়ত প্রকাশ্যে আপন পত্নীর সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই। 
আমরা সদ্যযৌবনপ্রাপ্ত দুই অসহায় প্রেমিক হৃদয়। আমরা কী এমন অপরাধ করেছি? আমাদের কি ভালবাসবার অধিকার নেই? ভালবাসা কি অপরাধ? কেন আমাদের এইভাবে অপমানিত,লাঞ্ছিত,আহত,রক্তাক্ত করছেন?’
                                                                                              ...............ক্রমশ 



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours