রণজিৎ গুহ, প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী, লেখক ও সমাজকর্মী:
সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন সিন্ধু লিপি সম্ভবত মানব প্রজাতির অন্যতম প্রাচীন লিখন পদ্ধতি ।এযাবৎ এই লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়নি।অতি সম্প্রতি এক বাঙালি কন্যা বহতা মুখোপাধ্যায় এই লিপির পাঠোদ্ধার করার একটি যুক্তিসম্মত পদ্ধতির কথা এক আন্তর্জাতিক পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন।
প্রসঙ্গত আমাদের বাংলা লিপির উদ্ভব ও বিকাশের কথা আলোচনায় আসতেই পারে।একটি ভাষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল তার লিখিত রূপ থাকা।শুধুমাত্র কথ্য ভাষা কালের নিয়মে অতি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় না। কত বছর আগে বাংলা ভাষার লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে তা সঠিক ভাবে বলা মুস্কিল । গবেষকদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এটুকুই যে বাংলা লিপির উদ্ভব ব্রাহ্মী লিপি থেকে। কিন্তু ঠিক কত বছর আগে বাংলা লিপি আবিষ্কার হয়েছে এ নিয়ে নানা জনের নানা মত।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বাদ দিয়ে ভারতসহ দক্ষিণ এসিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ও মধ্য এসিয়ায় প্রায় সব কয়টি আধুনিক ভাষার লিপি বা বর্ণমালা ব্রাহ্মী লিপিরই অনুসারী। এই সুবিস্তৃত অঞ্চলের ১৯৮টি ভাষার বর্ণমালা ব্রাহ্মী লিপি থেকেই উদ্ভুত। তাই ব্রাহ্মী বিশ্বের সর্বাধিক প্রভাবক লিপি হিসেবে সমাদৃত। ব্রাহ্মী লিপির নিজস্ব সংখ্যা ব্যবস্থা আছে। সারা বিশ্বে ব্যবহৃত হচ্ছে যে ইন্দো-আরবী সংখ্যা পদ্ধতি তার সাথে এর সাযুজ্য আছে।
খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতক থেকে ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে ব্রাহ্মীলিপি প্রচলিত ছিলো। ব্রাহ্মীলিপি ক্রমে “অশোক লিপি” বা ” মৌর্য লিপি ” তে বিবর্তিত হয়। এর পরের ধাপ আসে কুষাণ রাজাদের আমলে ” কুষাণ লিপি”। পরবর্তিতে ব্রাহ্মীলিপি উত্তরী ও দক্ষিণী- এই দুইভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তরী ব্রাহ্মী লিপি গুপ্ত লিপি হিসাবে সমধিক পরিচিত হয়।এই গুপ্ত লিপি আবার পূর্বি ও পশ্চিমায় ভাগ হয়। অধিকাংশ লিপি গবেষকদের মতে গুপ্ত লিপির ক্রমবিবর্তনের ফলে সিদ্ধমাতৃকা লিপির উৎপত্তি হয়, যার কালক্রমিক পরিণতি থেকে বাংলা লিপি বর্তমান রূপ ধারণ করে। অনেকে অনুমান করেন ৪র্থ ও ৫ম শতাব্দীতে যে গুপ্তলিপির প্রচলন ছিলো।তা পরবর্তী বাংলা লিপির নিকটতম পূর্বসূরি। পরে আঞ্চলিক লিপিকারের হাতে ক্রমশ পরিবর্তনের মাধ্যমে বর্তমান রূপ লাভ করে এই বাংলা লিপি। বাংলা লিপির ব্যবহার মধ্যযুগীয় ভারতের পূর্বাঞ্চলে এবং তারপর পাল সাম্রাজ্যের মধ্যে ব্যবহার ছিল। পাল সাম্রাজ্যে নবম শতাব্দী নাগাদ বাংলা বর্ণমালা নাগরী লিপি প্রভাবিত হলেও একটা নিজস্ব স্পষ্ট চেহারা নেয়।গবেষকরা এটিকে প্রোটো বা প্রায় বাংলা বলে অভিহিত করেছেন। বাংলা লিপির বিবর্তনের চূড়ান্ত ধাপটি লক্ষ করা যায় এগারো ও বারো শতকে, যে সময়ে লিপি প্রোটো-বাংলা থেকে বাংলায় রূপান্তর ঘটেছে। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া তাম্রশাসনে বাংলা লিপির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। সুন্দরবন তাম্রলিপিটি (১১৯৬ খ্রি.) প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাংলা হরফে উৎকীর্ণ।
বাংলা লিপি বা বর্ণমালার সর্বশেষ রূপটি দেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়। ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃতের বেড়া ভেঙে বাংলা বর্ণমালার সংস্কার সাধন করেন।বাংলা গদ্যে প্রথম যতিচিহ্নের ও বিরামচিহ্নের প্রচলন করেন বিদ্যাসাগর। প্রাচীন কালে বাংলা গদ্য এবং পদ্যে বিরাম চিহ্ন ছিল কেবল মাত্র দুটি, এক দাঁড়ি (।), ও দুই দাঁড়ি (।।)। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ইংরেজি ভাষার অনুকরণে বিরাম চিহ্নগুলোর প্রচলন করেন বাংলা ভাষায়।
বাংলায় বিদ্যাসাগর 'য়' বর্ণ প্রচলন করেন। সংস্কৃত ভাষায় 'য়' বর্ণ নেই।
বাংলায় আগে 'য়' বর্ণ ছিল না। এটি ঈশ্বরচন্দ্রের আবিষ্কার। বিদ্যাসাগর 'য' বর্ণের নিচে বিন্দু বসিয়ে 'য়' বর্ণ প্রচলন করেন।বিদ্যাসাগর 'ড়' আর 'ঢ়' বর্ণ দুটিও প্রচলন করেন।।এর আগে এ ধ্বনিদুটোর উচ্চারণ ছিল না তখন শব্দের মাঝে ও শেষে হলে 'ড' ও 'ঢ' লেখা হত। এছাড়া স্বরবর্ণে "দীর্ঘ-ৠ" এবং "দীর্ঘ-৯" ছিল। বিদ্যাসাগর এ দুটি বর্ণ বর্জন করেন।
বর্তমানে বাংলা লিপি ব্যবহৃত হয় বাংলা, মণিপুরি, ককবরক, অসমীয়া ভাষায়।
বাংলা লিপি বাংলাদেশ ও ভারতে সরকারী লিপি হিসাবে স্বীকৃত। প্রায় ৩০ কোটি মানুষ তাদের ভাষা ও সাহিত্য চর্চায় বাংলা লিপি ব্যবহার করেন।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours