marrage
সেঁজুতি ভট্টাচার্য, সমাজকর্মী, কলকাতাঃ (পুরাকালে বঙ্গদেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নামে এক সম্প্রদায় ছিল। সঙ্গতি অপেক্ষাও তাঁহারা প্রশ্ন তুলিতেন, কাজটি সঙ্গত কি না । পরিচয় দিতেন, সামাজিক দায়িত্ববোধের। অর্থবান বা সাধারণ রোজগারের মাপকাঠি এ বোধের নিয়ামক ছিল না।) কথায় বলে,লাখ কথা না হলে বিয়ে হয়না। এখন, কথা কত খরচহয় জানিনা, তবে মধ্যবিত্তের বিয়ের বাজেট হামেশাইপ্রায় কোটির কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। না, না, উত্তর বাপশ্চিম ভারত নয়, বাঙালির সাত পাকে বাঁধাও এখনচাঁদির জোরে ক্রমেই ঝলমলে, আর প্রদীপের নীচেঅন্ধকারের মতো চাপা পড়ে যাচ্ছে মধ্যবিত্ত বাঙালিরমূল্যবোধ আর সংস্কৃতি। উৎসবের মঞ্চকে আরওমহার্ঘ্য আরও সম্পন্ন করে তোলার এক প্রাণপণ প্রচেষ্টা আর মরণপণ প্রতি্যোগিতায় প্রমত্ত মধ্যবিত্! সাধপূরণের এই আকাশকুসুম ইচ্ছা বিকশিত হচ্ছে পরশ্রীকাতরতা আর অনুকরণের বিষবৃক্ষে।ভাড়াবাড়ি, ক্যাটারার, বুফে বা হালফিলের বিরিয়ানি-এসবই বিবর্তন এবং অনেক ক্ষেত্রেই লোকবলের অভাব পূরণ।কিন্তু বিয়েবাড়ি থেকে ‘ইভেন্ট’- এটা হল নিজেকে জাহির করার এক মরিয়া চেষ্টা—আরব্য রজনীর এক রাতের সুলতানি । যা হয় হোক, কেউ যেন আমাকে ‘পাতি মধ্যবিত্ত’ না ভাবে। 
বিবাহ বাসরের রূপবদলে সবিনয় আন্তরিকতা ছাপিয়ে বেশি চোখে পড়ে টাকা দেখানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। । চোখ ঝলসানো বিয়েবাড়ি, কত দামের শাড়ি, কোন জুয়েলারের গয়না, নামজাদা মেক-আপ আর্টিস্ট-এর সাজানো কনে, অথবা কোন ডিজাইনারের ডিজাইন করা পোশাক-এসবই এখন বিয়েবাড়ির হাইলাইটস।শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর ভাবতে চায় না, কাজটা সারা সমাজের পক্ষে কতটা সঙ্গত। টাকা খরচের কথা ভাবা তো দুরস্থান। আমরা হয় খুঁত ধরছি, অন্য কোন পড়শি বা বন্ধুর বিয়েতে আরও কতটা জাঁক হয়েছিল ! ভয়ে ভয়ে ভাবছি, এত কি আমি পারব ? অথবা, আমার বাড়ির রিশেপসানে যা করব,গেস্টরা মনে রাখবেন সারা জীবন ! ১৯ শতকের শেষে ক্ষয়িষ্ণু বাঙলির এই পতন ঠেকাতেই শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা প্রাচীরেরে মত তাঁদের সেই অমোঘ প্রশ্ন রেখেছিলেন– সঙ্গতি না সঙ্গত? আর ভাবনার কারনেই, এ দেশের মধ্যবিত্তরা সারা দেশের ভাবনার অগ্রদূত হয়ে উঠেছিলেন – হয়েছিলেন, আধুনিকতার পথিকৃত। অমিত রায়রা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন জীবনের ও সমাজের সহজ লাবণ্যকে।অনুকরণ নয়, অননুকরণীয়তাই ছিল এই প্রতিবাদের মূল কথা। নব্য বিবাহিতের সঙ্গে পরিচয় করানো এবং তাদের জন্য আশীর্ব্বাদ ও শুভেচ্ছা প্রার্থনাই তো বিয়ের অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্দেশ্য ...... এটাই তো ছিল মধ্যবিত্তের এই মাঙ্গলিক উৎসবের মূল সুর। অথচ কলুর বলদের মত অনুকরনের আবর্তে – এখন এ সব নেহাতই গৌণ ! ভাবলে বিস্ময় লাগে যে একটি জনগোষ্ঠীর কেউ ভাবছেন না, যে তাঁদের অনুকরণের মত্ততায় এবং চারপাশের মুঠির অহেতুক চাপে হীণমন্যতায় বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে সমাজের গরিষ্ঠাংশের জীবন! মধ্যবিত্ত বাঙালি চিরকালই নিজের সামর্থ্য এবং সীমার মধ্যে থাকার পক্ষে ছিল। ‘
ওসব বড়লোকেদের মানায়, আমাদের নয়’- একথা প্রায়ই বলতেন বাড়ির বড়রা। ছোটরাও সেইমতোই চলত।বড় হয়ে তাদের বিয়ের সময়েও বাবা-মার সামর্থ্য অনুযায়ীই ব্যবস্থা হত, তাই নিয়ে তাদের বিশেষ কোনও অভিযোগ বা আক্ষেপ ছিলনা। তাহলে? পুষ্পে কীট-এর মতো হয়তো তৃষ্ণা জেগে ছিল।তাই সেদিনের ছোটরা যত বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন, ততই সর্বতোভাবে এই মধ্যবিত্তের ঘেরাটোপ থেকে বেরোতে চেয়েছেন।অর্থাৎ, আমাদের বাবা-মায়ের জীবন পাত করা মূল্যে আমরা কোনও জীবনবোধে পৌঁছলাম না, গেলাম না কোনও চর্চায় --- খুঁজে নিলাম অনুকরণের সহজ পথ ! ভুলে গেলাম, জীবনের গুপ্তধনের সেই সহজ দিশা—তৃষ্ণা দূর কর ! আর ধীরে ধীরে অনাড়ম্বর সরল জীবনের পরিতৃপ্তির কথা ক্রমেই ভুলে গেলাম। টাকা খরচ এবং দেখানেপনাতেই শুকিয়ে গেল সকল রসের ধারা। বিয়েতে হাজারের কাছাকাছি অতিথি তালিকা, খাবারের মেনুতে স্ন্যাক্স, থাই ফুড, লেবানিজ, ইতালিয়ান বা মোগলাই খানা, কার্পেটে মোড়া এসি হল বা পেল্লাই লন কিংবা বিরাট মঞ্চে বসা বর-কনে, এসবের কোনওটাই তো মধ্যবিত্ত বাঙালির আদি অকৃত্রিম ‘বিয়েবাড়ি’তে ছিলনা-ওসব ছিল মুষ্ঠিমেয় কিছু বড়লোকের অনুষ্ঠান রীতি।এখন মধ্যবিত্ত বাঙালিপ্রাণপণ চাইছে ততটা না হোক, অন্তত কিছুটা... এ লেখা বিত্তশালীদের জন্য নয়। কিন্তু কম সঙ্গতির মানুষেরা কী করবেন? ক্রমাগত পাল্লা দিতে আর তাল রাখতে যে তাঁরা যে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন ! শুধু টাকায় নয়, ক্রমাগত ডুবে যাচ্ছেন হীনমণ্যতার অসহায় পাঁকে। 'সামান্য ক্ষতি' র কাশীর মহিষী করুণার এক প্রভাতের উৎসবে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে কত মানুষের কুটির বাঁধার মধুর বাসনা ! গ্লোবাল ভিলেজ কি এই চেতনাই দিল ? শুধুই ‘শো অফ’? কিন্তু কোন মূল্যে ? নতুন করে ভাবা দরকার। বিয়ের অনুষ্ঠান বা রীতির মধ্যে যে মাধুর্য ও পারস্পরিক আস্থা আর শ্রদ্ধার কথা রয়েছে, তাকে দূরে সরিয়ে দেখানেপনার আধিক্য আর প্রতিযোগিতায় মত্ত হয়ে ওঠা, মধ্যবিত্ত বাঙালির রুচি ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না । লাখ টাকার বাজি পোড়ানো এক রাতের কালীপুজোর আলোও ক্ষণস্থায়ী, এক রাতই। কারুর আঁধার পথে আলো হয়ে জ্বলে না---সে শুধু নিজেকে নয়, পুড়িয়ে দিচ্ছে আগামীকালের কালের চিন্তাকেও । 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours