Old temple
সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার কলকাতাঃ সভ‍্যতার শুরুর দিকে যখন বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি হয় নি , তখন বিভিন্ন রোগব‍্যাধির নিরাময়ের উপায় হিসেবে মানুষ বিভিন্ন দেবদেবীর শরণাগত হতো । এবং হয়তো মানুষের বিশ্বাসের জোরেই দেবদেবীরা ভক্তের কষ্ট নিরাময় করতে নিজেই ধরা দিতেন ভক্তের দ্বারে । মা শীতলাকে হাম , বসন্ত অর্থাৎ পক্স ইত‍্যাদি রোগের নিরাময়কারিণী রূপে পূজা করা হয় অনাদি কাল ধরেই । দক্ষিনেশ্বরে অধুনা ভট্টাচার্য পাড়ার শীতলাবাড়ির ইতিহাস ঘাঁটলে মা শীতলার এমনই রোমহর্ষক নানা ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায় । আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে , দক্ষিনেশ্বরের বুড়ো মা তলার রায় পরিবার সহ একাধিক পরিবার একবার ভয়াবহ বসন্তের প্রকোপে পড়ে । সেই সময়ে অধুনা শীতলা বাড়ির চট্টোপাধ‍্যায় পরিবারের বর্তমান প্রজন্মের আট প্রজন্ম আগের গৃহকর্তাকে মা শীতলা স্বয়ং স্বপ্ন দান করেন এবং কাশীর গঙ্গার ঘাট থেকে সেই বিগ্রহকে এনে প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেন । বলা বাহুল‍্য এই আদেশ পালন করতে সেই ভক্ত তিনমাস ধরে হেঁটে বিগ্রহকে এনে প্রতিষ্ঠা করেন । কিন্তু যে পরিবারে দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোটে না তারা ঠাকুরের নিত‍্যসেবা কেমন করে করবে ? এই চিন্তা গ্রাস করলো ব্রাহ্মণ , ব্রাহ্মণীকে । কথায় বলে , "চিনি যোগান চিন্তামনি" - এ প্রবাদকে নির্ভুল প্রমাণ করে মা সে রাত্রেই স্বপ্ন দিয়ে বললেন "কাল থেকে রোজ ঠাকুরঘর খোলার সময়ে কড়িকাঠ থেকে আমি একটি করে পয়সা ফেলবো । তোর আর অভাব থাকবে না । কিন্তু খবরদার , এই কথা যদি কাউকে বলেছিস তবে পয়সা ফেলা তৎক্ষনাৎ আমি বন্ধ করবো ।" এমনি করেই রোজ দেবী ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণীকে পয়সা দিতে লাগলেন । কিন্তু "সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে" যে রাতারাতি পয়সা কোথায় পাচ্ছেন এই গরীব দম্পতি ? পড়শিদের কৌতুহলের মুখে একদিন গোপন কথাটি বলেই ফেললেন ব্রাহ্মণী । পরের দিন থেকেই বন্ধ হয়ে গেল পয়সা পড়া , যদিও ততদিনে অবস্থা ফিরে গিয়েছে মায়ের কৃপায় । সেই থেকে জৈষ্ঠ‍্য মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া থেকে জামাই ষষ্ঠী পর্যন্ত নিয়ম ও নিষ্ঠা সহযোগে শীতলা পূজা হয়ে চলেছে এখনও । এই শীতলা পূজার অন‍্যতম আরেকটি আকর্ষণ হল পুতুল নাচ । এই পুতুল নাচের বিষয়টিও স্বপ্ন নির্দেশিত । নকশাল যুগে একবার আধুনিকমনস্ক মানুষের একটি দল পুতুল নাচের বদলে আধুনিক ভিডিওগ্রাফির পক্ষে তদ্বির করে এবং পুতুল নাচে বাধা দেয় । আশ্চর্যজনক ভাবে এই দলেরই একজন হঠাৎই মাথায় নারকেল গাছ পড়ে মারা যায় , এবং সে সময়ে আকাশে ঝড়ের কোন চিহ্ণও ছিল না । এরপর পুতুল নাচ আর কখনও বন্ধ হয় নি । মা শীতলার মূর্তিটি অষ্টধাতুর ।
নিত‍্যপুজোয় মাকে চিঁড়ে ফলার ভোগ দেওয়া হয় । উৎসবের সময়ে পাঁচদিনই পাঁঠাবলি দেওয়া হয় মায়ের চরণে । দূর্গাপুজার শেষে বিজয়ায় যেমন সিঁদুর খেলা , তেমনই শীতলাবাড়ির ঐতিহ‍্য 'কাদামাটি' । ষষ্ঠীর দিন অর্থাৎ উৎসবের শেষ দিনে হাঁড়িকাঠকে দই , ডাবের জল এবং হলুদ জল দিয়ে পূজা করে তুলে দেবার পর সেই পূজা প্রাঙ্গনে বাড়ির সকলে ছোট থেকে বড় নির্বিশেষে কাদামাটি খেলায় মেতে ওঠে । শীতলা মায়ের নানান অলৌকিক লীলার কথা আজও ভেসে বেড়ায় শীতলাবাড়ির বাতাসে । শোনা যায় কোন এক গ্রীষ্মের দুপুরে সেই পরিবারেরই এক নতুন বউ তার শিশু সন্তানটিকে শুইয়ে রেখেছিলেন ঠাকুরঘরের চৌকাঠে , মায়ের যাত্রাপথে । সে সময়ে বসন্ত রোগ নিরাময়ের জন‍্য আর্তের ঘরে যেতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হন দেবী । কুপিত হয়ে সেই শিশুকে তখনই ছুঁড়ে ফেলেন তিনি , তারপর বধূটি তার অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তার ক্রোধ প্রশমিত হয় এবং ঘরের চৌকাঠে কখনও শুতে নিষেধ করেন । বলা বাহুল‍্য সেই শিশুটির কোনরকম আঘাতই লাগে নি । এছাড়াও একবার এক ভক্তকে তিনি গভীর রাতে লাগোয়া পুকুরের ধারে একা আসার নির্দেশ দেন । মায়ের নির্দেশ না মেনে সেই ভক্ত অনেক লোকজন সহ সেই পুকুরের ধারে উপস্থিত হলে মা চরম কুপিত হয়ে সেই ভক্তকে আর দেখা দেন নি । এমনিভাবেই বহু লৌকিক অলৌকিক ঘটনার অধিকারিণী মা শীতলা প্রায় চারশো বছর ধরে অবস্থান করছেন শীতলাবাড়িতে , এবং এলাকার মানুষদের হাম , 
বসন্ত ইত‍্যাদি কঠিন অসুখ থেকে বাঁচানোর পাশাপাশি ভক্তদের রক্ষাও করে চলেছেন একজন প্রকৃত মায়ের মতো ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours