স্বরূপ গুপ্ত, লেখক, কোচবিহার:
টানা বৃষ্টি। জল থইথই চারধার। গাছের গা থেকে শুরু করে বাড়ির উঠোনে অবধি শ্যাওলার স্তর। রাতে তো বটেই, দিনেও মাঝেমাঝে ব্যাঙের ডাক। রাতে কাঁথা জড়িয়ে না শুলে রীতিমত ঠান্ডা লেগে যাওয়ার ভয়। দিনেরবেলায় কখনো বৃষ্টি থামলে, কালো মেঘের পুরু আস্তরণ সরে গেলে উত্তর আকাশে ঝকঝক করে দার্জিলিং বা ভুটান পাহাড়।
বর্ষা বলতে একটা সময় উত্তরবঙ্গবাসী এরকমটাই বুঝত। আজ থেকে দেড়-দুই দশক আগেও উত্তরের আকাশে বর্ষা এভাবেই ধরা দিত। কিন্তু উত্তরের বাস্তুতন্ত্র ইদানিং অনেকটাই পালটে গেছে। আর তার সঙ্গে বদলে যাচ্ছে এখানকার চিরচেনা পরিবেশ। সঙ্গে সোনায় সোহাগের মতো যোগ হয়েছে বিশ্ব-উষ্ণায়ণের অভিশাপ। সব মিলে, উত্তরবঙ্গের মনোরম আবহাওয়াতে আজ বিরাট রদবদল।
কিন্তু এরকমটা হওয়ার কারণ ঠিক কি?
কেন উত্তরবঙ্গেও গরমের এই প্রকট কিংবা বৃষ্টির জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা? কেনই বা উত্তরবঙ্গের বাস্তুতন্ত্রে এই রকমফের? কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদা জেলাকে যদি উত্তরবঙ্গের মধ্যে ধরি তবে কিন্তু এমনিতেই দেখা যায় যে মালদা বা দিনাজপুরের দুই জেলার সঙ্গে কোচবিহার বা আলিপুরদুয়ার বা জলপাইগুড়ির আবহাওয়ার যথেষ্ট অমিল রয়েছে। আবার হিমালয়ের কোলে বলে দার্জিলিং জেলার পার্বত্য এলাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার মিল খুঁজে পাওয়া যাওয়া না। দার্জিলিং শহরের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, এখানকার আবহাওয়া হয় raincoat অথবা overcoat....কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে যে, দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির তুলনায় এখানকার আবহাওয়া অনেক বেশি মনোরম- গরমের আধিক্য কম, বৃষ্টিপাত বেশি, শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়ে। কিন্তু বিগত ১৫/২০বছরের আবহাওয়া বলছে সেই চেনা উত্তরবঙ্গ আর নেই। 'সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট`-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল উত্তরবঙ্গ। এখানকার বিরাট অরণ্যভূমি শুধু উত্তরবঙ্গে নয়, উত্তর পেরিয়ে দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমেও তার সুফল প্রদান করত। ডুয়ার্সের দুর্ভেদ্য জঙ্গল ছাড়াও উত্তরে অরণ্যের অভাব ছিল না (ডুয়ার্স বলতে অবশ্য তিস্তা নদীর পূর্ব প্রান্ত থেকে সংকোশের পূর্ব তীরের বিস্তৃত ভূভাগকে বোঝাচ্ছি), কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সেই অরণ্যভূমির অনেকটাই আজ বিলুপ্ত। স্বাধীনতার আগে বানিয়া ইংরেজ শুধুমাত্র বক্সার অরণ্য নয়, বনজ সম্পদের লোভে লুঠ করেছে লাটাগুড়ি, চাপড়ামারি, মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে শুরু করে উত্তরের অনেক অরণ্যকেই। শাল, শিরীষ, সেগুন, চিকরাশি, গামার, চম্পা ইত্যাদি গাছ থেকে প্রাপ্ত লোভনীয় কাঠের লোভে, হাতির দাঁত বা গন্ডারের সিংয়ের মতো অমূল্য ও দুষ্প্রাপ্য সম্পদের জন্য তাদের দেখিয়ে যাওয়া পথে স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও কিন্তু এই লুণ্ঠন থামে নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দেশবিভাগের ফলে ক্রমশ বেড়েছে এদিককার জনপদ। ফলে অরণ্য সংকুচিত হয়েছে। আর কে না জানে যে, উন্নয়নের সঙ্গে প্রকৃতি-নিধনের একটি চিরকালীন দ্বন্দ রয়েছে। আর সেই দ্বন্দ্বের ফলেই, রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য যেমন কাটা পড়েছে শতাব্দীপ্রাচীন গাছ, তেমনি অরণ্যভূমির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথে কাটা পড়ছে নিরীহ বন্যপ্রাণী। তাই বলা যেতে পারে যে, চা-বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উত্তরে একদা যে বৃক্ষনিধন শুরু হয়েছিল, তা আজও রয়েছে। হয়তো গতি কমেছে, কিন্তু নিরাময় হয় নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, চিলাপাতার (জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের একটি অংশ) মতো দুর্ভেদ্য জঙ্গল আজ ফাঁকা। জঙ্গলে খাবার না পেয়ে প্রাণীরা হামলা করছে লোকালয়ে। বাড়ছে মানুষ-পশুর লড়াই। বিপন্ন হচ্ছে দুই প্রজাতিই। উত্তরের নদীগুলিও আজ সংকটের মুখে। জানা-অজানা ছোট-বড় নানা নদীর এই অঞ্চলে দিনদিন কমছে নদীগুলির নাব্যতা। ফল সহজেই অনুমেয়। ভাবতে খারাপ লাগে যে, জয়ন্তীর মতো নদীতে প্রতি বছর বন্যার আশংকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী গর্ভ থেকে পাথর তোলা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়াতে দিন দিন উঁচু হয়ে যাচ্ছে নদীর খাত। তাই একটু বৃষ্টিতেই সারা বছর তিরতির করে বয়ে চলা জয়ন্তী দু-কুল ছাপাচ্ছে। ভুগছে সাধারণ মানুষ। ১৯৯৩ সালের বন্যা এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে যে প্রবল অভিঘাত হেনেছিল তার ফলে অনেককিছু পালটে গেলেও উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে আচমকা বন্যা ক্ষতি করছে সবকিছুর। এই বছর কিছুদিন আগে একদিনে ৪০০মিমি বৃষ্টির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনার কাছে আমরা কতটা অসহায়। মজাটা হল যে, এই পরিস্থিতি হয়ত কখনোই হত না যদি আমরা পরিবেশকে রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন হতাম। উত্তরের নদীগুলি আজ সত্যিই রোগাক্রান্ত। চোখের সামনে থেকে প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে বালুরঘাটের আত্রেয়ী, শিলিগুড়ির মহানন্দা বা করতোয়া, জলপাইগুড়ির করলা-সহ একাধিক নদী। সারা বছর জল না থাকা এই নদীগুলি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে সামান্য বৃষ্টিতে। বিপদে ফেলতে পারে জনজীবনকে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের শহরগুলিও বদলেছে। কোচবিহার শহরের কথা ধরা যাক। পুরো শহরে রাস্তার ধারে পেভার্স ব্লক। মাটির চিহ্ন নেই। জল বাষ্পীভূত হতে না পারার ফলে শহরের তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান। রাস্তা সম্প্রসারণের ফলে কাটা পড়ছে অনেক গাছ। রাজ্-আমলের নিয়মকে তোয়াক্কা না করে বহুতলের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে (ভূমিকম্পপ্রবন এলাকা বলে অতীতে দ্বি-তলের বেশি দালানের অনুমতি দেওয়া হত না)। এই চিত্র শুধু কোচবিহারের নয়, উত্তরের যে কোনো শহরের দিকে তাকালেই কমবেশি এরকমটি দেখা যাবে। দাজিলিংয়ের কথা ভাবা যাক। পথের ধরে রডোড্রেনডন, ফরগেট-মি-নট ফুটে থাকা সেই দার্জিলিং আজ নেই। পাহাড়ের যেদিকেই তাকানো যাক দেখা যাবে যে, বাড়ির পর বাড়ি পাহাড়ের সবুজ ঢেকেছে। সেই শান্ত সৌন্দর্য্যের দার্জিলিঙেও হয়েছে অটোমোবাইলের প্রবল বৃদ্ধি।
ফলে পরিবেশের দফারফা হতে সময় বেশি লাগছে না। এক্ষেত্রে কাউকে দোষারোপ করাটা ঠিক হবে না, কেননা জীবন ও জীবিকার স্বার্থেই এই পরিবর্তন। কিন্তু খারাপ লাগে তখনই যখন জেনে বুঝেও পরিবেশের ক্ষতি করা হয়, পিকনিকের নামে জঙ্গলের ধারে প্রবল আওয়াজে মাইক্রোফোন বাজানো হয়, নদীর বুকে প্লাস্টিক ফেলা হয়, অরণ্য থেকে খাবারের সন্ধানে চলে আসা বন্যপ্রাণীকে পিটিয়ে মারা হয়। যে সচেতনতা আধুনিক সময়ের মানুষ হয়ে আমাদের সকলের দরকার ছিল তার প্রবল অভাব প্রমাণ করে যে, আমরা নামেই সভ্য হয়েছি, কাজে নয়। উত্তরের এই বদল আগামীতে ঘটতে চলা এক বিরাট সমস্যার অশনি সংকেত মাত্র। এর থেকে পরিত্রানের একটিই উপায় আর তা হল সচেতনতা বৃদ্ধি। মুশকিলটা হল, যদি বা সরকারি-বেসরকারি স্তরে কিছুটা চেষ্টা চালানো হচ্ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এর জন্য লাগবে মনের গভীর থেকে উঠে আসা এক প্রবল অনুভূতি যা একজনকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা বোধ করাবে। এই বোধ যতদিন না আসবে ততদিন বোধহয় প্রকৃতির এই নিধন চলতেই থাকবে। আর যত এই নিধন চলবে তত আমরা নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনব!
কেন উত্তরবঙ্গেও গরমের এই প্রকট কিংবা বৃষ্টির জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা? কেনই বা উত্তরবঙ্গের বাস্তুতন্ত্রে এই রকমফের? কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদা জেলাকে যদি উত্তরবঙ্গের মধ্যে ধরি তবে কিন্তু এমনিতেই দেখা যায় যে মালদা বা দিনাজপুরের দুই জেলার সঙ্গে কোচবিহার বা আলিপুরদুয়ার বা জলপাইগুড়ির আবহাওয়ার যথেষ্ট অমিল রয়েছে। আবার হিমালয়ের কোলে বলে দার্জিলিং জেলার পার্বত্য এলাকার সঙ্গে অন্যান্য জেলার মিল খুঁজে পাওয়া যাওয়া না। দার্জিলিং শহরের আবহাওয়া সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে যে, এখানকার আবহাওয়া হয় raincoat অথবা overcoat....কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলা যেতে পারে যে, দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির তুলনায় এখানকার আবহাওয়া অনেক বেশি মনোরম- গরমের আধিক্য কম, বৃষ্টিপাত বেশি, শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়ে। কিন্তু বিগত ১৫/২০বছরের আবহাওয়া বলছে সেই চেনা উত্তরবঙ্গ আর নেই। 'সাস্টেনেবল ডেভেলপমেন্ট`-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল উত্তরবঙ্গ। এখানকার বিরাট অরণ্যভূমি শুধু উত্তরবঙ্গে নয়, উত্তর পেরিয়ে দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমেও তার সুফল প্রদান করত। ডুয়ার্সের দুর্ভেদ্য জঙ্গল ছাড়াও উত্তরে অরণ্যের অভাব ছিল না (ডুয়ার্স বলতে অবশ্য তিস্তা নদীর পূর্ব প্রান্ত থেকে সংকোশের পূর্ব তীরের বিস্তৃত ভূভাগকে বোঝাচ্ছি), কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, সেই অরণ্যভূমির অনেকটাই আজ বিলুপ্ত। স্বাধীনতার আগে বানিয়া ইংরেজ শুধুমাত্র বক্সার অরণ্য নয়, বনজ সম্পদের লোভে লুঠ করেছে লাটাগুড়ি, চাপড়ামারি, মহানন্দা অভয়ারণ্য থেকে শুরু করে উত্তরের অনেক অরণ্যকেই। শাল, শিরীষ, সেগুন, চিকরাশি, গামার, চম্পা ইত্যাদি গাছ থেকে প্রাপ্ত লোভনীয় কাঠের লোভে, হাতির দাঁত বা গন্ডারের সিংয়ের মতো অমূল্য ও দুষ্প্রাপ্য সম্পদের জন্য তাদের দেখিয়ে যাওয়া পথে স্বাধীনতার পরবর্তীকালেও কিন্তু এই লুণ্ঠন থামে নি। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও দেশবিভাগের ফলে ক্রমশ বেড়েছে এদিককার জনপদ। ফলে অরণ্য সংকুচিত হয়েছে। আর কে না জানে যে, উন্নয়নের সঙ্গে প্রকৃতি-নিধনের একটি চিরকালীন দ্বন্দ রয়েছে। আর সেই দ্বন্দ্বের ফলেই, রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য যেমন কাটা পড়েছে শতাব্দীপ্রাচীন গাছ, তেমনি অরণ্যভূমির ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথে কাটা পড়ছে নিরীহ বন্যপ্রাণী। তাই বলা যেতে পারে যে, চা-বাগান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উত্তরে একদা যে বৃক্ষনিধন শুরু হয়েছিল, তা আজও রয়েছে। হয়তো গতি কমেছে, কিন্তু নিরাময় হয় নি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, চিলাপাতার (জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের একটি অংশ) মতো দুর্ভেদ্য জঙ্গল আজ ফাঁকা। জঙ্গলে খাবার না পেয়ে প্রাণীরা হামলা করছে লোকালয়ে। বাড়ছে মানুষ-পশুর লড়াই। বিপন্ন হচ্ছে দুই প্রজাতিই। উত্তরের নদীগুলিও আজ সংকটের মুখে। জানা-অজানা ছোট-বড় নানা নদীর এই অঞ্চলে দিনদিন কমছে নদীগুলির নাব্যতা। ফল সহজেই অনুমেয়। ভাবতে খারাপ লাগে যে, জয়ন্তীর মতো নদীতে প্রতি বছর বন্যার আশংকা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদী গর্ভ থেকে পাথর তোলা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়াতে দিন দিন উঁচু হয়ে যাচ্ছে নদীর খাত। তাই একটু বৃষ্টিতেই সারা বছর তিরতির করে বয়ে চলা জয়ন্তী দু-কুল ছাপাচ্ছে। ভুগছে সাধারণ মানুষ। ১৯৯৩ সালের বন্যা এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রে যে প্রবল অভিঘাত হেনেছিল তার ফলে অনেককিছু পালটে গেলেও উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে আচমকা বন্যা ক্ষতি করছে সবকিছুর। এই বছর কিছুদিন আগে একদিনে ৪০০মিমি বৃষ্টির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে যে, প্রকৃতির এই খামখেয়ালিপনার কাছে আমরা কতটা অসহায়। মজাটা হল যে, এই পরিস্থিতি হয়ত কখনোই হত না যদি আমরা পরিবেশকে রক্ষায় যথেষ্ট সচেতন হতাম। উত্তরের নদীগুলি আজ সত্যিই রোগাক্রান্ত। চোখের সামনে থেকে প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে বালুরঘাটের আত্রেয়ী, শিলিগুড়ির মহানন্দা বা করতোয়া, জলপাইগুড়ির করলা-সহ একাধিক নদী। সারা বছর জল না থাকা এই নদীগুলি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে সামান্য বৃষ্টিতে। বিপদে ফেলতে পারে জনজীবনকে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের শহরগুলিও বদলেছে। কোচবিহার শহরের কথা ধরা যাক। পুরো শহরে রাস্তার ধারে পেভার্স ব্লক। মাটির চিহ্ন নেই। জল বাষ্পীভূত হতে না পারার ফলে শহরের তাপমাত্রা ক্রমবর্ধমান। রাস্তা সম্প্রসারণের ফলে কাটা পড়ছে অনেক গাছ। রাজ্-আমলের নিয়মকে তোয়াক্কা না করে বহুতলের সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে চলেছে (ভূমিকম্পপ্রবন এলাকা বলে অতীতে দ্বি-তলের বেশি দালানের অনুমতি দেওয়া হত না)। এই চিত্র শুধু কোচবিহারের নয়, উত্তরের যে কোনো শহরের দিকে তাকালেই কমবেশি এরকমটি দেখা যাবে। দাজিলিংয়ের কথা ভাবা যাক। পথের ধরে রডোড্রেনডন, ফরগেট-মি-নট ফুটে থাকা সেই দার্জিলিং আজ নেই। পাহাড়ের যেদিকেই তাকানো যাক দেখা যাবে যে, বাড়ির পর বাড়ি পাহাড়ের সবুজ ঢেকেছে। সেই শান্ত সৌন্দর্য্যের দার্জিলিঙেও হয়েছে অটোমোবাইলের প্রবল বৃদ্ধি।
ফলে পরিবেশের দফারফা হতে সময় বেশি লাগছে না। এক্ষেত্রে কাউকে দোষারোপ করাটা ঠিক হবে না, কেননা জীবন ও জীবিকার স্বার্থেই এই পরিবর্তন। কিন্তু খারাপ লাগে তখনই যখন জেনে বুঝেও পরিবেশের ক্ষতি করা হয়, পিকনিকের নামে জঙ্গলের ধারে প্রবল আওয়াজে মাইক্রোফোন বাজানো হয়, নদীর বুকে প্লাস্টিক ফেলা হয়, অরণ্য থেকে খাবারের সন্ধানে চলে আসা বন্যপ্রাণীকে পিটিয়ে মারা হয়। যে সচেতনতা আধুনিক সময়ের মানুষ হয়ে আমাদের সকলের দরকার ছিল তার প্রবল অভাব প্রমাণ করে যে, আমরা নামেই সভ্য হয়েছি, কাজে নয়। উত্তরের এই বদল আগামীতে ঘটতে চলা এক বিরাট সমস্যার অশনি সংকেত মাত্র। এর থেকে পরিত্রানের একটিই উপায় আর তা হল সচেতনতা বৃদ্ধি। মুশকিলটা হল, যদি বা সরকারি-বেসরকারি স্তরে কিছুটা চেষ্টা চালানো হচ্ছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করা যাবে না। এর জন্য লাগবে মনের গভীর থেকে উঠে আসা এক প্রবল অনুভূতি যা একজনকে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা বোধ করাবে। এই বোধ যতদিন না আসবে ততদিন বোধহয় প্রকৃতির এই নিধন চলতেই থাকবে। আর যত এই নিধন চলবে তত আমরা নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনব!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours