fiture
স্বরূপ গুপ্ত, লেখক, কোচবিহার: উত্তরবঙ্গকে জনজাতির দেশ বললে বোধহয় ভুল বলা হয় না। দার্জিলিঙের পাহাড় থেকে শুরু করে কোচবিহার-আলিপুরদুয়ার-জলপাইগুড়ি-সহ দুই দিনাজপুর বা মালদহতেও তাদের অস্তিত্ব। কলকাতা বা দিল্লী-মুম্বাইয়ের মতো মহানগর না থেকেও উত্তরবঙ্গ এখানেই কসমোপলিটান। বিবিধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিন্তু ধীমালরা সামান্য হলেও আলাদা। উত্তরের অন্যতম প্রাচীন এই জনগোষ্ঠীটিকে নিয়ে আমরা সকলেই কেন যেন বড্ড উদাসীন। 'অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী` বা ডিমিনেটিভ গ্ৰুপ যেন তাদের একমাত্র পরিচিতি। অথচ উত্তরবঙ্গের জনজাতির ইতিহাসে তাদের অবস্থান ভোলার নয়। সম্ভবত 'হিমাল' শব্দটি থেকে ধীমাল কথাটির উৎপত্তি। এদের আদি নিবাস উত্তর ও উত্তর-পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশ। অনেকের মতে খান-ডনক-বাকা নামের এক কিরাত পুরুষের প্রথম সন্তান ধীমালের নাম অনুসারেই এই জনগোষ্ঠীর পরিচিত। ভোটব্ৰহ্ম গোষ্ঠীর শাখা ও কিরাত প্রশাখার অন্তর্গত উপজাতি বলেও তারা চিহ্নিত হয়েছেন। অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর ধীমালরা অতীতে স্থায়ীভাবে কোনো একটি জায়গায় বাস করতেন না। তিন-চার বছর পর পর স্থান ত্যাগ করে অন্য জায়গায় চলে যাওয়াটা ছিল তাদের রেওয়াজ। তবে ছেড়ে যাওয়া স্থানে ফিরে এসে আবার কিছুদিন বসবাস করার অভ্যাসও বিদ্যমান ছিল তাদের মধ্যে। আসলে একদা গভীর জঙ্গলে গৃহ নির্মাণে অভ্যস্ত ধীমালরা জঙ্গল কেটে চাষ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তবে এক জমিতে দুবার চাষের পদ্ধতি তাদের জানা ছিল না। তাই ফেলে আসা জমিতে জঙ্গল জন্মালে আবার ফিরে এসে তারা জঙ্গল কেটে পুড়িয়ে ফেলতেন এবং ছাই ব্যবহার করতেন সার হিসেবে। তুলাচাষে ধীমালদের দক্ষতা ছিল অনস্বীকার্য। সম্পূর্ণ স্বনির্ভর ধীমালদের কোনোদিন চা-বাগানে বা বন-বিভাগের চাকরিতে দেখা যায় নি। যদিও অনেকে বলেন ধীমালদের মধ্যে আরও কিছু গোত্র বা উপগোত্র রয়েছে তবু তালিপা, নুনিয়া, যোগী, কাশের, থারু, দোংভো, লাতের, অংলাইটি, নুনিয়া, ডিং, অগ্নিয়া, রাথুম, লেবমত, তেগরে ইত্যাদি চোদ্দটি গোত্রে বিভক্ত করা যায় ধীমাল সমাজকে। তাদের মধ্যে সমগোত্রে বিবাহ যেমন নিষিদ্ধ তেমনি অন্য কোনো জনজাতির কন্যাকেও তারা বিয়ে করেন না। বিবাহের ক্ষেত্রে ধীমাল সমাজের একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য যে কন্যাদের ২১-২২ বছরের আগে বিবাহ না হলেও পুত্র সন্তানের ক্ষেত্রে বিবাহের বয়স কিন্তু ১৬-১৭। আসলে ধীমাল সমাজে পুরুষের হার শতকরা ৬১। মহিলাদের সংখ্যা দিন দিন কমতে থাকায় সম্ভবত এই প্রথাটি চালু হয়েছিল। এখানে বলা দরকার যে, ২০১০ সালের জনগণনা অনুসারে বর্তমানে ধীমালদের সংখ্যা ৯৪৮। ২০০০ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ১০৭৪। ধীমাল জনগোষ্ঠীর এই ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যা কিন্তু সত্যি উদ্বেগের কারণ।
পরিবর্তিত পরিস্থিতে হিন্দু দেবদেবীরা ক্রমশ ধীমাল সমাজে জায়গা করে নিলেও ধীমালদের 'গারাম-পূজা' সমগ্র মানব প্রজাতির মঙ্গল কামনায় করা হয়ে থাকে। এই পূজাতে নিজেদের গ্রাম তো বটেই, ডাক পান অন্যান্য জায়গার ধীমালেরাও। 'হরিয়াতা' বা তুলা ফসলকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত পূজা বর্তমানে তুলাচাষের অভাবে বন্ধ বললেই চলে। তবে বর্ষাকালের 'আষাঢ়ী-ঘাসারি পূজা ', জৈষ্ঠ্য মাসের 'জেঠ পূজা' এখনও প্রচলিত। কৃষিকেন্দ্রিক 'গাভীপুজা', অসুখবিসুখ দূরে রাখার জন্য 'পশ্চিমপাকা` ইত্যাদি পূজাও চালু ধীমাল সমাজে। 'দেওথি' বা প্রধান পুরোহিতের সাথে বয়স্ক ব্যক্তি বা 'ধামী` পূজার কাজ সামলালেও প্রধান পুরোহিতের মর্যাদা পান না। ধীমালদের আদি পুরুষ দেবতা 'দানতা বেরাং' ও দেবী নারী 'দানতা ওয়ারাং' ধীমাল সমাজ থেকে সম্পূর্ণ মুছে না গেলেও বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেভাবে পরিচিত নন। এদের চাইতে দুর্গাপূজা, মনসাপূজা, গাজন ইত্যাদির আকর্ষণ বেশি বর্তমান ধীমালদের কাছে। ভোটব্ৰহ্ম গোষ্ঠীর শাখা হওয়ার সুবাদে ধীমালদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। অনেক মনে করেন যে ধীমালদের ভাষার সঙ্গে টোটো ভাষার সাদৃশ্য প্রচুর। কিন্তু কালের গতিতে সে ভাষা আজ লুপ্তপ্রায়। আজকের ধীমালেরা সাদ্রী, রাজবংশী, বাংলা ইত্যাদি ভাষায় কথা বলে অভ্যস্ত। বর্তমান প্রজন্ম ধীমাল ভাষা জানে না বলা যেতেই পারে। একটি ভাষার অপমৃত্যুর কারণ গবেষণার বিষয় হলেও বলা যেতে পারে যে, ধীমালদের যাযাবর জীবন এর জন্য দায়ী। তারা যেখানে বসতি স্থাপন করেছে সেখানে বৃহত্তর অন্য জনগোষ্ঠীর প্রভাবে নিজেদের ভাষাকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। পরবর্তীতে অন্য ভাষা মাধ্যমের বিদ্যালয়ে ধীমাল শিশুরা বিদ্যাশিক্ষা লাভ করতে শুরু করলে নিজেদের ভাষা লুপ্ত হতে সময় নেয় নি। আজ হাতে গুনে বলে দেওয়া যায় কতজন ধীমাল নিজেদের ভাষা জানেন। প্রধানত দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলার কিছু অংশে ধীমালদের বাস হলেও, জলপাইগুড়ি জেলায় তাদের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ধীমাল জনসংখ্যার এই হ্রাসের কারণগুলি সুস্পষ্ট নয়। সম্ভবত ১৮৫০ সাল থেকে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৮৫০ সালের পূর্বে ভুটানরাজ প্রদত্ত 'মল্লিক' উপাধিধারী ধীমালেরা তহশীলদারের প্রভূত ক্ষমতা ভোগ করতেন। কিন্তু ১৮৫০ সালে তরাই অঞ্চল ইংরেজদের অধীনে এলে প্রচুর পরিমানে অন্য জনজাতির লোকেরা এসে ধীমালদের পেছনে ঠেলে দেয়। 
তরাই-ডুয়ার্সের অরণ্য থেকেও ধীমালরা সরে যেতে বাধ্য হয় কেননা অরণ্যাঞ্চল সংরক্ষণের আওতায় আনা হয়েছিল। ধীমালদের বাসস্থানের সমস্যা প্রকট হয় একের পর এক চা-বাগান প্রতিষ্ঠার ফলে, কেননা চা-বাগান প্রতিষ্ঠার জন্য ক্রমাগত অরণ্য নিধন করা হলে নিজেদের জায়গা হারায় ধীমালেরা। নিজেদের জায়গা, জমি, ভাষা, ধৰ্ম সব হারালেও এক অদ্ভুত কারণে ওবিসি তকমা ছাড়া আর কিছু জোটে নি ধীমালদের কপালে। প্রখ্যাত নকশাল নেতা কদম মল্লিক ও খুদন মল্লিকের ধীমাল জনগোষ্ঠীর এই দুর্দশার কারণ ১৯৪১ সালের জনগণনায় তাদের অনুপস্থিতি। এর সুস্পষ্ট কারণ আজও অজানা এবং তা শোধরানোর কোনো প্রচেষ্টাও লক্ষ্য করা যায় না। ১৮৪৯ সালে প্রথম হজসন সাহেব ধীমালদের উল্লেখ করলেও মনে করা হয় ১৬২৮ পরবর্তী সময়ে এরা তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে থাকতে শুরু করেন। ডাল্টন, হান্টার, রিজলি প্রমুখদের লেখাতে ধীমালদের উল্লেখ প্রমান করে এই জনগোষ্ঠীর প্রাচীনত্ব। অনেককিছু হারিয়ে, সরকারি আনুকূল্যে বঞ্চিত থেকে ধীমালরা এভাবে আর কতদিন টিঁকে থাকতে পারবেন এখন সেটাই বিরাট প্রশ্নচিহ্ন। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। উত্তরের অন্য সব গোষ্ঠীরা যে সুযোগ-সুবিধে পাবে ধীমালরা তা পাবেন না কেন সেটা আজ লাখ টাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের সঙ্গীন অবস্থার জন্য আমাদের উদাসীনতাই দায়ী। দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া এই আদিম জনগোষ্ঠীকে যদি আমরা বাঁচাতে না পারি তবে কিন্তু ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। 


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours