দেবর্ষি মজুমদার, লেখক, বীরভূম:
শ্রী মান, ভোলা বাবার অনুগত ভক্ত। কিন্তু কয়েকদিন ধরে ভোলা বাবার অন্যান্য ভক্তদের ভক্তির আতিশয্যে শ্রীমানের দফা রফা অবস্থা! এবার শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহে পড়ছে সোমবার। এমন যোগ সচরাচর কেউ হাতছাড়া করে না! দেবাদেবীতে বাবার মাথায় জল ও ঢেলেছে ভক্তিভরে!! সেদিন থেকেই বাবার মাথায় তার মত অনেক ভক্তদের জল ঢালা শুরু। যাদের বাড়ি তারাপীঠের মুখের গ্রামগুলোতে, তারা হাড়ে হাড়ে জানে, সে কি যন্ত্রণা! রাস্তার ধারে বাড়ি হলে গোটা রাত চোখের দু'পাতা এক করা যায় না। সেই যন্ত্রনা এবার শুরু! শ্রী মতি , শ্রীমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দাঁড়াও, এই তো কলির সন্ধ্যে! শ্রাবণ মাস গোটাটা যেতে দাও! শরীরটা ভাজা ভাজা হবে। আগের রাতে ঘুম হয় নি। অনেকটা শারীরিক ক্লান্তিতে , কতকটা স্ত্রীর অধ্যাদেশে ঘুমুতে গেলেন শ্রীমান! তারপর যা হলো, সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। যদি না স্ত্রী...
স্ত্রী আমার হ্যানায় ধরে টানাতে বিছানায় ধরফড় করে উঠলাম ঠিকই। কিন্তু তখনও ঘোর কাটে নি। তাঁর অমৃত বানী ঠিক কানে পৌঁচ্ছিল না। বুঝলাম মেয়েকে টিউশনে নিয়ে যেতে হবে। বড্ড দেরী হয়ে গেছে। তখন পেস্ট নিয়ে- মন্ত্র আওড়াতে আওড়াতে বাথরুমে ঢুকলুম—ওঁ নমঃ শিবায়। ওঁ তৎপুরুষায় বিদ্মহে মহাদেবায় ধীমহি। তন্নো রুদ্রঃ প্রচোদয়াৎ। রান্নাঘর থেকে গর্জন --আবার বাথরুমে মন্ত্র !! ওখানেই ইতি।
কিন্তু চিন্তা ছাড়ছে না। মাথা ঝিম ঝিম করছে। সোমবার ছিল শ্রাবণের শেষ সোমবার। গোটা দিনমান আর রাত্রি জুড়ে পথ ফেরতা বাবার ভক্তদের তান্ডবে ঘুম হয় নি। রাস্তার ধারেই বাড়ি।
মনকে প্রবোধ দিলাম, একটা তো দিন! ও ঠিক আছে। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই শেষ নয়। ধরফড়িয়ে উঠলামই বা কেন? আর শিবের গায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারণই বা করলাম কেন? সে কি ব্যাপার? ভক্তির আতিশায্যে ? অনেকটাই তাই। ভোরের দিকে ঘুম এসেছিল। আর জোরালো ঘুম না হওয়ায় স্বপ্ন। ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি – ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়। হয়ত এই সাত পাঁচ ভেবে ঘোর কাটে নি। আজকের মত সংসারের কিছু দায়িত্ব সেরে ধর্মপত্নীকে পাশে বসিয়ে বলতে শুরু করলুম। আপনারাও শুনুন! আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। অবশ্য যদি আপনাদের না থাকে! তবে আপনাদের যেগুলো বলছি, সেগুলো গিন্নীর কানে বিপ বিপ বাজবে। অর্থাৎ ওগুলো ডট ডট।
ঘুমটা যখন প্রথম স্তরে প্রবেশ করে, আরেকটু নিচে নামছে, তখন দেখলাম দেবাদিদেব মহাদেব মুখ কাঁচুমাচু করে বসে আছে। বলে রাখি, আমার বাড়ির সামনে টি আর ডি এ একটি সুন্দর শিব মন্দির পূননির্মান করে দিয়েছে। নতুন মন্দির ভালোই লাগে। যাওয়া আসার আগে দুবেলা প্রনাম করি। তারপর আবার আমার স্ত্রীর নাম শিবানী। সে তো আলাদা মাহাত্ম্য। যাই হোক বাবার কালো আমসি শুকনো মুখের দিকে ভয়ে ভয়ে করোজোড়ে তাকালাম। বাবা অভয় দিলে, মনোকষ্টের হেতু জিজ্ঞেস করলাম? উলটে বাবা, প্রশ্ন করলেন, কাল সারা রাত ঘুমুতে পেরেছিস? আমি বললাম, না বাবা আপনার ভক্তরা ডিজে নিয়ে যে গানবাজি করল! ঘুম আসে নি। সকালে কনস্টিপেশন। বাবা বললেন-- আমিও! যোগনিদ্রা যাওয়ার জন্য চেষ্টা করেও দুটো পাতা এক করতে পারি নি। তারপর বললেন, কি যেন বললি তোর কোষ্ঠ কাঠিন্য? যাওয়ার সময় একটি ভেষজ পাতা দেব নিয়ে যাস, খাস। পেট পরিষ্কার হবে। স্বপ্নের মধ্যেও আমার জ্ঞান টন টনে! বললাম, বাবা বীরভূম থেকে কৈলাস তো এতদূরে! কি করে এতদূরে আওয়াজ আসবে? আরে, মুর্খ কোথাকার, যদি তোদের মন্ত্র, নৈবেদ্য আমার কাছে পৌঁছাতে পারে তো ডিজের আওয়াজ নয় কেন? অতি যুক্তি সঙ্গত কথা! তাই ঘাড় নেড়ে সায় দিলাম তার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে বললেন- এমনকি যে সমস্ত সংগঠনরা ভক্তদের পানীয়র ব্যবস্থা করেছিল, তারা প্লাস্টিকের গ্লাসগুলোর কোন গতি করে নি। আমার কৈলাস ছেয়ে গেল দূষণে? ঠিক আছে বাবা --- বলা শেষ না হতেই, বললেন, জানিস ? বাসুকিটা কানে শুনতে পায় না। সেও ডিজের আওয়াজে পালিয়েছে। আসলে বড় কম্পন হয় তো! ও সহ্য করতে পারে না। কোথায় যে লুকোলো! গিন্নি তো কানে আঙুল দিয়েই কষ্টে ছিল। বৌ নিয়ে তো ঘর কন্না করিস তো নাকি? আমি বললাম হ্যাঁ বাবা সে বলতে! তার নাম ও তো শিবানী। তাবেস! বলেই বাবা ফের বলতে শুরু করলেন, আমার জয়ধ্বনি দিলি ঠিক আছে, আমার গিন্নির দুএকটা তো দিতে পারতিস! শুধু ভারতেই এই শ্রাবন উৎসব হয়, তা তো নয়, নেপালে হয়। শ্রী লংকায় হয়। তারা তো এমন করে না! ‘ভারত মাতার জয়’ একি। আমি সাহস করে বললাম, অবশ্যই বাবার সাথে মায়ের নাম দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সামনে স্বাধীনতা দিবস তো! তাই আবেগে ওটা বেরিয়ে গেছে। তা দিক না। কিন্তু মহিলাদের মধ্যে হিংসে তো একটু হবে। বাপের বাড়ি পালিয়েছে পার্বতী। তা যাক! কদিন বাদেই তো মর্ত্যলোকে বাপের বাড়ি যাবে। আমার সাহস বেড়েই যাচ্ছিল। বললাম, আসলে আপনার পুজো। তাই আপনার জয়ধ্বনি! – মহাদেব ধমক দিয়ে বললেন, পড়াশোনা, কিসসু করো নি। সতীর পুণ্যে পতীর পূন্য নহিলে খরচ বাড়ে। এইটা জানোস না? বাবা, বাঙাল ভাষা। তোর বৌ শিবানীরে জিঘাস, বুঝায় দেবে। হাত কচলাতে কচলাতে মুখ কাঁচুমাচু করে বোকা হাসি হেসে বললাম, সে তো ঠিকই! তারপর আবার একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, জানিস, বাবা তারক নাথ সিনেমাটা বেশ ভালো ছিল। কিন্তু সেটাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে আমি ভাবতে পারিনি! জানিস, শ্রাবন মাসে আগে ভক্তরা নিরামিষ খেত। ২১টি বেল পাতায় চন্দন দিয়ে ওঁ নম শিবায় লিখে আমাকে নিবেদন করত। মদ্যপানের অভ্যাস থাকলে বিরত থাকত। আমাকে গাঁজা বাবা নাম দিয়ে তো এখন গাঁজা মদ সব গিলছে। আগে কি সুন্দর বলত ‘ভোলে বাবা পার করে গা! ডমরু বাবা পার করে গা’। আর এখন তোরা ভোটের সময় পার্ট কর্মীদের চিৎকারকে কি বলিস যেন??? ফস করে বললাম ‘শ্লোগান’। এই তো বুদ্ধিমান ছেলে! ঠিক তাই। প্রশংসা পেয়ে উত্তেজিত হয়ে কথার মাঝে কথা কেটে বললাম, ওটা আমরা বঙ্গবাসী খুব ভালো পারি বাবা। ---হুম! সে তো দেখলুম! ছ্যা ছ্যা! সতেটা (সরস্বতী) করছে কি! ঐ শ্লোগান না কি ছাই! বলে কিনা? – রাস্তায় রাস্তায় ঢালি/ বাবার কত শালী। ঝিঙে আলু পোস্ত, বাবা ভালো বাসত। রাস্তায় রাস্তায় বাম্পার, বাবার কত ট্যাম্পার। -- বলেই জিজ্ঞেস করলেন, এই ট্যাম্পারটা কি রে? সোৎসাহিত হয়ে বললাম, ক্রিকেট খেলায় বল ট্যাম্পারিং শুনেছি। কোন কিছুতে বিকৃতি ঘটানো আর কি। তবে আপনার ওই ভক্তরা আপনার লুজ টেম্পারের কথা বলেছেন। রাখ!
আমার ভক্ত! তারপর বিমর্ষভাবে বললেন, দেখ তাহলে, আগে ভক্তরা আমাকে বলত, বেলপাতা আর চোখের জলেই তুষ্ট। আর এখন এসব বলে! আর ভাষা দেখ! বলে আমার নাকি অনেক শালী! এসব নোংরা কথা! সংসারে অশান্তি লাগানোর গোঁড়া? আর আমি কোন জন্মে ঝিঙে পোস্ত খেতে ভালোবেসেছি? ---বাবা আরোও কিছু বলতেন, কিন্তু শোনা হল না। ওই যে গিন্নীর হ্যানায় হ্যাঁচকা টান!
Post A Comment:
0 comments so far,add yours