Fiture
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতা:
করিৎকর্মা ভারতবাসী। 
দিব্য নিশ্চিন্তে জনসংখ্যা বাড়িয়ে চলেছে। কমছে জিডিপি। উজার প্রকৃতির ভান্ডার। দারুন টান পৃথিবীর বুকে ধরে রাখা জলে। দোপেয়েদের জায়গা ছেড়ে দিতে হচ্ছে জল জঙ্গল বন অরণ্যকে। সরতে হচ্ছে চারপেয়েদের। তবু দোপেয়েদের কুলোচ্ছে না। 
'ঠাই নাই ঠাই নাই ছোট এ তরী!'

প্যারাসাইটসের মতো সংখ্যায় বেড়ে চললে যা হয়! চলছে নিজেদের মধ্যেই চরম খেয়োখেয়ি। কামড়াকামড়ি। যেখানেই যান ভিড় শুধু ভিড়। জনসমুদ্র। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে কমপক্ষে চারশো ষাটজন মানুষ। যেদিকে তাকান শুধুই মাথা। সাদা চুল কালো চুলের মাথা। সাদাচুলো মাথারা সংখ্যায় এমন বেড়েছে যে বেশ নজর কাড়ে। বয়স্করাও এখন অনেকটাই দীর্ঘজীবী। মৃত্যুর হার কমেছে। অঙ্কের হিসেবে প্রতি দশহাজার মানুষের মধ্যে মারা যান মাত্র তেয়াত্তর জন। পরিসংখ্যানটা 2016 সালের। আগামী বছর, একশোজন ভারতবাসীর মধ্যে দশজনের বয়স হবে ষাটেরও বেশি। বর্তমান পরিসংখ্যান বলছে, মিনিটে মানুষ উৎপাদন চৌত্রিশটা। এক্সপায়ারি দশটা। পাটিগনিতের হিসেবে, প্রতি মিনিটে ভারতীয়ের সংখ্যা বাড়ছে চব্বিশ।

মিনিটে চৌত্রিশটা বাচ্চা উৎপাদন করার দক্ষ ভারতীয় কারিগরদের কানমলা দিয়ে টাইট দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি। সঙ্গে পুত্র সঞ্জয়। খাতায় কলমে অবশ্য বিশ্বে ভারতই প্রথম দেশ যেখানে সরকারি স্তরে জন্মনিয়ন্ত্রণের সূচনা হয়। স্বাধীনতার মাত্র চার বছরে পরেই, 1951 সালে। তার বছর দশেক পরে শুরু হয় কন্ডোমের প্রচার। কিন্তু তাতে কাজের কাজ কতটুকু হয়েছে তা আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর দরকার নেই। 
তবে ইন্দিরাজি এসে বেশ টাইট দিয়েছিলেন। মাত্র একবছরে 6.2 মিলিয়ন পুরুষকে উৎপাদনের অযোগ্য করে ছেড়েছিলেন। এমার্জেন্সির সময় যে সব অত্যাচার নিয়ে মানুষ আজও গরম গরম কথা বলে, তারমধ্যে এই নির্বীজকরণের ইস্যুটা থাকবেই। 
দিল্লি থেকে শুরু হয়েছিল এই নির্বীজকরণ অভিযান।সালটা ছিল 1976। ভ্যাসেকটমি করালেই হাতে-হাতে নগদ পঁচাত্তর টাকা, এক টিন খাঁটি ঘি প্লাস সাতদিনের ছুটি। অনেক ক্ষেত্রে আবার সাইকেলও দেওয়া হতো। স্পষ্ট ভাষায় সরকারি, আধা সরকারি, অধিগৃহীত সংস্থার কর্মীদের পকেটে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল সরকারি ফতোয়া। দুটোর বেশি বাচ্চাকাচ্চার বাপ হলেই ভ্যাসেকটমি অনিবার্য। নাহলে ফোকটে সরকারি চিকিৎসার মতো বেশকিছু সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। 

দিল্লি থেকে দেশের নানা রাজ্যে ওই অভিযান ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে, জন্মনিয়ন্ত্রণের নামে জোরজুলুম চলছে। পুলিশ দিয়ে গ্রাম ঘিরে ফেলে সব পুরুষদের টেনে হিঁচড়ে ভ্যাসেকটমি করানো হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার রং লাগতেও দেরি হয়নি। মোদ্দা কথা, স্বাধীনচেতা ভারতীয়দের যৌনজীবনে সেদিনের ওই সরকারি হস্তক্ষেপ মোটেই পছন্দ হয়নি। 

পছন্দ হলে আজকের ভারতের ছবিটা অন্যরকম হতো। অফিস টাইম মেট্রোতে উঠেই দিব্য সিট পেয়ে যেতেন। পুজোর ছুটিতে দার্জিলিংয়ে ঠিক ম্যালের পাশে না পেলেও রেলস্টেশনের পাশেই বেশ মনমতো রুম পেয়ে যেতেন। তৎকালের আশায় শকুনের মতো না বসে না থেকে, এসি টু-টিয়ারেই টিকিট সহজেই পকেটে ভরে ফিরে আসতেন।
এসব কিছুই সম্ভব হতো সময় মতো ভিড়টাকে ছেটেছুটে বেশ ভদ্রস্থ করে তুলতে পারলে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।

ধুঁকছে তৃতীয় বিশ্বের এই ভূখণ্ড। ভারত নামের এই মহাদেশ। আর ধুঁকবে নাই বা কেন, যতোই সুজন হোন না কেন, তেতুল পাতায় নজন হয় না। গোটা দুনিয়ার মোট ভূসম্পদের মাত্র 2.4 ভাগে ভারতের অধিকার। আর তাতেই সঙ্কুলান বিশ্বের 17.75 জনসংখ্যার। ব্যাপারখানা ভেবে দেখুন একবার।

'তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ
হতে পারি দীন, তবু নহি মোরা হীন...'

দীন তো ভবিতব্য। তবে ক্ষীণ যে নয় তাতো এতদিনে বোঝাই গেছে। নইলে একশো তেত্রিশ কোটির বেশি আরও যোগ করে ফেললো কোন বাহুবলীতে? প্রতি মিনিটে চৌত্রিশটি নবজাত। কী অসম্ভব দ্রুতগতি। ভারতীয়রা জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতি বাড়িয়েছে। জাপানিরা বুলেট ট্রেনের। আর তাদের জনসংখ্যা বাড়ার গতি এখন নেগেটিভ। মানে জনসংখ্যা কমছে। 2010 এর ইউ এন রিপোর্ট বলছে, জাপানের শতকরা এক অথবা তারচেয়েও কিছু বেশি হারে জনসংখ্যা কমছে। 
মোদিজি অনেক বেশি কাজের কাজ করতেন, জাপান থেকে বুলেট ট্রেনের টেকনোলজি আনার পাশাপাশি যদি জনসংখ্যা কমানোর টেকনোলজিটাও আমদানি করতেন। নইলে একদিন সেরেফ জনসংখ্যার চাপে পড়েই বুলেট ট্রেন ছুটবে মোগলসরাই ফাস্ট প্যাসেঞ্জার হয়ে।

পৃথিবীর সাতাশটা দেশে ইতিমধ্যেই জনসংখ্যা কমতে শুরু করেছে। ভারতের জনসংখ্যা নিয়ে কথা উঠলেই আগে চীনের দিকে আঙুল উঠতো। এখন কিন্তু চীনেও জনসংখ্যা পড়তির দিকে। কিন্তু তাতেও পৃথিবীর ভার কমবে না। কারণ ভারত পাকিস্তানের মতো কিছু দেশে এখনও জনসংখ্যা বাড়ানোর কল-কারখানায় উৎপাদন ভালো। সমীক্ষার দাবি, 2050 নাগাদ দুনিয়ায় যে জনসংখ্যা বাড়বে, সেই বাড়তি জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশিতে যোগদান থাকবে ভারত পাকিস্তানের।

তবে সন্তান উৎপাদনে ভারতীয়দের কেরামতিতে খানিকটা ভাটার টান লেগেছে বৈকি। 1969 সাল নাগাদ প্রতি মহিলা জন্ম দিতেন 5 .6 শিশু। 1998 সালে তা কমে দাঁড়ায় 3.7। চলতি বছরে আশা করা হচ্ছে ওই সংখ্যা আরও খানিকটা কমে দাঁড়াবে 2.3। আন্তর্জাতিক স্তরে একজন মহিলা জন্ম দেন আড়াইটি শিশুর।
সন্তান উৎপাদনের সূচকে তবে এ বাঙালী কিন্তু বেশ আন্তর্জাতিক মানের। 2016এর রেজিস্ট্রার জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বাঙালি দম্পতির ঘরে এখন দুটি বা দুটির কম বাচ্চা জন্মায়। বাংলার পাশাপাশি দিল্লি, তামিলনাড়ুতেও জন্মহার বেশ কমেছে। দেশের মোট বারোটি রাজ্যে দুই সন্তানের নীতি সফল। কিন্তু ভারতের যে রাজ্যটা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশের প্রধানমন্ত্রী দিয়েছে সেই উত্তরপ্রদেশের একি হাল? সেখানে 3.1 হারে এখনও চলছে অবাধ সন্তান উৎপাদন। তারপরেই বিহার। সেখানে ওই হার আরও বেশি, 3.3 সন্তান।

আপাতত যা অবস্থা, তাতে আর মাত্র বছর পাঁচেকের অপেক্ষা। বর্তমান হারে ভারতীয়রা সন্তান উৎপাদন চালিয়ে গেলে, আমরা টেক্কা দেব চীনকেও। যার সোজা মানে- ভারত আবার জগতসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। জনসংখ্যার বিস্ফোরণে বিশ্বের দ্বিতীয় জায়গা থেকে উঠে আসবে একেবারে প্রথমে। দেশের এই মানবসম্পদ সত্যিই কতখানি সম্পদ আর কতখানি আপদ, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। নিজের শোয়ার জায়গা নেই আর ফিসুরে ডাকে!

ইয়ং ইন্ডিয়ার ছবিটা আগামিদিনে ঠিক কেমন দাঁড়াবে? ভিড় আরও বাড়তে চলেছে তরুণদের। গড়পরতার হিসেবে প্রতি একশো ভারতবাসীর মধ্যে সাড়ে ছাব্বিশজনেরও বেশির বয়স হবে চোদ্দর মধ্যে। তার মানে দরকার হবে আরও বেশি কর্ম সংস্থান। 'সবকা সাথ সবকা বিকাশ'!
'বিকাশ'- এর ছবি নাহয় ক্যানভাসে আঁকা গেল। তারপর? অলস মস্তিষ্ক আর কর্মহীন হাত। সন্তান উৎপাদন শিল্প ছাড়া আর কোনও উৎপাদনমুখী শিল্পতো এখনও তেমন ভাবে চোখে পড়ছে না। 'সবকা বিকাশ' কি তাহলে রাম ভরোসে? 'সবকা বিশওয়াস'- এর গপ্পে আর নাহয় নাই গেলাম। কারণ সবকার মধ্যে দেশের চাষাভুষো, গেঁয়ো মানুষগুলোও পড়ে। গতবছরের নভেম্বরে 'অল ইন্ডিয়া কিষাণ কো-অর্ডিনেশন কমিটি'র মিছিল দেখেই বোঝা হয়ে গেছিল, দেশের কৃষিশিল্পর বাস্তব ছবিটা কেমন দাঁড়িয়েছে। চব্বিশ রাজ্যের দুশো সাতটি কৃষক এবং কৃষিজীবী সংগঠন মোদি সরকারের কৃষিনীতির বিরোধিতায় নেমেছিলো।
মুশকিল হচ্ছে ঝাঁ চকচকে দুরন্ত শহরের এসি ফ্ল্যাটে বসে এলইডি পর্দায় আমরা প্রত্যন্ত গ্রামের ছবি দেখি। তাও কোন ছবি? আগে যেই ছবি দেখাতেন মনমোহনজি, এখন মোদিজি। রঙিন, সবুজে মোড়া গ্রাম। সেই রংটা যে আসলে ধুসর, দিল্লির রাজপথে আসা 'কিষাণ মুক্তি মোর্চা'র বিশাল সুশৃঙ্খল মিছিল আমাদের তা জানিয়ে দিয়ে গেছিল।

এদিকে জনজোয়ার সামলাতে ক্রমেই কমছে চাষাবাদের জমি। আজকের দিনেও গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতেই বাস একশোজন ভারতবাসীর মধ্যে আটষট্টি জনেরও কিছু বেশির। আর শহরে থাকেন একত্রিশজনের সামান্য বেশি। রোজগারের আশায়, গ্রাম থেকে শহরে আসা মানুষের ভিড় বহুদিনের সমস্যা। 

সাধারণ মানুষের অনেকেই সরকারের খিল্লি উড়িয়ে বলেন- মানুষ বাড়লেই ভোটব্যাঙ্ক বাড়বে। তাই সব চুপচাপ। বেশ! সেই সব অতিবুদ্ধি সাধারণের প্রশংসা করেই বলি, তাহলে তো 'নেপোয় মারে দই'। আমরা সেই দই সাপ্লাইটা দেব কেন?

'হ্যাঁ, দেবো বটে,' বলেছিলেন এক মেধাবী ভদ্রজন। 'আমরা ওই দই-ই সাপ্লাই দেব।'
আজ আর মনে পড়ে না সেই মেধাবী ভদ্রজনের নামধাম। তাঁর মত ছিল, সন্তান উৎপাদনে রাশ টেনেই বাঙালি নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ জন্মনিয়ন্ত্রণ করলে বাঙালি রবীন্দ্রনাথকে পেতো না। কারণ তিনি মহর্ষির পঞ্চম সন্তান। আবার শ্রীকৃষ্ণের কথাও ভাবুন। তিনি বাসুদেব-দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান। হম দো হমারা দো নীতি থাকলে এই দুজনের কাউকেই আমরা পেতাম না।
কি বলবো, দুষ্টর ছলের অভাব হয় না?



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours