Story
চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়, ম্যানেজিং এডিটর, দ্য অফনিউজ, কলকাতাঃ চিন্তার সূত্র ছিন্ন হয় মোবাইলের কর্কশ রিংটোনে , ঊষা ফোনটা নিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে উঠোনে । সন্ধ্যার নীরবতার ধ্যান ভঙ্গ করে ঊষার উচ্চ কন্ঠে আওয়াজ আসে , - হ্যালো !!!! সদু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ঊষার দিকে । সদু জিজ্ঞাসা করে , - কার ফুন এয়েচে বউমা ? আমার বুদুর ? ঊষা কিছুটা তফাতে গিয়ে হাতের ইশারায় চুপ করতে বলে । কিন্তু ঊষা যত জোরে হ্যালো বললো তার কথাবার্তা ততো জোরে শোনা গেল না , খুব চাপা স্বরে , ফিসফিস করে কথা এগোতে লাগলো । কিছু টুকরো কথা ভেসে এলো সদুর কানে । সদু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ঊষার দিকে । মুচকি হাসিতে চোখ ছোট হয়ে এসেছে ঊষার , খুব কষ্ট করে যেন হাসির গমক আটকে রেখেছে । বেশ কিছু সময় কথা চলে, এবং কথার আভাস যাতে সদুর কানে না যায় সেদিকে যথেষ্ট যত্নবতী ছিল ঊষা । কথা শেষ হতেই সদু আবার প্রশ্ন করে , - কার ফুন এয়েচিল বউমা, বুদুর !? ঊষা খুব মিহি গলায় বলে,- না, আপনার ছেলে না ,আমার বাপের বাড়ির ফোন ছিল । কিন্তু ঊষার চোখের ভাষা অন্য কথা বলছিল । সদু বললো,- তুমার বাপের বাড়ির ফুন আজকাল একটু ঘন ঘনই আসতিচে দেকছি !! ঊষা সে কথার উত্তর না দিয়ে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি রেখে যায় সদুর জন্য । সদু উঠোনে দাড়িয়ে একবুক কুয়াশা মাখা নিঃশ্বাস নিয়ে ধীরে গভীর শ্বাস ছাড়লো । সেকি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছে ঊষার ভিতর ? ভদ্রাসনের প্রদীপ তিরতির করে কেঁপে সদুর মুখে হালকা আভা ছড়ায় ,বয়সের ভাঁজ গুলো আরো প্রকট লাগে । সম্বিত ফেরে ঊষার ঘরের টেলিভিশনের আওয়াজে । সদু ভাবে ,সে নিজে যখন এ বয়সের, তখন সেও শুনতো বিবিধ ভারতীর "মনের মত গান "। যেন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে । তার সময় ফোন ছিলনা বটে কিন্তু পত্রবাহক তো ছিল । সদু আনমনে অভ্যাস বশে পায়ে পায়ে উনানের পাশে এসে দাঁড়ায় । খুব তোলপাড় লাগছে মন, সেটা কি কারণ আবিস্কার করতে পারেনা । কত বয়স হল সদুর তার হিসাব আর রাখে না, তামাটে সিঁথির দুপাশ বেয়ে সাদা কালোর মেলা যেন খোঁপায় স্তূপাকৃত হয়েছে। কানের লতি দুল সমেত ঝুলে এসেছে , ঠোঁটের উপর কিঞ্চিত ভাঁজ, তাকে বেষ্টন করে আছে হালকা গোঁফের রেখ । অধর ওষ্ট পাতলা ভিজে ভিজে , সেটার আকর্ষন এখনও অটুট । কপালের চারিপাশ থেকে স্প্রিং এর মত দোল খাওয়ানো চুল । আটোসাটো শরীর । শরীরের খিদেটা যাবো যাবো করেও কিছুটা রেশ রেখে গেছে ।খিদের ভারে নুইয়ে গেছে যৌবন । " মা, ভাত বসালেন না ? " ঊষার তীক্ষ্ণ কন্ঠে হুস ফেরে সদুর । সদু আনমনে উত্তর করে , -এই যাই । কি ভেবে ঊষাকে জিজ্ঞাসা করে সদু, - খোকা কি ফুন করিচিল বউমা ? ঊশার অবশ্য অবকাশ হয়নি একথার উত্তর দেবার , তার আর শাশুড়ির কথোপকথন চলে ধারাবাহিকের বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে । ছোট কঞ্চি দিয়ে পাতা ঠেলে ঠেলে উনানে জ্বাল তোলে সদু । দুই চোখের ছবিতে নীরবে জ্বলে আগুনের লকলকে শিখা । পুরুষ বিহীন দুই নারীর সংসার , যেন রাম ছাড়া রামযাত্রা । আধপোড়া , ঘুনে খাওয়া জীবন তার এই ভাবেই চলতে থাকে । একই গদ জীবনের, আহ্নিকগতির পাশাপাশি । রাত বেশ খানিকটা গড়িয়ে এসেছে, সদু নিভন্ত উনুনে ভাতের হাড়ি বসিয়ে রেখে দাওয়ায় বসে রাতের আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। রাতের কুহেলিকা চাঁদের আভায় মায়া বিস্তার করেছে, আর আকাশের গায়ে অসংখ্য তারার ফুটকি । রতনের কথা ভাবে সদু, সে ওই মানুষটাকে ভালোবাসতো , কিন্তু রতন কোনোদিন সদুকে ভালোবাসেনি, রতন ভালোবেসেছিল সদুর যৌবনকে । বুদু তখন বছর আটেক, রতন তখন তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল, সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার আর কোনো খবর পায়নি। সদুর মনে একটাই প্রশ্ন, বুদুও কি তার বাপের পথ ধরলো ? ঊষা সিরিয়ালের বিরতির ফাঁকে এসে গ্যাস ধরিয়ে তরকারি গরম বসালো । বেশ উত্তেজিত লাগছে তাকে , মনের ভিতরে চলছে যেন কোনো গোপন খেলা । সদু আড় চোখে , ঊষাকে দেখে নেয় বার কয়েক । মুখে ছাইপাঁশ কি সব মেখেছে, সদু বুঝে যায়, অভিসারিণী ঊষার রূপচর্চা চলছে। সে জিজ্ঞাসা করে, - বৌমা কাল কি কুতাও যাবে ? ঊষা গম্ভীর ভাবে বলে;- হ্যাঁ মা, কাল একটা কাজ আছে । সদু বোঝে কি কাজ, এই কাজেই যখন ঊষা যায় অনেক টাকা নিয়ে আসে ঘরে। কাজটা কি সেটা আন্দাজ করে কিন্তু জোর গলায় কিছু বলতে পারেনা । ঊষার এই অজ্ঞাত কাজের জন্যই বেঁচে আছে দুটো পেট। অনেক সাধ করে ছেলের বিয়ে দিয়েছিল সদু। বেশ ভালোই চলছিল তাদের তিনজনের সংসার, গ্রামের হাঁটে সব্জি নিয়ে বসতো বুদু। মোটামুটি সচ্ছল ভাবেই চলতো তাদের। মাটি আর চাঁচের বেড়ার বাড়ি আস্তে আস্তে পাকা হয়েছিল। সে বার যখন বন্যা হল, বুদু শহরের বাজারে অনেক কামিয়ে ছিল, সেটাই হলো বুদুর কাল। বেশি টাকার লোভে শহরেই শুরু করলো সব্জি ব্যবসা । সদুকে বলেছিল,- মা এবার আমি ছাত ঢালাই দেব। টিনের চাল আর রাখবো না । সদু, ঊষা দুজনেই খুশি ছিল । একদিন বুদু এসে বললো শহর থেকে অনেক দূরে এবার সে যাবে, সেখানে ব্যবসা করলে নাকি আরো অনেক লাভ হবে। ঊষা খুব খুশি মনেই মেনে নিয়েছিল কিন্তু সদু বাধা দিয়েছিল। বলেছিল,- নারে বাপ দুরি যেইয়ে কাজ নেই, একেন থেকি যা করার কর, আমার বড্ড ভয় নাগে । বুদু মায়ের কথা উড়িয়ে দিয়েছিল । যেদিন গেল বুদু, সেদিন থেকে আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার । কেউ বলে মার্ডার হয়ে গেছে, কুচক্রে পড়েছিল, কেউ বলে অন্য মাগী নিয়ে ঘর বেধেছে । যে যাই বলুক বুদু কিন্তু আর ফিরে আসেনা। বছর খানেক খুব কষ্টে কেটেছে তাদের। হাঁস, মুরগীর ডিম বেচে, বিড়ি বেধে । কিন্তু সদুর বুকের দোষ হয়ে যাওয়াতে সে আর বিড়ি বাঁধতে পারেনা। পেট আর চলতেই চায় না। তখন থেকেই শুরু হয় ঊষার অজ্ঞাত কাজ। তাই পেটের দায়ে সব কিছু জেনে বুঝেও চুপ করে থাকে সদু। এরকম অজ্ঞাত কাজ করে সেও একদিন বুদুকে প্রতিপালন করেছিল, রতনের অজ্ঞাতবাসের পর । তবুও ঊষাকে সাবধান করে, কারণ এই মেয়েটি ছাড়া সদুর আর কেউ নেই। তাই ঊষাকে বলে, - ভেবে চিন্তি পত চলো বউমা, মেয়েমানষিরি ভুলানো খুপই সুজা। পুরুষমানষিরি বিশ্বেস করুনি, পত্থম পত্থম সবই খুপ রঙ্গিল লাগে,তাপ্পর গতরখানা ভুগ করি ছাড়ি দেয়। ঊষা প্রচন্ড চটে গিয়ে বলে,-এসব কথা গুলো আমাকে কেন বলছেন এসব কথা আমাকে বলবেন না। সদু ততধিক নরম সুরে বলে, - আমি কি আর সাদে বলি, এ জেবনে কম তো দ্যাকলাম না, তুমার কাঁচা বয়েস, ভুল ভিরান্তি হতেই পারে তাই সাবদান করি দিইয়া। আমি তুমার খারাপ চাইনে বউমা। আমার কে আচে বলো তুমি ছাড়া। বুদু যে আমার কুতায় গেলো, জানতিও পারিনে কিচুই । ঊষা খুব চিন্তিত ভাবে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,-না মা, আমি সেরকম কিছু করবো না ।
ঊষা কথাটা বললো বটে কিন্তু তাতে কোনো জোর ছিলনা, যেন গভীর ভাবনা থেকে,পায়ে পায়ে কথা গুলো বেরিয়েএলো। সদুর কপালে তখন চিন্তার ভাঁজ, সে বুঝতে পারছিল ঊষার মনে তখন পরপুরুষ, শরীরে রতির বিচরণ। উনোনে গোবর লেপা দিতে দিতে নিজের কথাই ভাবছিল সদু। ভালোবাসার খোঁজ করতে গিয়ে নিজের গতরটা বিকিয়েছিল সে। তার গতর নিয়ে খেলে সবাই চলে গেছে, কিন্তু সদুর ভালোবাসা পাওয়া হয়নি। রতনকে সে খুব ভালোবাসতো কিন্তু রতনের ভালোবাসা বিছানায় শুরু হতো, আর বিছানায় শেষ, সারাদিন লোকটাকে আর ধারে কাছে পাওয়া যেত না । সে সব ভাবতে চায়না সদু কিন্তু তবু এসেই পড়ে রতনের ভাবনা। নতুন করে আবার বুকে মোচড় দিয়ে যায়। বাড়ির আনাচে কানাচে তখন ঝিঁঝির ডাক, গায়ের চাদর বেশ করে টেনে নিয়ে দাওয়া থেকে উঠে এসে উনোনের পিঠে এসে বসে শেষ তাপটুকু নেওয়ার জন্য। পাকা ইটের বাড়ি সদুর, টিনের চাল দেওয়া। একটাই ঘর, সেটা এখন ঊষার দখলে, ঘরের একপাশ থেকে সামনে পর্যন্ত এল প্যাটার্নের বারান্দা, সেটা চাচের বেড়া দিয়ে ঘেরা । পাশের বারান্দায় রান্নার জায়গা, আর বারান্দার শেষ প্রান্তে চারটে ইটের উপর একটা গ্যাস ওভেন, তারই এক কোণে ছোট্টো একটা তক্তাপোষে সদুর শোবার জায়গা। উনোনের শেষ ওম টুকু নিয়ে বিছানায় চলে যায় সে । ঊষা অনেক রাত পর্যন্ত টিভি দ্যাখে, তারই টুকরো কথা শুনতে শুনতে সদু কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ ঘুম এলোনা চোখে। নিজের অল্প বয়সের কথা মনে আসে । কত গোপন অভিসার, ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি । এই ভালোবাসার খোঁজ করতে গিয়ে তার গায়ে বেবুশ্যে তকমা লেগেছিল। সে সব কথা মনে আসতেই, নিভন্ত উনোনের শেষ ওমের মতই তার শরীরের কামনাটা আবার মোচড় দিল। মরা যৌবনে চিনচিনে সুখ অনুভব করলো। নিজের অজান্তেই, নিজের হাত গোপন অঙ্গে বুলিয়ে যায় ।
আজ ঊষাও একই পথে চলছে। সদু সাহস জোটাতে পারেনা ঊষাকে কিছু বলার, আর বলবেই বা কি, এই অজ্ঞাত কাজটুকু না থাকলে পেট যে তাদের চলবে না। কিন্তু ঊষা যদি কোনোদিন তাকে ছেড়ে চলে যায় তবে তাকে দেখবে কে ? অজানা আশংকায় শেষ যৌবনের ওমটুকু তার শরীর ছেড়ে চলে গেল। বিছানায় শুয়ে শুনতে পেল, বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর জলে,ছলাৎ ছলাৎ দাঁড় টানার শব্দ ।।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours