Fitire
স্বপন দাস, প্রবীণ সাংবাদিক, কলকাতা: খুব ছোট বেলায় পড়ে ছিলাম , জলই জীবন। আবার ওই ছোট বেলাতেই জেনেছিলাম , যে আমাদের পৃথিবীর তিনভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। তাহলে চারিদিকে এই জল আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে এমনটি ভাবছেন কেন সবাই ? ভাবার কারণ আর কিছুই নয়, কেন্দ্রীয় ভাবে সরকারি স্তরে , একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে সমস্ত জল শুকিয়ে যাবে। সে সব দেশের মধ্যে আমাদের দেশ এই ভারত ও আছে । রিপোর্টটা নিয়ে চারিদিকে বেশ হইচই পড়ে গেছে ,
তার কারণ হচ্ছে , এই রিপোর্টের শুরুতেই বলা হয়েছে যে ভারতে ৬০ কোটি লোক জলকষ্টে ভুগছে এবং বছরে দু’লক্ষ লোক ভালো জলের এভাবে মারা যায়। আর ওই রিপোর্টের একটি অংশে বলা হয়েছে যে দেশের ২১টি শহরের ভূগর্ভস্থ জল ২০২০ মানে আগামী বছর শেষ হয়ে যাবে। ফলে আমাদের কাছে এক চরম আঘাত হিসাবে নেমে এসেছে এই বাণী। আর এই বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমেও মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে বারে বারে।একটাই কথা বলা হচ্ছে যে জলের ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে, আর জলের অপচয় বন্ধ করতে। একটা ছোট্ট উদাহরণ হিসাবে দেখে নেওয়া যাক আমাদের শহর কলকাতায় এই জলকে আমরা কতটা সঠিক ভাবে ব্যবহার করে থাকি। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো যে , আমাদের কাছে জল খুব সহজলভ্য , পরিশুদ্ধ পানীয় জলের জন্য পুরসভাকে কোন রকম কর দিতে হয় না। তাই এই জল ব্যবহার আমাদের কাছে মিতব্যায়ী হিসাবে ব্যবহারের জন্য মানসিকতায় আসে না। আমরা প্রতিদিন গড়ে একজন প্রায় স্নান থেকে বাসন মাজা, ফ্ল্যাশ থেকে মুখ ধোয়া , আর অবশ্যই জল খাওয়া বা রান্নার জন্য ১৭৫ থেকে ২০০ লিটার জল ব্যবহার করে থাকি। এটাই একটি সাধারণ হিসাব। দেখা গেছে একটি বাড়িতে সাত জনের পরিবারের জন্য ৫০০ লিটারের জলের ট্যাঙ্ক দিনে তিনবার ভরতে হচ্ছে। অর্থাৎ সাতজনের জন্য যদি ১৪০০ লিটার জলের সর্বোচ্চ প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রে নষ্ট হচ্ছে ১০০ লিটারের মত জল। অন্য দিকে রাস্তায় থাকা অধিকাংশ ট্যাপ কলের মুখ নেই , নয়ত বা খোলা অবস্থাতেই থাকে , সেটি বন্ধ করে দেবার মত সময় আমাদের হাতে নেই, পড়েই চলে জল, অন্য দিকে রাস্তায় লক্ষ্য করলেই দেখবেন বিভিন্ন জায়গায় জলের পাইপ্লাইনে জল পরিবহনের সময় চাপের ভার সহ্য করার জন্য ভাল্ভ থাকে, সেই ভাল্ভের গোড়া দিয়ে অবিশ্রান্ত জল বেরিয়ে যাচ্ছে, যে কোন বুস্টার পাম্পিং স্টেশনে গেলেই দেখতে পাবেন কি হারে জল নষ্ট হচ্ছে বা অপচয় হচ্ছে। এভাবেই পুরসভার পরিশুদ্ধ জলের প্রায় ৪০ শতাংশ জল নষ্ট হয়। এত গেল একটা দিক, আমরা সাধারণ মানুষ যা জল ব্যবহার করে থাকি , প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অতিরিক্ত জলের অপচয় করে থাকি বেশি। একটি সমীক্ষা বলছে , যদি এক লিটার জলের প্রয়োজন হয় , আমরা যত কমই ব্যবহার করিনা কেন , কম পক্ষে চার লিটার জল ব্যবহার করবই। ফলে তিন লিটার জলের অপচয় হচ্ছে। এখন শহর কলকাতার ক্ষেত্রে গভীর নলকূপ খনন নিষিদ্ধ হলেও , বিভিন্ন আবাসনে , বা যে এলাকায় পুরসভার সরবরাহের জলের চাপ কম থাকার জন্য মানুষ জল পায় না। সেই জায়গায় গভীর নলকুপ খনন করে সমস্যাকে কিছুটা হলেও সামাল দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে মাটির তলার জলস্তর কমছে। শহর কলকাতার ক্ষেত্রে আগে বহু পুকুর ছিল। আজ সিংহ ভাগ পুকুর অতীত। ফলে জলভাগের একটা বিশাল অংশ এভাবেই হারিয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে পুকুর ভরাট হলেও একটি কমিটি থাকলেও , সেটি নজরদারি থেকে রক্ষা করতে পারছেনা ঠিক মত। ২০১৬-১৭ সালের একটি রিপোর্ট বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল , সেই সময়ে দেখা যাচ্ছে , ট্রাইব্যুনালের করা কমিটি মাত্র ৮৪টি অভিযোগ দায়ের করলেও , সেগুলির ফয়সালা আজো হয় নি। কয়েক বছর আগে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ছিলাম ।ওই প্রতিবেদনের শুরুটা একটু বলি , ”জল আমাদের জীবনে বেঁচে থাকার জন্য যেমন অপরিহার্য তেমনি আমাদের পরিবেশ সুরক্ষার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবেই মনে করা হয়ে থাকে ৷ আমাদের এই মানব সভ্যতার টিকে থাকা বা ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আমরা জলকে কি ভাবে ব্যবহার করব , সেটার ওপর। কেননা আমাদের এই পৃথিবীর মিষ্টি জলের উৎসের আয়ু ধীরে ধীরে কমে আসছে। আপাতদৃষ্টিতে এই বসুন্ধরা জলসম্পদে সমৃদ্ধ ৷ আমরা সেই ছোটবেলা থেকেই জেনে আসছি যে আমাদের এই পৃথিবীর তিন ভাগ জল ও এক ভাগ স্থল। তাহলে ? শুনলে হয়ত অবাক হতে হবে এই জলের ৯৭.৫% পান করা বা চাষের কাজে ব্যবহার করার পক্ষে একেবারেই যোগ্য নয় ৷ মিষ্টি জলের মোট পরিমাণ আড়াই শতাংশের মত ৷ তাও সহজলভ্য নয়৷ এই আড়াই শতাংশের ৬৯ শতাংশ আসে গ্লেসিয়ার বা হিমবাহ থেকে আর ৩০% জল মাটির নীচের ৷ একদিকে পৃথিবী থেকে মিষ্টি জলের উৎস কমে আসছে, অন্যদিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদা বেড়ে চলেছে৷ আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেক বা দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ পড়বে তীব্র জল সংকটের মুখে, যদি না জলের অপচয় রোধ করা যায়৷” ২০১১ সালে প্রকাশিত হওয়া ওই প্রতিবেদনের আশঙ্কাই সত্য হতে চলেছে। গবেষকরা বলছেন , ভারতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে জলসম্পদের সদ্বব্যবহার হয়নি৷ যেটা হয়েছে সেটা অস্থায়ী ও অসঙ্গতভাবে৷ তাদের মতে ,ভারতে মিষ্টিজলের উৎস মুলত দুটি ৷ একটি হল , হিমালয়ের হিমাবাহের গলিত জল , আর দ্বিতীয়টি হল বৃষ্টি থেকে পাওয়া জল ৷ হিমবাহ থেকে পাওয়া জলের ক্ষেত্রে কিছুটা টান পড়লেও , ওই গবেষকদের মতে ভারতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন তারতম্য হয়নি৷ খামতিটা রয়ে গেছে জলসম্পদ পরিচালন ব্যবস্থাপনায় ৷ কী পরিমাণ জল আমাদের কাছে আছে, আর জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ,জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাতে পানীয় জল কতটা দরকার ও প্রয়োজন , কৃষি ও শিল্প , কল-কারখানার জন্য কতটা জলের দরকার, মাটির নীচে থাকা জলের ব্যবহার সঠিকভাবে ও কীভাবে করা উচিত, তা করা হয়নি৷ আমাদের যে পরিমাণ জল পাই ,সেই জলের সিংহভাগ খরচ করা হয়ে থাকে কৃষিক্ষেত্রে৷ এমনটাই মত গবেষকদের। এর কারণ হিসাবে তাঁরা বলেন , যে আমাদের খাদ্যের চাহিদা মেটাতে , আমরা বছরে দুইবারের বেশি চাষাবাদ করে থাকি। এই চাসাবাদের জন্য বর্ষাকালে জলের খুব একটাঅসুবিধা হয়না৷ যা অসুবিধা হয় বছরের অন্য সময়ে ৷ তখন আমরা মাটির নীচে থাকে জলকে পাম্পের সাহায্যে তুলে বেশি করে ব্যবহার করে বা চাষাবাদের কাজে লাগাতে থাকি । ব্যবহার করার জন্য বসানো হয় হাজার হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ৷ আমাদের দেশের জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান অবস্থার কারণে জলের ব্যবহারও বেড়েছে ঘর-গৃহস্থালিতে,সঙ্গে শিল্প কারখানাগুলিতে ৷ অন্যদিকে সারা বিশ্বের ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা বিশ্ব উষ্ণায়ন , এর কারণেও জলের বাষ্পীভবন হচ্ছে বেশি৷ তাতে দেখা যাচ্ছে , চাহিদা জোগানের ব্যবধান বাড়ায় মাথাপিছু জলের পরিমাণ অনেক কমে গেছে ৷ এমনটাই মত গবেষকদের। ভূগর্ভস্থ জলের কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা আজো আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ ভূগর্ভস্থ জলের ওপর নির্ভরশীল , আর মাটির তলার জলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে যা জল তোলা হয় , তার মাত্র এক শতাংশ ব্যবহার হয় এই পানীয় জলের ক্ষেত্রে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে এখনও বহু জায়গায় কুয়োয় ওপর নির্ভরশীল বহু মানুষ। একটা সমীক্ষা বলছে দেশের গভীর কুয়ো গুলির মধ্যে অর্ধেকের বেশি কুয়োয় জল নেই। এই সংখ্যাটা ১৪৪৬৫টি কুয়োর মধ্যে জল নেই ৮৭৮৫ টি কুয়োতে। ফলে সারা দেশে জুড়েই একটা কঠিন পরিস্তিতি তৈরি হতে চলেছে।
গবেষকরা বলছেন , একমাত্র ভুগর্ভস্থ জলের ক্ষেত্রে অপচয়ের মাত্রা কমাতে হবে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে,ব্যবহারিক ক্ষেত্রে জলের ব্যবহারের ক্ষেত্রে মিতব্যয়ী হতে হবে অপচয় রোধ করে , বৃষ্টির জলকে ধারণ করে রাখতে হবে , পরিবেশে সবুজায়ন করে বৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করা , এবং জলাশয়গুলিকে রক্ষা করতে পারলেই , এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে নতুবা, সভ্যতা জলের অভাবেই এক সময়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। ফলে সমস্যা তৈরি করেছি আমরা , সমাধান আমাদেরই করতে হবে।



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours