প্রতিম বসু, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতা: দ্বিতীয়বারে ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেই নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও উন্নত করতে মনোযোগী হয়েছেন। যদিও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেন্দ্রীয় বাজেট, কর্নাটক বিধানসভা ইত্যাদি ইস্যুর নানা ভিড়ে এই সংবাদ গণমাধ্যমে তেমন ভাবে উঠে আসেনি। তবু দেশের প্রধানমন্ত্রী মোদি যা চেয়েছেন তা সত্যি হলে দুদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক শুধু মজবুত হবে না, উপমহাদেশে পারস্পরিক সহযোগিতার এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করবে। ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার অধ্যায় শুরু হয় ২০১০ সালে। ভারতের পক্ষ থেকে উদ্যোগ শুরু হয়েছিল আরো বছর ছয়েক আগে, কিন্তু তেমন ফল হয়নি। শেখ হাসিনা সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেয়। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিল্লির মনমোহন সিং সরকার পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য স্বল্প মূল্যের ঋণ ও অনুদান মিলিয়ে এক বিলিয়ন ডলার দেয়।
সেই সময়ে দুদেশের পক্ষেই অঙ্কটা বেশ বড় ছিল। সহযোগিতাটা অবশ্য টাকায় আটকে ছিল না। ২০১১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ভারত খুব সামান্য কয়েকটি জিনিস বাদে বাংলাদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে সব রকমের বিধিনিষেধ তুলে নেয়, যাতে বাংলাদেশি রপ্তানি বাড়ে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ রপ্তানি শুরু হয়। স্থলসীমান্ত নিয়ে চুক্তির উদ্যোগও এই সময়ে নেয়া হয়। সমস্যা হলো সহযোগিতাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে পরিকাঠামোগত যেসব উন্নয়ন করা দরকার মনমোহন সিং সরকার তার প্রায় কিছুই করতে পারেনি বা করেনি। সে কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি দিল্লির তখতে বসার পর। আর তার ফলও হাতেনাতে দেখা যাচ্ছে। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের ভেতর বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি কমেছিল প্রায় ১১ শতাংশ। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ বাংলাদেশি অর্থবর্ষের ভেতর রপ্তানি প্রায় দ্বিগুণ (৯১ শতাংশ) বেড়েছে। একই সময়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। (এর একটা কারণ মোদির আমলে ভারতীয় অর্থ সাহায্যের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে) যেহেতু ভারতীয় রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেশি ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে। কিন্তু আরেকভাবে দেখলে বাংলাদেশ কম দামে বেশি জিনিস কিনতে পেরেছে। অর্থাৎ লাভ দুজনেরই। নৌচলাচল, উপক‚লবর্তী জাহাজ চলাচল, বিমান যোগাযোগ, ভিসা পরিকাঠামোগত এমন কোনো বিষয় নেই গত পাঁচ বছরে যার উন্নতি হয়নি। কলকাতা থেকে দিল্লি যেতে যা বিমান ভাড়া লাগে, তার থেকে কম খরচে এখন ঢাকা যাওয়া যায়। ফলে বাণিজ্যের খরচ কমেছে এবং আরো কমবে। অর্থাৎ শুধু বাণিজ্য বাড়েনি, তেল থেকে বিদ্যুৎ, গাড়ি থেকে গার্মেন্টস সম্পর্ক বহুমুখী হয়েছে। তার ভিত এখন আগের থেকে অনেক শক্ত। আগামীর পরিকল্পনা হলো এই ভিতকে এতটাই শক্ত করা, যাতে কোনো দেশই তাকে অস্বীকার না করতে পারে। মে মাসে ক্ষমতায় বসার দুই সপ্তাহের ভেতর মোদি সরকার তার দপ্তরগুলোকে নির্দেশ দেয় বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর বাণিজ্যিক যোগাযোগ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিতে। ত্রিপুরার আখাউড়া সীমান্ত বাদ দিলে এ অঞ্চলের বাকি সীমান্ত গেটগুলোতে বাণিজ্যিক পরিকাঠামো খুবই দুর্বল। ভারতের সরকারি সংস্থাগুলো এখন নাওয়া-খাওয়া ভুলে প্ল্যান বানাচ্ছে কী করে অন্তত হাফ ডজন গেটে আগরতলা সীমান্তের মতো বাণিজ্য ও দর্শনার্থীদের যাওয়া-আসার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়। মোদির যা মেজাজ, কারো বসে থাকার জো নেই। নিশ্চিন্ত থাকুন পাঁচ বছরে প্রকল্প অনেকটাই বাস্তবায়িত হবে। শুধু এটাই নয়। বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে লম্বা লাইনের কারণে বাণিজ্যের সময় ও খরচের বহর সবার জানা। নতুন প্রকল্পে শান পড়ছে, ট্রাকগুলো কলকাতা অবধি এসে মালগাড়িতে উঠে রাস্তা এড়িয়ে সোজা স্থলবন্দরে চলে যাবে। লক্ষ করার বিষয়, ভারত শুধু দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটাচ্ছে না। ফুলবাড়ি ও চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তের সঙ্গে সংযোগকারী নতুন হাইওয়ে বা আসামের যোগীঘোপায় নির্মীয়মান মাল্টি-মোডাল টার্মিনাল বাংলাদেশের সঙ্গে নেপাল ও ভুটানের সস্তায় বাণিজ্যের রাস্তা খুলছে। কন্টেইনার ব্যবহার করলে সীমান্তে দাঁড়াতেও হবে না। ইলেকট্রনিক সিল লাগিয়ে ভারত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভুটানে বাণিজ্য চলবে। এগুলো অবশ্য মোদি সরকারের প্রথম দফার কাজ। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে মোদি এর পরিধি আরো বাড়িয়েছেন। সবার জানা, পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ হলে ভারত থেকে রেলে মাল বহনের রাস্তা খুলবে। রাস্তার থেকে রেলে পরিবহনের খরচ অর্ধেকেরও কম। ফলে কম খরচে ও তাড়াতাড়ি মাল পাঠানো যাবে। ভারতে মালগাড়ির জন্য নতুন লাইন (ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডোর) হচ্ছে। তা দিয়ে বাংলাদেশি গার্মেন্টস দু-দিনের ভেতর কলকাতা থেকে মুম্বাই পৌঁছবে। মোদি চাইছেন বাংলাদেশ ভারতের পশ্চিমতটের বড় পোর্ট দিয়ে বিদেশে গার্মেন্টস রপ্তানি করুক। বাংলাদেশের লাভ দুটো চট্টগ্রাম ছোট পোর্ট বলে বড় জাহাজ আসতে পারে না। মাল ক্লাং বা কলম্বো হয়ে যেতে সময় লাগে। বড় পোর্ট বানানো যায় তবে তার খরচ অনেক। আর বানালেই যে বড় জাহাজ কোম্পানি আসবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। কিন্তু ভারতের মুন্দ্রা বা মুম্বাই বন্দরে এরা আসে এবং পরিকাঠামো ভালো হওয়ার কারণে খরচও কম। ভারতের লাভ দুটো। প্রথম মাল পরিবহন বাড়লে বন্দর, রেল সবার লাভ। এবারের বাজেটে ভারতের পোর্ট দিয়ে অন্যান্য দেশের পণ্য পরিবহন (ট্রান্সশিপমেন্ট) বাড়ানোর লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয়ত এবং মুখ্য উদ্দেশ্য উপমহাদেশে সন্দেহ আর রক্তক্ষয়ী প্রতিযোগিতার আবহকে শেষ করা। আরেকটা তৃতীয় লক্ষ্যও আছে বলে মনে হয়। আসলে চীন পরিকাঠামো উন্নয়নের মধুর কথা শুনিয়ে সহযোগী দেশগুলোকে বিশাল পরিমাণ ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলছে পরিকল্পিত ভাবে।
নেপালের কাঠমান্ডু থেকে শুরু করে চীনের শিগাতসে পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কি. মি. রেলপথের জন্য নেপালকে নাকি প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার গুনাগার দিতে হবে লাল সেনার দেশকে। কিন্তু পাশাপাশি ভারতের রেল ও পোর্ট ব্যবহার করার জন্য বাংলাদেশকে এমন কোনও গলায় গামছা দিতে হবে না ঋণ খাতে, শুধু নূন্যতম ভাড়াটুকু বহন করলেই চলবে। ভারতের এই উদার স্বদিচ্ছার ফলে বাংলাদেশেও এই দ্বিপাক্ষিক সহযোগী প্রস্তাবে খুবই উৎসাহ দেখাতে শুরু করেছে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours