Fitute
রণজিৎ গুহ, প্রাক্তন ইস্পাত কর্মী, সমাজকর্মী ও লেখক: কলকাতার চলচ্চিত্র শিল্প সংশ্লিষ্ট সকলেই নানা প্রসঙ্গে কলকাতার বাইরের দর্শকদের রুচি ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।খ্যাতিমান পরিচালক কিংবা সংবাদপত্রের সিনেমা লিখিয়ে সকলেই নানা কায়দায় দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন যে কেবলমাত্র কলকাতার দর্শকেরা ভাল ছায়াছবি বোঝেন ও উপযুক্ত মর্যাদা দেন।এ রাজ্যের বাকি সব মানুষের পড়াশোনা, বোধ,মনন, দক্ষতা, রুচি সবই নিম্নমানের। এইসব পরিচালক প্রযোজক সিনেমা বোদ্ধা বিশ্লেষকরা শহুরে ঔদ্ধত্যে কলকাতার বাইরের দর্শকদের অপমান করেন।যেন গ্রাম বাংলার সকলেই পচা মালের ক্রেতা। কলকাতার মানুষ যেন পরম বিশুদ্ধবাদী।পরীক্ষিত সুগন্ধ পুষ্প ছাড়া অন্য কিছু ছুঁয়েও দেখেনা। শুধুমাত্র চলচ্চিত্র দর্শকদের মধ্যে এ ব্যাবধান টানা হয় তা নয়।বিনোদনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কলকাতার বাবুদের অপরিসীম উন্নাসিকতা। সঙ্গীত শিল্পীরা মফস্বলের আয়োজনকে মাচা বলে হেয় তাচ্ছিল্য করেন।
ঠাট্টা মজা করেন। মফস্বলের মানুষের সঙ্গীত জ্ঞান কে উপেক্ষা করেন।সাহিত্য পরিমণ্ডলেও একই ধারা।কলকাতার কবিরা কদাচিৎ মফস্বলি কবিতা চর্চার খোঁজ খবর রাখেন।এই শহুরে কবি সাহিত্যিকরা কলকাতার বাইরের অনুষ্ঠানে এসে হাজারো স্বাচ্ছন্দ ও বিলাস দাবী করেন।অন্যদিকে মফস্বলের কোন কবি কলকাতায় গেলে সাধারণ আপ্যায়ন জানাতেও এগিয়ে আসেন না। সাধারণভাবে প্রকৃতিগত আবেগ প্রকাশের সরল ভঙ্গীকেই গ্রাম্য আখ্যা দিয়ে শহুরে বাবুরা এক মনগড়া পরিশীলিত জগতে বাস করেন।তাঁরা নিজেরা নিজেদের মত করে শিল্পের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে আপন বৃত্তে বুঁদ হয়ে থাকেন।বৃত্তের বাইরে থেকে যায় সাত কোটি মানুষ। প্রাকৃতজনের প্রতি অবজ্ঞা ও অনুকম্পা শহর কলকাতার মানুষজনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কলকাতার বাবুমশাইরা ঠিক করে দেন কোনটা ভাল কোনটা মন্দ।কোনটা উচিৎ কোনটা অনুচিত। কোনটা শ্লীল বা কোনটা অশ্লীল। কোনটা সংস্কৃতি আবার কোনটা অপসংস্কৃতি। বাকি সাত কোটি মানুষ তা নির্বিবাদে মেনে নেবে। এমনটাই বাবুদের প্রত্যাশা। শহর কলকাতার বাইরের মানুষরা কিছুটা বিষ্ময়ে কিছুটা বিহ্বলতায় এবং নির্বিরোধ মানসিকতায় এসব অপমানের প্রতিবাদ করেন না।প্রতিক্রিয়া জানান না। সুযোগ সুবিধার সাড়ে পনের আনা ভোগ করেও আশ মেটে না। শিষ্টতার দোহাই পেড়ে মানুষের আশা আকাংখা বা ক্ষোভ বিক্ষোভ তুড়ি দিয়ে উড়িয়ে দিতে চান। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিপত্তি সবটাই দখল করে এখন আমাদের খাদ্য খাওয়া পোশাক-আশাক নিত্যকার ভাল লাগা না লাগাকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। তাদের মতানুসারী না হলেই উজবুক বলে দেগে দিচ্ছে। সম্ভবত আমরা উজবুকই।সে কারণে নিজেদের পছন্দের কথা বলতে সংকুচিত হই।নিজস্ব সম্ভারে বিশ্বাস প্রত্যয় রাখিনা।হলদিয়া দুর্গাপুর মিলেমিশে চলে না।শিলিগুড়ি সাইথিয়া সোজাসুজি জোট বাঁধে না।মেদিনীপুর জলপাইগুড়িকে ডাকে না।বনগাঁ কোচবিহারকে সম্মান জানায় না।ফলে কলকাতা পেয়ে বসে। কলকাতার মানুষরা সাংস্কৃতিক আধিপত্য খাটাতে মফস্বল বিজয়ে এসে আমাদের কৃতার্থ করে।আমরাও আপ্যায়নে গদগদ হই। যারা আমাদের বুদ্ধিমত্তা ও রুচিবোধ খাটো করে দেখে তাদের বিনোদন ব্যাবসায়ে আমরা সহায়ক হব কেন?
কলকাতার বাইরের সাত কোটি মানুষকে বাদ দিলে কলকাতার জ্ঞানী মানুষদের ভাত কাপড়ে টান পরবে। আমাদের শিষ্টতা বোধ যেন আমাদের সোজা কথা বলার সাহসকে নষ্ট না করে দেয়।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours