মোনালিসা মুখোপাধায়, ফিচার রাইটার হুগলিঃ
শৃঙ্গার।
শ্রীরাধার মেঘকালো চুলে ফুল গুঁজে দিলেন শ্রীকৃষ্ণ। চোখে কাজল।
বিদায়বেলা আসন্ন শকুন্তলার। দুই সখী অনুসূয়া, প্রিয়ম্বদে সাজিয়ে দিলো তাকে। যত্ন করে, নিজেদের হাতে।
কলির শকুন্তলা। সন্ধেলগ্নেই বিয়ে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে না হতেই চলে পার্লারের বিউটিশিয়ন। সময় লাগবে বৈকি। বিয়ের সাজ বলে কথা।যত টাকার প্যাকেজ সেই মত সাজ। লাস্যময়ী সুন্দরী কনে সাজানোর প্রসাধনীর পশরা রেডি।
সাজানো মানেই সুন্দরের ছোঁয়া। আর সেই সুন্দরতা লুকিয়ে প্রিয়জনের পার্সোনাল টাচে। সেই টাচে স্নেহ, ভালবাসা ছড়িয়ে পড়ে একের থেকে অন্যের শরীরে। আগেকার সেই আবেগটাই গেছে হারিয়ে।
"সখীরে সাজাব সখার প্রেমে
অলক্ষ্য প্রাণের অমূল্য হেমে!"
যন্ত্রসভ্যতা। যান্ত্রিক জীবন। যন্ত্র ঢুকে পড়েছে সাজঘরেও।
গান। এক শটেই কাজ সারা।
মাথা ছেঁদা করে বেরিয়ে যেতে পারে।
ফুঁড়ে দিতে পারে বুক।
আবার নাকছেঁদা করতে গেলেও গানের এক শট। সাজঘরেও গান। জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে গেছে যন্ত্র। যান্ত্রিক জীবন। এখন আর অনুসূয়া, প্রিয়ম্বদারা নেই। সাজগোজের গোটা কনসেপশনটাই গেছে পাল্টে। তাই আজ সাজার ঠিকানা পার্লার। আবেগের ছোঁয়ায় না, প্রফেশনাল হাতের ছোঁয়াতেই সেজে ওঠে একালের সুন্দরীরা।
আধুনিক পরিবেশের দ্রুতগামী হাওয়ায় ধুঁকতে ধুঁকতে অবশেষে, হারিয়ে গেছে আবেগ,হারিয়েছে আদরের বৌদি বা কাকিমার হাতের ছোঁয়া। নিজের না থাকলে পাশের বাড়ির নাহলে পাড়ার বৌদিদের নিপুণ হাতের জাদুতে সেজে উঠত নববধু হতে চলা
লাজুক মেয়েটি। সবই আজ ধূসর অতীত।
মেয়ে একটু বড় হলেই আদরের ডাক- আয়, তোর নাক বিঁধিয়ে দিই। পাছে মেয়ে ভয় পায়, তাই একটু সুন্দরী হওয়ার লোভে সুড়সুড়ি।
- 'এত মিষ্টি চাঁদপানা মুখ। নাকে একটা নাকছাবি পরলে দেখবি কী লাগবে!'
তারপর একদিন ছুঁচ আগুনে পুড়িয়ে পট করে নাক বিঁধে দেওয়া। ফুটো যাতে না বুজে যায়, তাতে একটা নিমকাঠি গুঁজে দেওয়া। নিমই কেন? কারণ নিম অ্যান্টিসেপ্টিক। আবার পেকে-টেকে গেলে কাচা হলুদ বাটা। তারপর এল মারকিউক্রোম, লাল নীল ওষুধ।
একটু করিৎকর্মা ঠাম্মা দিম্মার পাল্লায় পড়লে, নাকের নাম করে কানটাও ফোটানো হয়ে যেত। আর সেই সঙ্গে চাপে পড়ে যেত মা বাবা।
আবার দামাল মেয়েরাও ছিল। নিজে থেকেই ঠাকুমা দিদিমাকে ধরে ওসব কাজ সেরে আসতো।
আমি বরাবরই ভীতুর ডিম, মা বলে। তবে ঠাকুমা কোনদিন আমার কোনও দোষ দেখতে পেতো না। সুযোগ পেলেই আমায় একটু আদর-টাদর করেই আবদারের সুরে বলতো, 'আয় মুনু, নাকটা বিঁধিয়ে নে।' তারপর চলতো আমার রূপবন্দনা। 'এতো মিষ্টি, ভরা মুখখানা আমার নাতনির। তোর বাবাকে বলবো একটা খুব সুন্দর নাকফুল গড়ে দিতে। হীরে দিয়ে। দেখবি তারপরেই পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে, টগবগ করে এক রাজপুত্র আসবে। তোর মুখের দিকে তাকিয়ে আর চোখ সরাতে পারবে না। তোকে নিয়ে যাবে।'
কিন্তু ভবি ভোলার নয়।
তখন মাঝেমধ্যেই বাবার ছুটিছাটাতে হাজারিবাগ যেতাম। সেখানেই মামাবাড়ি। ঘটনাচক্রে সেখানেই আমার কানফোটানোটা হয়ে গেছিলো। তাও রীতিমত জোরজার করে। রুপোর দুল দিয়ে আমার কান বিঁধিয়ে দিয়েছিল দ্বারিকা সোনার। আজও ভুলিনি। তারপর সেকি কান্না!
আজ আমি অনেকটাই বড় হয়েছি। আর মাথার চুলে পাক ধরেছে মা-বাবার। অনেক সময় ভুলভাল করে ফেলে। তাল কেটে যায় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দের। তখন মাঝেসাঝে একটু-আধটু গার্জিয়ানি ফলানোর সুযোগ পেয়ে যাই। ব্যাস, অমনি মা সেসব পুরনো কথা পেড়ে বসে।
কান ফোটানোর পর, আমার কান্নার বহর দেখে নাকি থতমত খেয়ে গেছিল দ্বারিকা সোনার। বিটিয়ার কান্না থামাতে সে গান ধরেছিল, ঝুমকা গিরা রে। ছুটে এসেছিল মামীমা। কান্না থামাতে মামীর কোলে সারা বাড়ি ঘুরেছিলাম।
একদিন সকালে আচমকাই, হুড়মুড় করে সুপ্ত স্মৃতির দরজায় এক আগন্তুক কড়া নেড়ে গেল।
তাড়াহুড়ো করে রান্না সারছি। অফিস বেরোতে হবে। এফএমে কিশোর লতার পুরনো গান। আচমকাই কানে এলো, নাক কান ছেদাইয়েগা। জানলা দিয়ে উঁকি মারলাম। এই সুর তো কোন অতীতের! তখনও সে হাঁক পেড়ে চলেছে, বর্তন মে নাম লিখাইয়েগা। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। যেন সেই হাজারিবাগে ফিরে গেছি। সেই মেয়েবেলার দিনগুলিতে। চড়া রোদে সেই মলিনবেশ মানুষটার করুণ সুর। পথের বাঁকে কখন যেন হারিয়ে গেছে মানুষটা। আমি তখনও তাকিয়ে। আর কোনদিন হয়ত কানে আসবে না সেই হারানো সুর। ফিরে আসবে না স্মৃতির ওই মানুষটাও।
কিন্তু মানুষটা কিসের আশায় এই রোদ্দুরের মধ্যে পথে ঘুরছে? আজকালকার মেয়েরা কি কেউ ওই লোকটার কাছে কানফোটাতে বসবে? মনে তো হয় না। এখন তো পদে-পদে পার্লার। সেখানে গেলেই সাজগোজের পুরো পাঠ পড়া হয়ে যায়। অধিকাংশ পার্লারেই অপটু শিক্ষক শিক্ষিকা। হেয়ার স্টাইল থেকে নিয়ে স্পা,ফেস ম্যাসাজ সবকিছুই। বললেই বেরিয়ে আসবে গান। তার এক শটেই নাক, কান সব ফুটো। হয়ত কম যন্ত্রণাদায়ক। আর যন্ত্রণা হলেও কান্নাকাটির অপশন নেই। বাবা-বাছা করে মাথায় হাত বুলিয়ে স্নেহমাখানো হাতের নাক-কানফোটানোর স্বাদ পেলো না এই প্রজন্ম।
শুধু নাক-কান সাজালেই তো চলবে না। সুন্দর পটলচেরা চোখও চাই। তাই রেওয়াজ ছিলো
কাজল পরানোর। প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই মা, কাকিমাদের যেন আর তর সইতো না।
'বেশ টেনে-টেনে মোটা করে দু'চোখে কাজল পরাবি। মাকে পাখিপড়া করাতো ঠাকুমা। ওই পূণ্যকম্মটি করা তখন ঠাম্মার সাধ্যের বাইরে। তাঁর চোখে তখন ছানির পর্দা।
সে কতই না ঘটা! তখন তো আর বোতলবন্দি সোনার মতো তরল সর্ষের তেলের চল ছিলো না। বাবা রীতিমত ঘানির টাটকা তেল নিয়ে আসতো। সেই বিশুদ্ধ সর্ষের শুদ্ধ তেলের প্রদীপ জ্বেলে, তার ওপর উপুড় করে রাখা হতো বাটি। সেই বাটির গায়ে প্রলেপ জমতো কাজলের। তারপর সকাল-সন্ধ্যায় চোখে টেনে-টেনে ইয়া চওড়া করে কাজল পরানো। তাতে নাকি পটলের মতো বড়ো-বড়ো চেরাচোখ হবে। বাড়বে চোখের জ্যোতি। চোখে কাজল পরানো হয়ে গেলে, কপালে কাজলের টিপ। কারও যেন নজর না লাগে!
ঠিক যেমনটা লাগতো তখনকার নায়কদের। সিনেমার নায়িকারাও তখন অমন মোটা করেই কাজল পরতো। আর তাই দেখে নায়করাও গাইতেন- ওগো কাজলনয়না হরিণী!
দিনকাল পাল্টেছে। শিশুচোখে কাজল পরানো মানা। ইনফেকশনের আতঙ্ক। বড়রা পরে। বাজারে কাজল পেন্সিল কিনতে পাওয়া যায়। সেই কাজল অতি সূক্ষ্ম ভাবে পরাই আজকের ট্রেন্ড। পার্লারে গেলে তো কথাই নেই। দু'চোখে দু'কুচি শশা গুঁজে বসিয়ে রাখবে।
চুলের বাহার ছিল অন্যরকম।
সুন্দরী মানেই কোমর ছাপানো একরাশ চুল। তখনও সেভাবে শ্যাম্পুর চল হয়নি। শ্যাম্পু বলতে তখন লিঙ্গার। তারও পরে হ্যালো। তবে সবারই বেশি ভরসা ছিল রিঠাতে। রাতে গরমজল করে রিঠা ভিজিয়ে রাখতো মা। পরদিন সকালে সেই রিঠা চটকে জলটা ছেঁকে নেওয়া হতো। তারপর সেই জল দিয়ে মাথা চুল ঘষে সাফ করা। তেল বলতে ছিল জবাকুসুম, মহাভৃঙ্গরাজ। সব নাম এখন আর মনে পড়ে না। ঠাকুমা অনেকটা তেল নিয়ে ঘষে-ঘষে চুলে মেখে দিতো। ওই তেলে শুধু যে চুল সুন্দর হতো তাই না। সবার বিশ্বাস ছিল, ওই তেল মাথা ঠান্ডা রাখে।
তবে স্মৃতি সততই সুখের না। আট-দশ বছরের মেয়েকেও স্কুলে দেখা যেত মাথায় স্কার্ফ বেঁধে। কেন? মা-ঠাকুমা ঘরে নাপিত ডেকে মেয়ের চুল চেঁছে দিতো। যে যতবার নেড়া হবে, তার চুলের গোছ নাকি তত দেখার মতো হবে।
তারপর সেই লম্বা চুলে বাঁধা হতো বিনুনি।
'সই ভালো করে বিনোদবেণী বাঁধিয়া দে!'
বেড়াবিনুনি, কলাবিনুনি, খেজুরপাতা বিনুনি। মাথায় ঢাউস খোপার ফ্যাশনও একসময় জোর ধরেছিল। এরইমধ্যে এক ভিন্ন গোত্রের স্টাইল এনেছিলো বলিউডের সাধনা। কপালের ওপর পড়ে থাকা ছোট কয়েক গাছা চুল। মাকে দেখতাম, ওরকম চুল আঁচড়াতে।
এরপরে এলো টপনট, পনিটেল। তবে প্রয়াত ইন্দিরা গাঁধির হেয়ার স্টাইল কিন্তু সবার নজর কাড়ত। একেবারেই আলাদা।
সাজগোজ তো হলো। কিন্তু মুখের রংখানা ফর্সা না হলে গোটাটাই যেন ভস্মে ঘি ঢালা। তাই, ত্বকের যত্ন নিন। কিভাবে? ফর্সা হওয়ার কত ক্রিমই তো বাজারে এলো গেলো। কিন্তু আগের প্রজন্মের তুহিনা, বসন্তমালতী চুটিয়ে রাজ করেছিল। আর বোরোলিনতো আজও টিকে আছে।
তবে মা, ঠাকুমাদের ভরসা ছিলো ঘরোয়া টোটকায়। নিয়ম করে মুখ ঢাকতো মুসুর ডালবাটা, দই, বেসন আর দুধের সরে। এখন সে সব পাট চুকেছে। হাত বাড়ালেই নামীদামী কোম্পানির ফেস প্যাক। মুখের জেল্লা আরও বাড়াতে চান? নো প্রবলেম। পকেটে রেস্ত থাকলেই হলো। পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল করে আসুন। এখন তো আবার দিনের এক রাতের জন্য আরেক ক্রিম।
বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে লড়াইয়ে হেরে গেছে সেই আফগান স্নো আর পাউডার। চোখে পড়ে না মহাভৃঙ্গরাজ, জবাকুসুম তেল। পুরনো সাজঘরের জায়গা নিয়েছে পার্লার।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours