Fiture
সুখময় ঘোষ, লেখক, শ্রীরামপুর ঃ  
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যখন সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক হিন্দু জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটানোর চেষ্টা চলছে যেখানে বহু জাতি ও ধর্মের এই দেশে আমাদের ভারতীয় পরিচয়ের চাইতেও বড় করে তোলা হচ্ছে হিন্দু পরিচয়কে তখন বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের পথিকৃৎ ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে মনে পড়ে । যে আন্দোলন দেশের ঐক্য এবং নীতি ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে চালিত হয়েছিল । বিপানচন্দ্রের মতে – হিন্দু জাতীয়তাবাদের ভেকধারী সাভারকারের মত এই আন্দোলন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয় ছিল না । বলা যেতে পারে বাংলার বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিল ব্যারিস্টার মিত্রের নেতৃত্বে এই বিপ্লবী আন্দোলন । হিন্দু আদর্শে আন্দোলনের কর্মকান্ডকে চালিত করলেও তা কখনই সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের রূপ নেয়নি । নরমপন্থার বিরোধীতায় চরমপন্থাকে আদর্শ করে আগ্রাসী ভাবধারায় ১৯০২ সালে ২৪মে সতীশচন্দ্র বসু গঠন করেছিলেন ‘ভারত অনুশীলন সমিতি’ । নিরালম্ব স্বামীর অনুগামী সতীশচন্দ্রের এই সমিতি প্রারম্ভিক লগ্নে ছিল মূলত শরীরচর্চার কেন্দ্র । এই নিরালম্ব স্বামী বা যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলা যেতে পারে বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা । তাঁর অনুপ্রেরণায় ভারত অনুশীলন সমিতি নতুনভাবে গঠিত হলে এই সমিতির প্রথম সভাপতি হন প্রমথনাথ মিত্র । সহ-সভাপতি ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ এবং চিত্তরঞ্জন দাশ । সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর কোষাধ্যক্ষ । পরবর্তীকালে এই সমিতির নাম বদল করে শুধু অনুশীলন সমিতি রাখা হয় । ১৮৩৫ সালের ৩০ অক্টোবর নৈহাটির এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রমথনাথের জন্ম । অত্যন্ত মেধাবী ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী প্রমথনাথ বাল্যকালেই তাঁর গ্রামে শরীরচর্চার আখড়া গড়ে তোলেন । তাঁর বিশ্বাস ছিল শক্তিশালী যুব সম্প্রদায়ই একমাত্র বিদেশী রাজশক্তিকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারে । মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রমথনাথ ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টাত পড়তে যান । এই বিদেশ যাত্রার কারণে নৈহাটির রক্ষনশীল সমাজ পিতা বিপ্রদাস মিত্রকে সমাজচ্যুত করে । এই মানসিক অত্যাচারের কারণে বিপ্রদাস খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহন করতে বাধ্য হন । বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দের রচনায় অনুপ্রাণিত প্রমথনাথ ১৮৭৫ সালে লন্ডনের লিংকন ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যারিস্টার পাশ করে দেশে ফিরে বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন । ইংলন্ডে থাকাকালীন হাঙ্গেরী ও অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যোশেফ মাৎসিনি এবং গিসেপ গ্যারিবন্ডির বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের দ্বারা তিনি দারুনভাবে প্রভাবিত হন । আয়ারল্যান্ড ও রাশিয়ার বিপ্লবীদের চিন্তাধারা তাঁর জাতীয়তাবাদকে উসকে দিয়েছিল । এই বৈপ্লবিক মতাদর্শই তিনি অনুশীলন সমিতির যুবশক্তির মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন । বাল গঙ্গাধর তিলকের চরমপন্থী আন্দোলনের উপর আস্থা রেখে প্রমথনাথ সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন অনুশীলন সমিতির শাখা । এর মধ্যে পুলিন বিহারী দাসের নেতৃত্বে ঢাকা অনুশীলন সমিতি বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল । প্রমথনাথ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের ভাব-শিষ্য । হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিকাশই ছিল তাঁর স্বদেশ প্রেমের মূল উদ্দেশ্য । হিন্দু ধর্মকে তিনি কোন সাম্প্রদায়িক পথে পরিচালিত করেননি । বরং বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন তত্ত্বকে সামনে রেখে তিনি জাতীয় ঐক্য ও মূল্যবোধের ধ্যানধারনাকে জাতীয়তাবাদের উপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । অনুশীলন সমিতি ছিল একটি গোপন সংস্থা । রাজনৈতিক ডাকাতির সাহায্যে সমিতির জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হত । ডাকাতির নিষ্ঠুরতাকে এড়িয়ে নৈতিক দিকটার কথা তাঁরা মাথায় রাখতেন । সদস্যরা যে কোন আত্মত্যাগের জন্য তৈরী থাকতেন
। ১৮৮৩ সালে ব্রিটিশ সরকার সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে আদালত অবমাননার দায়ে হাজত বাস করালে প্রমথনাথ বহু লোক নিয়ে কারাগার ভেঙে সুরেন্দ্রনাথকে উদ্ধারের পরিকল্পনা করেছিলেন । প্রথম জীবনে তিনি একবার সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে যান । কিন্তু ‘বাঙালী ভীরু’ এই অপবাদেই তাঁকে বাহিনীতে নেওয়া হয়নি । ফরাসী ঔপনিবেশিক বাহিনীতে যোগ দিতে গেলেও তাঁকে বিদেশী বলে প্রত্যাখ্যাত হতে হয় । প্রমথনাথ কোন রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিতেন না । গীতা সোসাইটি বা কোন অরাজনৈতিক ধার্মিক দলের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল । সমিতিতে তিনি প্রায়শই ইতিহাসের ক্লাস নিতেন । ফরাসী-বিপ্লব ও ইতালির মুক্তির সংগ্রাম ছিল তাঁর আদর্শ বিষয় । সমিতির সদস্যদের গীতা, মহাভারত, নীতিশাস্ত্র, শিবাজী, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের উপর শিক্ষা দেওয়া হত । প্রমথনাথের সাহিত্যের প্রতি আসক্তির পরিচয় পাওয়া যায় ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘যোগী’ উপন্যাসে । হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও বঙ্কিমচন্দ্রের অনুশীলন ত্তত্ব তাঁর উপন্যাসে মূর্ত হয়ে উঠেছে । প্রমথনাথ তাঁর বৈপ্লবিক কর্মকান্ডে কখনই আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি । তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের উত্থান ঘটানোর চিন্তা তাঁকে অনুশীলন সমিতির মত কঠোর আদর্শবাদী দলের নেতায় পরিনত করেছিল । বর্তমানের হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী তথাকথিত নেতাদের মত উগ্র সাম্প্রদায়িক কখনই তিনি ছিলেন না । বরং হিন্দুত্ববাদী বিপ্লবী হিসাবে তিনি দেশের সমস্ত সম্প্রদায়ের যুবশক্তিদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন এক সহিংস আন্দোলনের পথ ।

Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours