Fiture
পূবালী রাণা, লেখিকা, কলকাতা: (শ্রেনী সংগ্রামের ওপর ভিত্তি করে লেখা) দৌড় দৌড় দৌড়---দৌড়চ্ছে ছেলেটা- ছোটবেলা থেকেই দৌড়টা ভালোই রপ্ত করেছিল সে। লালমাটির রাস্তা, এবড়ো খেবড়ো ধান জমির আল,খাল, বিল ----সবকিছু পেরিয়ে সে ছুটে চলেছে। পেছনে ভারী বুটের শব্দ----এবার যেন অনেক কাছে চলে এসেছে....ও দৌড়চ্ছে আরো জোরে...ওদের সার্চলাইটের আলো নিশ্ছিদ্র অন্ধকারকেও খান খান করে দিয়েছে। ছেলেটির নাম শংকর। গরীব চাষী পরিবারের মেধাবী ছেলে শংকর। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার সাথে সাথে প্রায় সব বিষয়েই পারদর্শী সে। উত্তাল সূবর্নরেখা সাঁতার দিয়ে নিমেষে অতিক্রম করা, মাইলের পর মাইল হেঁটে কোনো অসুস্থ মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, মোরগ লড়াই, মাছ ধরা...সব কাজেই সে সমান পারদর্শী। সে কি ধরা পড়ে যাবে? কিন্তু ধরা পড়লে তো তার চলবে না।তার যে অনেক কাজ বাকী। গ্রামের গরীব মানুষগুলোর ওপর জোতদার,জমিদার,মহাজনদের অত্যাচার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ভাগচাষীদের অবস্থা আরো করুণ। তারা বীনা মজুরিতেই বেগার খাটে জোতদার, মহাজনের জমিতে। লাঙ্গল দেওয়া, ধান রওয়া, ধান কাটা--- কর্জা উসুল হোত বছরের পর বছর।কৃষকদের জমি হাত করবার আরও বুনিয়াদি ফন্দী ছিল তাদের কাছে। প্রতিবাদ করলেই অত্যাচারের মাত্রা চরম আকার ধারন করেছে। গ্রামের পর গ্রাম তারা আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে।সারা গ্রাম জুড়ে শুধু হাহাকার আর আর্তনাদ। এই জোতদার, মহাজনদের খতম করার সংকল্প নিয়েছে শংকর ও তার দল। এরা আমাদের শ্রেণিশত্রু। কলেজে পড়ার সময় ই শংকর পড়েছিল মাও সে তু ং এর লেখা দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গএ, প্রয়োগ প্রসঙ্গে, 'হুনান কৃষক আন্দোলনের' তদন্ত রিপোর্ট'-- যা এখানকার জোতদার,জমিদারের অত্যাচারের ছবির সংগে হুবুহু মিলে যায়। ভারতবর্ষের গ্রামাঞ্চলেও চীনের মতো কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার অবস্থা রয়েছে। তখন থেকেই শংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে গ্রামে গিয়ে সে এই শোষনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলবে। গ্রামের এই অস্থির পরিস্থিতিতে শংকর গবেষনার কাজ স্থগিত রেখে গ্রামে চলে এসেছিল। শংকরের সংগে কলকাতা থেকে আরও অনেক বিপ্লবী বন্ধু এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছে।সূবর্নরেখা ও তার প্বার্শবর্তী বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা সীমান্তের গ্রামগুলিতে তখন জোরদার আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। এই আন্দোলন ক্রমশ স্ফুলিঙ্গ এর আকার ধারন করেছে। ১৯৬৭ সালের মে মাসে দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ি,যরিবাড়ি,ফাঁসিদেওয়া, এলাকার কৃষকদের জোরালো আন্দোলন... পুলিশের গুলিতে ১১জন কৃষক শহিদ... এই ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ এর প্রায় সব জায়গা ই গন আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। এই ঘটনা শংকর ও তার দলকে আরো উদ্বুদ্ধ করে। ' নকশাল বাড়ি লাল সেলাম ' এই মন্ত্র উচ্চারনে মধ্য দিয়ে তাদের যাত্রা শুরু। এই শ্লোগানে ধ্বনিত সারা আকাশে বাতাসে সারা বাংলায়। চারদিকে দেওয়াল লিখন, পাড়ায় পাড়ায় গোপন মিটিং, ইস্তাহার বিলি...প্রত্যেক স্তরের মানুষকে জাগরিত করেছিল। সমগ্র বাংলা এই শোষনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল। এদিকে কংগ্রেসি শাসকের দমননীতিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পুলিশি অত্যাচারের মাত্রা চরম আকার ধারন করল। সরকার আইনের শাসন বজায় রাখার শপথ নিয়েছিল।। চারু মজুমদার, কানু সান্যাল, সৌরিন বসু, মুজিবর রহমান, জঙ্গল সাঁওতাল...এঁদের নেতৃত্বে ভূমিসংস্কার আন্দোলন তখন চারদিকে বিস্তার লাভ করেছিল। শুরু হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষের এক অসম লড়াই। শংকর সেই মুক্তি আন্দোলনের নেতা। শংকরের মনে ক্রোধ,ক্ষোভ,বেদনা,অবিশ্বাসের দগদগে ঘা প্রবল অগ্নিস্রোত হয়ে নামছিল। সে হয়ে উঠেছিল সকলের নেতা--- সাহসে, বুদ্ধিমত্তায়,ক্ষিপ্রতায়, যৌবনে আর শ্রেণী ঘৃনায়। শংকর ছুটছে.. কারন তার ধরা পড়া চলবে না। তার অসমাপ্ত কাজ তাকেই করতে হবে। আজ রাতের অন্ধকারে সে বাড়িতে এসেছিল.. অনেকদিন সে ভালো করে খায় নি। একমুঠো ভাতও তার মুখে তোলা হল না।
বিকু এসে খবর দিল পুলিশ এসেছে। সারা গ্রাম ঘিরে ফেলেছে। তাদের হাতে গ্রেনেড, পিস্তল, আরও বহু আগ্নেয়াস্ত্র....কারন শংকর যে পুলিশের খাতায় দাগী আসামী most wanted... সরকার ঘোষনা করেছে তাকে জ্যান্ত অথবা মৃত ধরতে পারলে একলক্ষ টাকা পুরস্কার... শংকর বুঝতে পারে পুলিশ কে তার গ্রামে আসার খবরটা কেউ দিয়েছে। চরের অভাব নেই। শৃগালেরদের অবস্থান সর্বত্র। নিশ্চিত খবর পেয়েই পুলিশ গ্রাম ঘিরেছিল। শংকর তড়িৎ গতিতে বাড়ির পেছনের বাঁশবন পেরিয়ে, ছুটতে শুরু করল.. তারপর একেএকে আখক্ষেত, ধানক্ষেত, ডাঁহি,ডুংরি --- সব কিছু পেরিয়ে ছুটে চলেছে সে.. একবার জঙ্গলে মিশে যেতে পারলে পুলিশের বাপ ও তাকে খুঁজে পাবে না। সে নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কে ফুতকারে উড়িয়ে দিয়ে, দিনের পর দিন অনাহারে, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে গরীব মানুষগুলোর মধ্যে। পুলিশ, মিলিটারির সংগে তাদের সফল অসফল খতম অভিযান। তার পেছনে এখন হিংস্র শ্বাপদের দল...কিন্তু তার অদম্য ইছেশক্তি কিছুতেই এক আকাশ ভর্তি স্বপ্নকে মরে যেতে দেবে না। : ইতিমধ্যে প্রথম সারির অনেক নেতাই জেল বন্দী... তাদের ওপর রাষ্ট্র শক্তির নারকীয় অত্যাচার চলছে। জেলের মধ্যেই নির্বিচারে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কারো যাবজ্জীবন কারা দন্ড, কারো বা ফাঁসি ঘোষিত ---কিন্তু লড়াই থেমে থাকে নি। বিপ্লবের পথে অসংখ্য বাধা...সেই বাধা পেরিয়ে মৃত্যুকে উপেক্ষা করে শংকর, বিকু, অসীম রা লড়াই চালিয়ে গেছে। সে নীতি ভুল না ঠিক সে প্রশ্নে না গিয়ে..বরং একে বলা চলে জনজাগরনের অভ্যুত্থান। শংকরও একদিন ধরা পড়ে। কিন্তু মিলিটারি বুট বা বেয়নেট আর নেতৃত্বশুন্যতা এমন কিছু প্রভাব ফেলতে পারেনি। কারন শ্রেণীশত্রুর বিরুদ্ধে প্রত্যেক স্তরের মানুষ একজোট ---ঐক্যবদ্ধ দিকে দিকে শ্লোগান ---
'সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক ' তার মধ্যে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবীতে নতুন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। তাই রাষ্ট্র এর রক্তচক্ষু এই আন্দোলন কে থামাতে পারে নি।শাসক-শোষিতের লড়াইয়ে সাধারন মানুষের জয় অবশ্যম্ভাবী যদিও তা ---অনেক রক্ত, অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে। সাম্রাজ্যবাদ শেষ অবধি পিছু হটতে বাধ্য হয়...এটাই ইতিহাস স্বীকৃত।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

1 comments so far,Add yours

  1. সময়টা যে বড্ডো চেনা । স্বপ্ন বুকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আগুন বলয়ে সব স্পর্ধারা ।
    আজ ও সে ওম খুঁজি প্রাকারে প্রাচীরে ।

    ReplyDelete