Fiture
সেঁজুতি ভট্টাচার্য, সমাজকর্মী, কলকাতাঃ আরে কে না চায় ? অন্নদামঙ্গলের কবি ভারতচন্দ্র তিনশ’ বছর আগেই এই বর চেয়েছিলেন। আর চাইবেন নাই বা কেন? বঙ্গসন্তানের মত সন্তান হয় না কি ? জনক-জননীরা তো জানেনই, আমার খুকি কিচ্ছু বোঝে না, ... ভারি ছেলেমানুষ! সেই ট্র্যাডিশন এখন বহুধায় পল্লবিত।তিনশ’ বছর ধরে এই ‘ছেলেমানুষ’দের মানুষ করার চেষ্টায় দুধ-ভাতের কমতি পড়ে নি। বড় হল সবাই, কিন্তু মানুষ ---- ? না না -- নো পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটা। আমরা এখানে প্রভু জগন্নাথের মত অপলকে দেখব, গত ৫০ বছরে দুধ-ভাতে প্রোটিন-ভিটামিনের বহর কি ভাবে বেড়েছে। সব বাড়ন্ত বাচ্চা কি না! মার্জনা চেয়ে নিয়ে বলি, এখানে খাওয়া, খোকা-খুকু সব প্রতীকি।
ছবি বিশ্বাস বা কমল মিত্ররা যখন বাবা সাজতেন, তখন আমরা দাদু-ঠাকুমা,জ্যাঠা-কাকা সবাই একান্নবর্তী – ঢালাও জলখাবারে রুটি- কিংবা লুচি(রুটিই শ্রেয়), ভাত-ডাল-চারা বা চিংড়ির মাছের ঝোল, দুধ-চিঁড়ে এবং আবার ঝোল –ভাত।প্রোটিন-ভিটামিন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, কোন স্পেস প্রব্লেম নেই—দাদু-ঠাকুমার জন্য আলদা ‘পাথরের থালা’ও ছিল না। গোল বাঁধালেন আমাদের বাবা-মায়েরা । স্পেস প্রব্লেম প্রবল, প্রোটিনের খামতি পীড়া দিতে শুরু করেছে। দাদু-ঠাকুমারা তো তাঁদের সন্তানদের জন্য দুধ-ভাতের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন, তাই ধীরে ধীরে একান্ন বদলাল ৫১ অন্ন-বসতিতে। শুরু হল, পুত্র-কন্যা নামক স্টেশনে স্টেশনে বৃদ্ধদের ঘোরা। অবশ্যি বেশি দিন কোথাও থাকতে হয় না!পাথরের থালা চলে যায় ভাড়া-বাড়ির এক কোনে । এইবার খেলা জমল।পেরিয়ে গেল তিরিশটা বছর।শুরু স্লগ ওভার। আমাদের জমানা। পাতাল রেল-ইন্দিরা-বাম ফ্রন্ট।আমরা কিন্তু কিছুই ভুলি নি- বাবা-মায়েরা রয়ে গেলেন পুরোন ভাড়ার বাড়িতে। ফোর-ফিগারে প্রথম স্যালারি পাওয়া আমরা চললাম, ডবল বেডরুমের নোতুন ফ্ল্যাটে। ছেলেমেয়েরা টোস্ট-ওমলেট-হেলথ ড্রিঙ্ক-জিমে মাখামাখি। তাদের শিক্ষিত-গান-জানা মায়েরা কোন রিস্ক না নিয়ে জন্মলগ্ন থেকেই তাদের টিউশন-লগ্ন করে দিলেন যাতে তাদের বাবাদের মত বোকা বোকা বিএ এমএ পড়তে না হয়। আ্মাদের ছোটবেলার পক্ষীরাজ ঘোড়ার বদলে পুরো সমাজটাই পাড়ি দিল হ্যারি পটারের উড়ন্ত ঝাঁটায়। সামনে অমোঘ প্রশ্ন- Quo vadis, Domine– কোথায় চলেছি, প্রভু ? কার ক্রুশ, কোন প্রান্তরে কেন বহন করে নিয়ে চলেছি ? শ্রীরাধিকার মত আমদের মনে সততই বড় শঙ্কা !আমাদের দাদুদের শেষ বয়সেও কোন চিন্তা ছিল না। নির্দ্বিধায় বাবাদের বলতেন, বাজারের টাকা দে । বাজার করে ল্যাবেনচুষ চিবতে চিবতে ফিরতেন । সম্মান-অসম্মানের বালাই ছিল না- জানতেন সংসার চালানটা এখন বাবার দায়িত্ব। আশ্চর্য বিশ্বাস! কোনও শঙ্কা নেই, নিশ্চিন্ত নির্ভরতা। বাবারা বিরক্ত হতেন! ভাবতেন, এদের বোধ-বুদ্ধি আর কবে হবে! মাসে্র শেষ–প্রথম জ্ঞান নেই।যৌথসংসারে থাকতেন, এজমালি বাড়ি ... সংসার তো আর চালাতে হয় নি...... তাও আমদের জন্য কিছুই রাখলেন না, এক টুকরো জমিও যদি কিনে রাখতেন! তবু, দাদুদের বিশ্বাসে ঘা দিতেন না --- হাসিমুখে, হয় তো খানিকটা প্রশ্রয়েই সহ্য করতেন। এইসব প্রভিডেন্ট ফান্ড-গ্র্যাচুইটি এবং সামান্য পেনসন পাওয়া বাবাদের বিশ্বাসে এবার চিড় ধরল। খোকা আর কত পারবে ? নাতিটা ইংরিজি স্কুলে পড়ে, ফ্ল্যাটের ইএমআই, একটা গাড়িও কিনেছে--- আলাদা একটা সংসার চালানোটা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!আমরাই তো সে শস্তা-গন্ডার দিনে হিমসিম খেয়ে যেতাম! আর,এখন জিনিসের যা দাম! খোকার ম্যানেজমেন্ট পড়া, মেয়েটার বিয়ে – এ সবে অফিসের অনেক টাকা লোন ছিল; রিটায়ারমেন্টের টাকা থেকে কেটে নিল! না হলে, হার্টের অপারেশনটা করিয়ে নিতাম। বড় হাঁপ ধরে আজকাল। খোকাকেই বা বলি কোন লজ্জায়! খোকা আমার কিচ্ছু বোঝে না, ... ভারি ছেলেমানুষ! ভারি ব্যস্ত! হপ্তান্তে একবার আসত, তাও আজকাল আর হয়ে ওঠে না।ওর মায়ের শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না, আমার কিছু হয়ে গেলে কি যে হবে! সেই চিন্তাতেই রাতে ভাল ঘুম হয় না।সারা জীবনে কখনও নিশ্চিন্ত হওয়া গেল না। ব্যস্ত খোকা দিন রাত খাটে। দু কামরায় আর কুলোচ্ছে না – ছেলেটা বড় হচ্ছে, দু’জন টিচার বাড়িতে পড়াতে আসে, অফিস-কলিগদের পার্টি, মিসেসের বান্ধবীরা, একটু হাঁটা-সাঁতার কাটা ... বড় কমপ্লেক্সে না যেতে পারলে আর প্রেস্টিজ থাকছে না! বস আবার বলেছে, মিসেসের হাতের মাংস খাবে ...... ফ্ল্যাটটা এত ছোট...... বাবা যদি একটু জমি বা কিছু টাকা রাখতে পারত!বাবার মত হাত শূন্য রাখলেও তো চলবে না ...... বুবলুর ওপর তো আর ভরসা করা যায় না—ও হয় তো ওর মামার মত বিদেশে থাকবে ! আর আমি সে ভরসাও করব না, আমি চলব আমার মত, ওর জীবন ও চালাক! আমি আমার বাবা নই ...... সব ব্যপারেই ফোন ! আরে বাবা, নিজের সাধ্যমত চল, আমি কি করব এই হল গত ৫০ বা ৬০ বছরের বঙ্গজীবনের জলদি স্কেচ।
দুধে-ভাতে রাখতে চাওয়া বাবা-মায়েরা এবং কিচ্ছু না বোঝা খোকারা একই অপ্রাপ্তির আক্ষেপ-চক্রে ঘুরেই চলেছে। তিন বা চার প্রজন্ম জুড়ে শুধুই আমি,দুধভাত আর সন্তান! সমাজ-দেশ-নীতি-চিন্তা এ সব কোন কিছুই আর বঙ্গজীবনের অঙ্গ নয়। কোন কিছুতেই আমাদের কিছুই যায় আসে না। আমদের ভাবনার আকাশ জুড়ে শুধুই আমি – ছোট লাভ-ছোট ক্ষতি-বৃথা কলহ এবং অযথা সংশয়ে সদাই শঙ্কিত ছোট আমি – বঙ্গসন্তান! আত্মবৎ মন্যতে জগৎ -- জগতও আমদের নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছে । দুধে-ভাতের বাঙালি সব খেলাতেই এখন নেহাতই দুদু-ভাতু, কেউ ডাকে না।
                  (ক্রমশ)



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours