সঞ্চারী চট্টোপাধ্যায়, ফিচার রাইটার, কলকাতাঃ
"কুসুম দোলায় দোলে শ্যাম রাই"
যে কালী , সেই কৃষ্ণ একথা স্বয়ং অনুধাবন করেছিলেন রানী রাসমনি । তাই দক্ষিনেশ্বর যতই কালীক্ষেত্র হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করুক না কেন , শ্যাম রাই কিন্তু দক্ষিনেশ্বর প্রতিষ্ঠার বহু আগে থেকেই শ্রীচৈতন্যদেবের সময়কাল থেকেই আড়িয়াদহের পাঠবাড়িতে তাদের বসতি স্থাপন করেছেন । এই পাঠবাড়ির ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের যেতে হবে সুদুর গৌড়ে । বাংলায় সেসময়ে হুসেন শাহের রাজত্বকাল । সেসময়ে আড়িয়াদহের বুকে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রধান শিষ্যগণের অন্যতম শ্রীশ্রীদাস গদাধর একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন যেটি বর্তমানে গদাধরের পাঠবাড়ী অথবা পাঠবাড়ী নামে প্রসিদ্ধ । এই পাঠবাড়ীকে কেন্দ্র করে এমন অনেক ঘটনা আছে যা ধর্মীয় এই অস্থিরতার যুগে আমাদের মনকে একই সঙ্গে চঞ্চল এবং শান্ত করে তোলে । কথিত আছে নিত্যানন্দ মহাপ্রভু স্বয়ং একদা এক বালগোপালের মুর্তিকে বুকে জড়িয়ে ভাবে বিভোর হয়ে নৃত্য করেছিলেন । পাঠবাড়ীর প্রতিষ্ঠাতা দাস গদাধর স্বয়ং একদা এক মুসলিম কাজিকে দিয়ে হরিনাম করিয়েছিলেন , না নিগ্রহ অথবা শারীরিক বলপ্রয়োগ করে নয় , সামান্য অনুরোধেই সেই কাজি হরিনাম করেছিলেন । আসলে দাস গদাধরের এমন আশ্চর্য্য অনুরোধ শুনে খানিকটা কৌতুকের বশেই সেই মুসলিম কাজি বলে বসেন - "বেশ বেশ আজ এখন যাও তো এখান থেকে কাল হরি হরি করে চেল্লান যাবেখন ।" এইখানেই সমস্ত ধর্ম এসে মিলে গেল পাঠবাড়ীর কাছে পবিত্র গঙ্গার জলে । পাঠবাড়ী এবং দাস গদাধরের সূত্র ধরেই আড়িয়াদহ গ্রাম চৈতন্যযুগে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচারের অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলো । বর্তমানে পাঠবাড়ী স্বর্গীয় শ্রী বলাইচাঁদ মল্লিকের বংশধরের সম্পত্তি । এই মন্দিরে ১২৫৬ বঙ্গাব্দে বলাইচাঁদ মল্লিকের পিতামহ প্রতিষ্ঠা করেন রাধাকান্ত জীউর বিগ্রহ । এরপর ১৩০৬ বঙ্গাব্দে বলাইচাঁদ মল্লিকের মা কাদম্বিনী দাসী প্রতিষ্ঠা করেন গোপেশ্বর জীউর বিগ্রহ এবং ১৩১২ বঙ্গাব্দে বলাইচাঁদ মল্লিকের পুত্র স্বর্গীয় গৌরচাঁদ মল্লিক প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীনিত্যানন্দ ও মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের যুগল মুর্তি ।
প্রতিবছর গোষ্ঠ অষ্টমীতে এখানে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় দাস গদাধরের স্মরণ মহোৎসব এবং ঝুলনের সময়ে পাঁচদিন বিভিন্ন সাজে সজ্জিত করা হয় রাধাকৃষ্ণকে । একাদশীর দিন নটবর , দ্বাদশীতে রাজনটবর , ত্রয়োদশীর দিন রাখাল , চতুর্দশীতে নাগরি এবং পূর্ণিমায় রাজবেশে সজ্জিত করা হয় রাধাকৃষ্ণের যুগল মুর্তিকে । তারপর বাঁশির আওয়াজের সাথে দোলনায় দোল দিয়ে কানে ভেসে আসে সেই সুর "শ্যামেরই পাশে শ্রীমতি হাসে / যুগল শশী যেন বৃন্দাবনে ।" আড়িয়াদহের বুকে পাঠবাড়ী যুগের পর যুগ ধরে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারাকে এইভাবেই মথুরা বৃন্দাবন ভ্রমনের সুখ দান করে চলেছে । আসলে ঠাকুরের বাস যখন অন্তরে , তখন ভৌগলিক দুরত্ব না পেরিয়েও যে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় এই সত্য পাঠবাড়ির পবিত্র অঙ্গনে এলেই আড়িয়াদহ ও দক্ষিনেশ্বরের মানুষ অনুধাবন করে চলেছেন অনাদিকাল ধরে ।।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours