স্বরূপ গুপ্ত লেখক, কোচবিহার: কবি বলেছেন 'Water water everywhere/But not a little drop to drink...'
অবস্থা এতটা সঙ্গীন না হলেও কমও নয়।
বলছি জয়ন্তীর কথা। বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর থাকা অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জয়ন্তী পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে একটি উল্লেখযোগ্য নাম। বক্সার অরণ্যে কার-সাফারি, খানিক দূরের সান্তালাবাড়ি থেকে বক্সা ফোর্ট ও পাহাড়ি হ্যামলেট চুনাভাটি বা লেপচাখা ট্রেক করতে দলে দলে পর্যটক ফি বছর ভীড় জমান জয়ন্তীতে। জয়ন্তী নিজেও কম যায় না। কার-সাফারি বাদে পুখুরি লেক অবধি ট্রেক বা স্ট্যালেগমাইটের মহাকাল গুহা দর্শনের জন্য শুধুমাত্র জয়ন্তীকেও বেছে নেন বহু লোক। এবাদেও রয়েছে নদীর ওপারে ফাসখাওয়া ও জয়ন্তী, তুড়তুড়ি চা-বাগানের সবুজ বিস্তার, হাতিপোতা, ভুটান ঘাটের অপার্থিব সৌন্দর্য। জয়ন্তী অভিমুখে বক্সা টাইগার রিজার্ভ ফরেস্টে ঢুকবার মুখে রাজাভাতখাওয়ার আকর্ষণও কম নয়। সাহিত্যিক অমিয়ভূষণ মজুমদারের উদ্বোধন করা নেচার ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টার, নার্সারি, পানিঝোরা, পাম্পুবস্তী, খানিক দূরের ডিমা নদী ইত্যাদি নিয়ে রাজাভাতখাওয়াও অনন্য। তাই জয়ন্তী ও তৎসংলগ্ন এলাকাগুলি দেখবার জন্য দিনদিন বাড়ছে পর্যটকের সংখ্যা। পাশাপাশি, অত্যন্ত প্রাচীন এই জনপদগুলির নিজস্ব জনসংখ্যা সংখ্যা বিচারে বিরাট না হলেও নেহাত কম নয়। অতীতে জয়ন্তী নিজেই ছিল ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র। এখানে চলত হাতি কেনাবেচা। জয়ন্তীর পিলখানা আজও সে সাক্ষ্য বহন করছে। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই বাঁধলে ভুটানের হাত থেকে মহাকাল মন্দির এলাকাটি ছিনিয়ে নিয়েছিল ইংরেজরা। কিন্তু পবিত্র তীর্থক্ষেত্রকে নিজেদের দখলে রাখতে জয়ন্তীর সঙ্গে মহাকাল মন্দির এলাকার হাতবদল করে ভুটানিরা। তখন থেকেই জয়ন্তী ইংরেজ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। জয়ন্তী-সহ বক্সার বনজ সম্পদে মোহিত ইংরেজরা যতটা পেরেছিল লুন্ঠন চালিয়েছিল দামী কাঠ ও অন্যান্য জিনিসের জন্য। গত শতকের প্রথম দিকে আলিপুরদুয়ার থেকে রেলপথও বসিয়েছিল তারা, যদিও আজ তা বিলুপ্ত।
আজকের জয়ন্তী একটি ছোট্ট জনপদ। চারদিকে জঙ্গলের মধ্যে কিছু বাড়ি, কিছু হোম স্টে, নদীর ধারে টুরিস্ট লজ, বনদপ্তরের অফিস, এস এস বি ক্যাম্প, খাওয়ার একটি দু'টি হোটেল এবং প্রাইমারি ও হাই স্কুল ছাড়া আর কিছু নেই। উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা ও আধুনিক অন্যান্য যে কোন সুযোগসুবিধার জন্য জয়ন্তীবাসীকে নির্ভর করতে হয় প্রায় তিরিশ কিমি দূরের জেলা শহর আলিপুরদুয়ারের ওপর। অতীতে ব্রীজের অভাবে নদীতে জল কমবার অপেক্ষায় থাকতে হত তাদের জেলাশহরে বা রাজাভাতখাওয়ায় আসবার জন্য। আজ সে অবস্থা পালটেছে ঠিকই কিন্তু মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জলের জন্য জয়ন্তীকে প্রতিনিয়ত ভুগতে হচ্ছে।
মজা হচ্ছে এটাই যে, জয়ন্তীতে বর্ষাকালে জলের অভাব নেই। কিন্তু তা পানযোগ্য নয়। ভুটান পাহাড়ে বৃষ্টি হলেই জয়ন্তী-সহ অন্যান্য জলধারা দুকূল ছাপায়। কেননা জয়ন্তী নদীতে পাথর তোলার কাজ সরকারীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নদীবক্ষ দিনদিন উঁচু হয়ে উঠছে। এই মুহূর্তে তা এতটাই উঁচু হয়ে গেছে যে, সামান্য বৃষ্টিতেও জল চলে আসছে লোকালয়ে। এর মধ্যেই আলিপুরদুয়ারে একরাতে চারশো মিমি বৃষ্টি হয়ে গেছে। বিগত এক সপ্তাহ ধরে লাগাতার বৃষ্টি চলছে। আবহাওয়া দপ্তর আগামী তিনদিন ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা করছেন। এরকম অবস্থায় জয়ন্তীর কী অবস্থা হতে পারে তা বোঝাই যাচ্ছে। আবার একদম উল্টো চিত্র দেখা যায় গ্রীষ্মকালে। জয়ন্তী নদী তখন পরিণত হয় তিরতিরে এক প্রবাহে। আদৌ জল আছে কিনা বোঝা যায় না। জয়ন্তী জনপদে পানীয় জল কোনভাবে পাওয়া গেলেও অন্যান্য কাজের জন্য যথেষ্ট জলের অভাব দেখা যায়। এই সময়ে ঠেলায় ড্রামের পর ড্রাম এনে জল বহন করার চিত্র প্রমাণ করে যে কতটা কষ্টে থাকতে হয় এখানকার মানুষকে। বন্য প্রাণীর আক্রমণের আশঙ্কা, হস্তীকূলের যখনতখন লোকালয়ে চলে আসা, মোবাইল টাওয়ার ঠিক মতো না পাওয়া, পড়াশোনা বা চিকিৎসার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার কষ্ট তবু বা যা মেনে নেওয়া যায়, মানা যায় না জীবনের অন্য নাম জলের এই অভাব।
তবু জয়ন্তী নিজের মতো হাসি মুখে আপ্যায়ণ করে তাদের কাছে আসা পর্যটকদের। তাদের মুখের প্রশান্তি দেখলেই খুশী এখানকার সরল মানুষেরা। অরণ্য তাদের কষ্ট সহ্য করতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে নিজের কষ্ট চেপে রেখে অন্যের মুখে হাসি ফোটাতে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours