Fiture
শিবাশীষ বসু, ফিচার রাইটার, উত্তরপ্রদেশ:   আসুন প্রথমে একটি কাহিনী শোনানো যাক। কাহিনীটি বিখ্যাত থ্রিলার লেখক ফ্রেডরিক ফরসাইথের 'ওডেসা ফাইল' উপন্যাস থেকে নেওয়া। কাহিনীটি এক হতভাগ্য ইহুদির, নাম সলোমন টাউবের। স্থান কাল হল ১৯৪১ এর আগস্ট মাসের জার্মানি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন বেশ পেকে উঠেছে। টাউবের হামবুর্গের বাসিন্দা। স্রেফ ইহুদী হওয়ার অপরাধে টাউবেরকে গ্রেফতার করে আরও শ-খানেক ইহুদি নারী-পুরুষ-শিশুর সাথে একটি মালগাড়ির বদ্ধ কোচের মধ্যে ভরে নিয়ে আসা হল রিগাতে। নামবার পর দেখা গেল এমনই গোটা ষাটেক কামরা থেকে লোক নামছে। সাতদিন বদ্ধ কোচে বিনা খাদ্যপানীয়তে থেকে এক-তৃতীয়াংশ মানুষের ইতিমধ্যেই মৃত্যু ঘটেছে। গরুছাগলের মতো তাড়িয়ে এনে মানুষগুলিকে ঢোকানো হল ঘেটোতে। শুরু হল সশ্রম বন্দীজীবন। চারিদিকে দেওয়াল দিয়ে ঘেরা ঘেটোর মাঝখানে ছিল একটি বিশাল ফাঁসিকাঠ। দুই বর্গমাইল এলাকায় হাজার চল্লিশ মানুষকে পোরা হল।
কয়েকদিন বাদে বাদেই নুতন দল আসতো আর সমপরিমাণ মানুষকে ফাঁসীকাঠে ঝুলতে হত। নারী ও শিশুদের মারা হত গুলি করেই। পাশেই ছিল একটি গণকবর। মার্চ ১৯৪২ থেকে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-শিশু ও দুর্বলদের ডুনামুণ্ডে অন্য আরেকটি কারখানায় কাজ করবার নাম নিয়ে ভ্যানে করে পাঠানো শুরু হল। দিনকয়েক পরে জানা গেল, ওটা কারখানা আদৌ নয়, গ্যাসচেম্বার। ঘেটোর অধিকর্তা ছিল এডুয়ার্ড রশম্যান, যাকে বলা হত 'রিগার কশাই'। শোনা যায় আগস্ট ১৯৪১ থেকে অক্টোবর ১৯৪৪ পর্যন্ত মোট দুলাখ ইহুদিকে রিগাতে আনা হয়েছিল যার আশিহাজারকে রশম্যানের আদেশে ওখানেই খুন করা হয়। আমাদের কাহিনীর নায়ক টাউবের প্রতিজ্ঞা করেছিল যেভাবেই হোক সে বেঁচে থাকবেই। দিন বদলালে, কোনোদিন যদি রশম্যানকে আসামীর কাঠগড়ায় পাওয়া যায়, সাক্ষী দেওয়ার জন্যে। এর জন্য টাউবের পায়ের মধ্যে উল্কি দিয়ে দিনপঞ্জি লেখা শুরু করলো। আর ভর্তি হল 'কপো'র কাজে, ইহুদি পুলিস, যাদের কাজ ছিল স্বজাতির লোকেদের তাড়িয়ে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু নিজে বেঁচে থাকবার একমাত্র উপায়। এবারই ঘটল তার জীবনের সবচেয়ে ট্র্য‍াজিক ঘটনাটি। নুতন যারা আসতো তাদের মধ্যে অক্ষমদের ভ্যানে করে নিকটবর্তী একটি পাইনবনে নিয়ে গিয়ে তাদেরই দিয়ে কবর খুঁড়িয়ে তারপর মেসিনগান চালিয়ে মেরে ফেলা হত। কপোদের কাজ ছিল লাইনকরে তাদের ভ্যানে ওঠানো। ১৯৪২এর আগস্টে এমনই একটি দলকে ভ্যানে তোলবার সময় একটি মেয়েকে দেখে টাউবের থমকে গেল। মেয়েটির যক্ষা হয়েছে, অনবরত কাশছে। রশম্যান লক্ষ্য করেছিল তার এই থমকানো। হুকুম দিল, মেয়েটিকে ভ্যানেতে না তুললে, সাথে ত‍াকেও তুলে দেওয়া হবে বধ্যভূমির গাড়িতে। নিজের শপথের কথা মনে পড়ে গেল টাউবেরের। প্রতিশোধটা যে নেওয়া বাকি ! নিজের হাতে করে মেয়েটিকে ভ্যানে তুলে দিল টাউবের। শুধু দুফোঁটা জল বেরিয়ে এসেছিল মেয়েটির অপলক চোখ থেকে। দীর্ঘদিন পরে মুক্তি পাওয়ার পর টাউবের নিজের ডায়রিতে লিখেছিল, কুড়ি বছর ধরে আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি, সেই দৃষ্টির অর্থ কি? প্রেম না ঘৃণা, বিদ্বেষ না মায়া, বিভ্রান্তি না উপলব্ধি? ও হ্যাঁ, বলা হয় নি - মেয়েটি ছিল এসথার, টাউবেরের বউ। আমাদের কাহিনী প্রায় শেষ পর্যায়ে। রাশিয়ানদের পালটা আক্রমণের পর ঘেটোগুলি ভেঙে ফেলে এস. এস. রা পালিয়ে যায়। সলোমন টাউবেরের কাহিনীটি একবর্ণও অতিরঞ্জিত নয়। হিটলারের ইহুদি বিদ্বেষের জন্য আইনস্টাইন ১৯৩৩ সালে জার্মানি ত্যাগ করেছিলেন। এনরিকো ফার্মি ১৯৩৮ সালে, স্ট্যানলি উলাম ১৯৩৯ সালে জার্মানি ত্যাগ করেন। জার্মান বন্দিনিবাসের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার শুরু মহাযুদ্ধের অনেক আগে থেকেই, বস্তুত ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতালাভের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। গোয়েরিংএর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল হিসাবে এই বন্দিনিবাসগুলি শুরু হয়েছিল নাৎসী বিরোধী কম্যুনিস্ট ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলিকে নিশ্চিহ্ন করবার জন্য। ১৯৩৩ এর এপ্রিলে প্রতিষ্ঠিত হল কুখ্যাত ডাচাউ (Dachau) ক্যাম্প। ১৯৩৬ সালে হিমলার কুখ্যাত এস. এস. বাহিনীর অধিকর্তা নিযুক্ত হলেন। এই পৈশাচিক পরিকল্পনা থেকেই অধিকৃত পোল্যান্ডে তৈরী হয় একের পর এক বন্দিনিধনশালা - আউসভিৎজ, বার্কেনাউ, অসউইচেম, মাজডানেক, চেলমনো, স্টাটহফ, গ্লসরোজেন, ট্রিবলিংকা ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু বন্দিশালা ছিল দাসদের অমানুষিক খাটানোর জন্যে এবং বাকিগুলি ছিল স্রেফ সংহার করবার জন্যে। চেলমনো শিবিরে ৩.৬০ লাখ এবং ট্রিবলিংকা শিবিরে ৭.৫০ লাখ গণহত্যা হয়। "এমনকি খাস জার্মানিতে যে ৩৬ লক্ষ্য সোভিয়েট যুদ্ধবন্দী ছিল, তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকশত শ্রমিকেরা কাজের জন্য বাঁচিয়া ছিল। অার বাকি সব অনাহারে, অত্যাচারে বা সংক্রামক ব্যাধিতে মারা গিয়েছিল।" (পৃষ্ঠা ২৮৮, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ২য় খণ্ড, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, নবপত্র প্রকাশন) রুশদের বক্তব্য অনুযায়ী একমাত্র আউসভিৎজ ক্যাম্পে ৪০ লাখ মানুষ মারা হয়েছিল। ৬০ লক্ষ্য ইহুদী নিধনের কথা তো বহুল পরিচিত। Schultzstaffel অথবা SS নামে অধিক পরিচিত কুখ্যাত এবং নৃশংস এই বাহিনীটি ১৯২৫ সালে প্রথমে হিটলারের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী বাহিনী হিসাবে তৈরি হয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালের পর এদের হাতেই ভার দেওয়া হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলি চালানোর। হিটলারের SS বাহিনী ষাট লক্ষ ইহুদি ছাড়াও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী, কমিউনিস্ট, রোমানী ভাষাগোষ্ঠীর (যাযাবর) জনগণ, অন্যান্য স্লাবিক ভাষাভাষী জনগণ, প্রতিবন্ধী, সমকামী পুরুষ এবং ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের মানুষদের ওপর এই অমানবিক গণহত্যা পরিচালনা করে। নাৎসিরা এর নাম দিয়েছিল "ইহুদি প্রশ্নের চরম উপসংহার" বলে। নাৎসি অত্যাচারের সকল ঘটনা আমলে নিলে সর্বমোট নিহতের সংখ্যা দাঁড়াতে পারে নব্বই লক্ষ থেকে এক কোটি দশ লক্ষের মত। শিশুদের ক্ষেত্রে পদ্ধতিটি ছিল আরও নৃশংস। অনাহারে রেখে, চুনভর্তি গর্তে ফেলে, চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে এমনকি ফাঁসি দিয়েও শিশুনিধন হত। আর একটি পদ্ধতির উল্লেখ করছি - "The killings were done in this way, that particular SS-men or policemen would seize them by the legs and then smash the heads of these children against the trunks of trees." (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৯১) এটা জার্মানদেরই প্রদত্ত রিপোর্ট বলে বিবেকানন্দবাবু দাবী করেছেন। জার্মানির পরাজয় ও অধিকার করবার পর প্রথমদিকে কিছু শাস্তি হলেও পরে পশ্চিম জার্মানি গঠিত হওয়ার পর ওই নাৎসি খলনায়কদের বিশেষ শাস্তি হয় নি। একজন রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেছিলেন, ষাটলক্ষ মৃত ইহুদির ভোট নেই কিন্তু পঞ্চাশ হাজার নাৎসির ভোট আছে। অতএব বাকিটা ভারতের জনসাধারণকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না। এখানে একটা প্রশ্ন জাগে মনে। হঠাৎ ৭৫ বছর পর এই আলোচনা কেন? ইদানীং জার্মানিতে আডল্ফ হিটলারের মাইন কাম্ফ বইটির বিক্রি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে গেছে বলে বলছেন এর প্রকাশক আন্দ্রেয়াস ভিরশিং। তিনি বলেছেন, জার্মান ভাষায় রচিত ইহুদি-বিদ্বেষী এই নাৎসি মেনিফেস্টোটির গত বছর নাকি ৮৫ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে।
জার্মানির এসেন শহরে উপার্জনহীন ব্যক্তিদের জন্য বিনামূল্যে খাবার দেয়ার ব্যবস্থা আছে। তবে সম্প্রতি নিয়ম করা হয়েছে ফুডব্যাঙ্ক থেকে বিনামূল্যে এই খাদ্য পাবেন কেবলমাত্র জার্মান পাসপোর্টধারীরা। ২০১৭ সালে জার্মানির সংসদীয় নির্বাচনে ৭০৯টি আসনের মধ্যে 'অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড পার্টি'(এএফডি) ৯৪টি আসন পেয়েছে। তারা হচ্ছে নব্য নাৎসি দল। উপরোক্ত ঘটনাগুলিকে নয়া নাৎসিবাদের পুনরুত্থান মনে করে সমগ্র ইউরোপ উদ্বিগ্ন হয়েছে।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours