কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ
প্রথম প্রশ্ন ঃ শরীরে আঠারো হাজারি গ্রহরত্ন ধারন করলে, আপদ বিপদ থেকে বাঁচা যাবে তো?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: প্রথম ধোয়াতেই কালো জাঙ্গিয়ার রং যদি ফ্যাকাশে হয়ে যায়?
প্রথম প্রশ্ন টলিউডের সেই বিশিষ্ট শিল্পীর কাছে। যিনি খাঁটি গ্রহরত্নের সন্ধান দিয়ে চলেছেন বাংলা জুড়ে। আর দ্বিতীয় প্রশ্ন ইন্ডিয়ান সিনেমার আইকনের কাছে। যিনি তদন্তে নেমেছেন প্যান্টের তলায় কে কোন ব্র্যান্ডের জাঙ্গিয়া পরেছেন জানতে।
ওদিকে ফর্সা করার এক ক্রিমের বিজ্ঞাপনে নিজের মুখ ভাড়া খাটানোর অফারে সরাসরি 'না' করলেন সাই পল্লভি। আর এই 'না'-এর দাম ছিল দু'কোটি টাকা। নামটা আগে শোনেননি তো? সাই পল্লভি মালয়ালম সিনেমার এক তরুণী নায়িকা।
ভরসা রাখুন গ্রহরত্নে। একেবারে টাইট হয়ে যাবেন ভাগ্যদেবী। পরামর্শ বিদগ্ধ বামপন্থী শিল্পীর। পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। এতদিন মার্ক্সবাদের ডঙ্কা বাজাতেন শিল্পী। আজও সময় সুযোগ পেলেই বাজান। আবার অদৃষ্টবাদে গ্রহরত্নের প্রভাবের কথাও প্রচার করেন। ব্যাপারখানা তাহলে দাঁড়ালো কেমন?
'ধম্মেও আছি, জিরাফেও আছি।'
ভাগ্য বিরূপ?
তাহলে গ্রহরত্ন ধারণ করুন। ভাগ্যদেব তখন আপনার পোষা ডগি। আপনার পা চাটবে, আর লেজ নাড়বে।
বিজ্ঞাপনের আশ্বাস অনেকটা এরকম, গ্রহরত্ন আপনার ভাগ্য বদলে দিতে পারে না। তবে বশে আনতে পারে আপনার ভাগ্যদেবীকে। সঙ্গে সীলমোহর সেই বিদগ্ধ শিল্পীর সহাস্য মুখের ছবি।
আরে মশাই, কে কবে কাকে বশে আনতে পেরেছে?
গোর্খারা সেই কবে থেকে গোর্খাল্যান্ডের আবদার ধরে বসে আছেন। উন্নয়নের মোয়া দিয়ে তাদের বশে আনা গেল কি? মার্ক্সবাদের টোটকাও ফেল। হাতছাড়া হয়ে গেছে বাংলা। জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলে কিছু বাঙালির মনভোলানো যায় বৈকি। কিন্তু বাংলাকে বশে আনা সম্ভব এমনটা এখনও প্রমাণিত হয়নি। ওদিকে অনড় কাশ্মীর। তার স্পেশ্যাল স্টেটাস চাই। তাকেও নড়ানো যায়নি। আবার সাময়িক ভাবে আনুগত্য দেখানোকেও আপনারা ভেবে বসেন, যাক তাহলে বশে আনা গেছে! আবার বশে আনা এক। আর বশে রাখা আরেক। পাহাড়, জঙ্গলকেও নাহয় হাসানো গেছিল। কিন্তু বশে রাখতে পারলেন কোথায়? যে দুনিয়াতে আছেন, যাঁদের সঙ্গে আছেন, তাঁদেরকেই বশে রাখতে পারা যায় না। আর তারপরেও গপ্প ফেঁদে বসেন, ভাগ্যদেবীকে বশে আনার।
ধন্য তুমি ধন্য হে!
আসলে যে জায়গাটিতে এসে মানুষ কোণঠাসা, হাত-পা বাঁধা, অসহায়, ঠিক সেখানেই অদৃষ্টবাদী। যেমন ধরুন মেট্রোর ভিড়ে আপনার শখের দামি সেলফোনটার পকেটমারি হয়ে গেল। অথচ রোজই তো আপনি ওভাবেই যাতায়াত করেন। কই এতদিন কিছু হয়নি তো? তাহলে ব্যাপারটা কী? তখনই মনে হয়, ব্যাপারটা ওই অদৃষ্ট। মন্দভাগ্য। আর সেই ভাগ্যকেই কবজা করার জন্য টাকা খসিয়ে গ্রহরত্ন ধারন করে ফেলুন।
তবে বিজ্ঞাপনের শর্ত একটাই- গ্রহরত্ন হতে হবে খাঁটি।
মুশকিল এখানেই। ভেজাল সর্বত্র। মানুষেও ভেজাল। বলে এক, করে আর এক। তা এই ভেজালভর্তি শহরে আপনার ঈপ্সিত খাঁটি গ্রহরত্নটি পাবেন কোথায়?
দোকানের সন্ধান দিলেন শিল্পী। বহুগুণে গুণী। যেমন সিনেমার পর্দায়, তেমনি নাটকের মঞ্চতে। তাঁর সুললিত কন্ঠের আবৃত্তির দিওয়ানা গোটা বাংলা। তার ওপরে আছে শিল্পীর এক রাজনৈতিক পরিচিতি।
প্রশ্ন এখানেই। শিল্পীর পরিচিতি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর। আর যতদূর জানি, বামপন্থীদের দাবি মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান। মার্ক্স যে সমাজদর্শনের প্রবক্তা ছিলেন তাতে অদৃষ্টবাদের কোনও ণ্যূনতম জায়গা আছে নাকি? যতদূর জানি, বামপন্থীরা ভরসা রাখেন সংগ্রামে। সংগ্রামেই মানবজীবনের সিদ্ধিলাভ। কিন্তু এই বিশিষ্ট বামপন্থী শিল্পী তো একেবারেই উল্টো সুর গাইলেন। তাঁর দাবি জীবনের মোক্ষলাভের দাওয়াই নির্ভেজাল গ্রহরত্ন।
বলা বাহুল্য, এরকম নামজাদা এক শিল্পীর কথায় অনুপ্রেরণা পেতে পারেন অনেকেই। কিন্তু তারপরেই লোকঠকানো ব্যবসা প্রমাণিত হলে শিল্পী, শাসক আর শোষক, বঞ্চনার ইতিহাস আওড়ে নিজের দায় সারবেন নাতো?
শিল্পীর এই প্রচারে প্রভাবিত হতে পারেন সেই সব মানুষরাও, যাঁরা গতকাল পর্যন্ত সংগ্রামেই ভরসা রেখেছিলেন। নিষ্ঠাবান বামপন্থী। কিন্তু জীবন সংগ্রামে কোণঠাসা। দীর্ঘকাল সযত্নে লালিত বিশ্বাসে চিড় ধরতে পারে তাঁদেরও। একই মতাদর্শের এক বিশিষ্টজনের অভিনেতার হাতের আঙুলে একাধিক আংটির সমাহারে ভাগ্য বদলাক না বদলাক, আদর্শ বদলে যেতে পারে সেই সব মানুষের।
সংগ্রাম-টংগ্রামকে টংয়ে তুলে ভাগ্যবাদী হয়ে যেতে পারেন শুধু বামপন্থীরাই না, কঠোর আপোষহীন জীবন সংগ্রামে আস্থাবান ভদ্রজনেরাও। এক কথায়, জীবনদর্শনে একশো আশি ডিগ্রির পরিবর্তন। বাম থেকে রাম- ফর্মূলার সরলীকরণ।
তাহলে কি ব্যাপারটা ওসব আদর্শ-ফাদর্শ না। রুজি রোজগার। 'ডুডুও খাবো, টামাকও খাবো।'
বামপন্থী দুগ্ধ খাওয়ার দিন শেষ। এবার তামাকসন্ধান। আগে ছিল বিজ্ঞান এখন বিজ্ঞাপন। গ্রহরত্নের বিজ্ঞাপন। আদর্শ বিক্রি হয়ে গেল গ্রহরত্নের জেল্লায়।
আদর্শ-ফাদর্শের কথাও নাহয় বাদ দিলাম। একেবারে বাস্তবের কথায় আসি। শিল্পী গ্রহরত্ন চেনার ব্যাপারে বিশারদ তো?
কেন এই প্রশ্ন?
বড্ড ভুলে যান আপনারা।
এই তো কিছুদিন আগের কথা। বিজ্ঞাপন করতে গিয়েই হেনস্থা হয়েছিলেন বিগ বি, অমিতাভ বচ্চন। ম্যাগি ফুড প্রোডাক্ট মামলায় জড়িয়ে গেছিলেন তিনিও। একই সঙ্গে ফেঁসেছিলেন বলিউডের নায়িকা প্রীতি জিন্টাও। অভিযোগ উঠেছিল প্রোডাক্টের গুণবত্ত্বা নিয়ে। পরে টানাটানি হয় মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়েও।
জানানো হয়েছিল, ফুড প্রোডাক্টটির বিজ্ঞাপনে যে মাত্রায় মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট(MSG) থাকার কথা প্রচার করা হতো, বাস্তবে ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি।
বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যাঁরাই জড়িয়ে থাকবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন তৎকালীন ফুড অ্যান্ড কনজিউমার অ্যাফেয়ার্স-এর মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রসঙ্গে।
ইন্ডিয়ান সিনেমার আইকন যে জাঙ্গিয়াটা পরার কথা বলে চলেছেন, সেটা এক মাসের মধ্যেই ফেঁসে গেলে? কী জবাব দেবেন বলিউড শ্রেষ্ঠ? ধুতে গিয়ে ওই জাঙ্গিয়ার রং চটে গেলে? আবার ইলাস্টিক ঢলঢলে হয়ে কোমর থেকে গড়িয়ে যেতে পারে অবাধ্য জাঙ্গিয়া। মিথ্যা প্রচার চালানোর দায়ে তখন জাঙ্গিয়ার দাম ফেরত দেবেন তো অ্যাংরি হিরো?
গ্রহরত্ন হোক কী জাঙ্গিয়া, এই দুই প্রোডাক্টের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে নিজেদের মেধা, পরিশ্রমের কষ্টার্জিত ভাবমূর্তির সওদা করছেন দুই বিশিষ্ট শিল্পী। বেওসায়িরা ভালভাবেই জানেন, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কাস্টমারের কাছে কখনোই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু এই জনপ্রিয় শিল্পীদের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে বাজারে কেউ কোনও প্রশ্ন তুলবেন না।
অনেকের কাছেই এঁরা আদর্শ। আর সাধারণ মানুষের সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই দুই প্রবীণ শিল্পী পকেটভারী করে চলেছেন। কিন্তু এর ঠিক উল্টোপথে হেঁটে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন মাত্র ছাব্বিশ বছরের এক তরতাজা তরুণী।
মালয়ালম সিনেমার পর্দায় ঝড় তোলা নায়িকা সাই পল্লভি। রং ফর্সা করার এক ক্রিমের বিজ্ঞাপনের বরাত পেয়েছিলেন তিনি। দক্ষিণা দু'কোটি টাকা। একটুও না ভেবে ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন পল্লভি। মেয়ের একটুও বুক কাঁপলো না। ভাঁজ পরলো না কপালেও। কেন?
বোন পূজা। তার গায়ের রং পল্লভির মতো ফর্সা না। সেই নিয়ে পূজার পেছনে লাগতো পল্লভি। নায়িকা বলছেন, 'গায়ের রং ব্যাপারটা সেনসিটিভ। আমি ফর্সা। কিন্তু আমার বোন কালো। দুনিয়ার অনেক মেয়েই এরকম কালো। আর চামড়ার রং কালো হওয়ার জন্য তারা বেশ চাপে থাকে। এই ব্যাপারটা থেকে মেয়েদের বেরোতেই হবে। তাদের বুঝতে হবে ফর্সা হওয়াটা কিছুই জরুরি নয়। তাই ওই ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে রাজি হইনি।'
পেশার জগতে ওই বামপন্থী বা আইকন, দুই তাবড় শিল্পীর সঙ্গে কোনমতেই এক সারিতে বসানোর এখনও সময় হয়নি ওই মালয়ালম নায়িকাকে। কিন্তু আদর্শগত দিক থেকে তিনি ওই দুই বিশিষ্ট শিল্পীকেও টপকে গেলেন। চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিলেন নিজের ইমেজ সব জায়গায় বেচে দেওয়া যায় না। সামাজিক সচেতনতার প্রশ্নেও দায়বদ্ধতা আছে শিল্পীর।
প্রথম প্রশ্ন ঃ শরীরে আঠারো হাজারি গ্রহরত্ন ধারন করলে, আপদ বিপদ থেকে বাঁচা যাবে তো?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: প্রথম ধোয়াতেই কালো জাঙ্গিয়ার রং যদি ফ্যাকাশে হয়ে যায়?
প্রথম প্রশ্ন টলিউডের সেই বিশিষ্ট শিল্পীর কাছে। যিনি খাঁটি গ্রহরত্নের সন্ধান দিয়ে চলেছেন বাংলা জুড়ে। আর দ্বিতীয় প্রশ্ন ইন্ডিয়ান সিনেমার আইকনের কাছে। যিনি তদন্তে নেমেছেন প্যান্টের তলায় কে কোন ব্র্যান্ডের জাঙ্গিয়া পরেছেন জানতে।
ওদিকে ফর্সা করার এক ক্রিমের বিজ্ঞাপনে নিজের মুখ ভাড়া খাটানোর অফারে সরাসরি 'না' করলেন সাই পল্লভি। আর এই 'না'-এর দাম ছিল দু'কোটি টাকা। নামটা আগে শোনেননি তো? সাই পল্লভি মালয়ালম সিনেমার এক তরুণী নায়িকা।
ভরসা রাখুন গ্রহরত্নে। একেবারে টাইট হয়ে যাবেন ভাগ্যদেবী। পরামর্শ বিদগ্ধ বামপন্থী শিল্পীর। পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। এতদিন মার্ক্সবাদের ডঙ্কা বাজাতেন শিল্পী। আজও সময় সুযোগ পেলেই বাজান। আবার অদৃষ্টবাদে গ্রহরত্নের প্রভাবের কথাও প্রচার করেন। ব্যাপারখানা তাহলে দাঁড়ালো কেমন?
'ধম্মেও আছি, জিরাফেও আছি।'
ভাগ্য বিরূপ?
তাহলে গ্রহরত্ন ধারণ করুন। ভাগ্যদেব তখন আপনার পোষা ডগি। আপনার পা চাটবে, আর লেজ নাড়বে।
বিজ্ঞাপনের আশ্বাস অনেকটা এরকম, গ্রহরত্ন আপনার ভাগ্য বদলে দিতে পারে না। তবে বশে আনতে পারে আপনার ভাগ্যদেবীকে। সঙ্গে সীলমোহর সেই বিদগ্ধ শিল্পীর সহাস্য মুখের ছবি।
আরে মশাই, কে কবে কাকে বশে আনতে পেরেছে?
গোর্খারা সেই কবে থেকে গোর্খাল্যান্ডের আবদার ধরে বসে আছেন। উন্নয়নের মোয়া দিয়ে তাদের বশে আনা গেল কি? মার্ক্সবাদের টোটকাও ফেল। হাতছাড়া হয়ে গেছে বাংলা। জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলে কিছু বাঙালির মনভোলানো যায় বৈকি। কিন্তু বাংলাকে বশে আনা সম্ভব এমনটা এখনও প্রমাণিত হয়নি। ওদিকে অনড় কাশ্মীর। তার স্পেশ্যাল স্টেটাস চাই। তাকেও নড়ানো যায়নি। আবার সাময়িক ভাবে আনুগত্য দেখানোকেও আপনারা ভেবে বসেন, যাক তাহলে বশে আনা গেছে! আবার বশে আনা এক। আর বশে রাখা আরেক। পাহাড়, জঙ্গলকেও নাহয় হাসানো গেছিল। কিন্তু বশে রাখতে পারলেন কোথায়? যে দুনিয়াতে আছেন, যাঁদের সঙ্গে আছেন, তাঁদেরকেই বশে রাখতে পারা যায় না। আর তারপরেও গপ্প ফেঁদে বসেন, ভাগ্যদেবীকে বশে আনার।
ধন্য তুমি ধন্য হে!
আসলে যে জায়গাটিতে এসে মানুষ কোণঠাসা, হাত-পা বাঁধা, অসহায়, ঠিক সেখানেই অদৃষ্টবাদী। যেমন ধরুন মেট্রোর ভিড়ে আপনার শখের দামি সেলফোনটার পকেটমারি হয়ে গেল। অথচ রোজই তো আপনি ওভাবেই যাতায়াত করেন। কই এতদিন কিছু হয়নি তো? তাহলে ব্যাপারটা কী? তখনই মনে হয়, ব্যাপারটা ওই অদৃষ্ট। মন্দভাগ্য। আর সেই ভাগ্যকেই কবজা করার জন্য টাকা খসিয়ে গ্রহরত্ন ধারন করে ফেলুন।
তবে বিজ্ঞাপনের শর্ত একটাই- গ্রহরত্ন হতে হবে খাঁটি।
মুশকিল এখানেই। ভেজাল সর্বত্র। মানুষেও ভেজাল। বলে এক, করে আর এক। তা এই ভেজালভর্তি শহরে আপনার ঈপ্সিত খাঁটি গ্রহরত্নটি পাবেন কোথায়?
দোকানের সন্ধান দিলেন শিল্পী। বহুগুণে গুণী। যেমন সিনেমার পর্দায়, তেমনি নাটকের মঞ্চতে। তাঁর সুললিত কন্ঠের আবৃত্তির দিওয়ানা গোটা বাংলা। তার ওপরে আছে শিল্পীর এক রাজনৈতিক পরিচিতি।
প্রশ্ন এখানেই। শিল্পীর পরিচিতি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর। আর যতদূর জানি, বামপন্থীদের দাবি মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান। মার্ক্স যে সমাজদর্শনের প্রবক্তা ছিলেন তাতে অদৃষ্টবাদের কোনও ণ্যূনতম জায়গা আছে নাকি? যতদূর জানি, বামপন্থীরা ভরসা রাখেন সংগ্রামে। সংগ্রামেই মানবজীবনের সিদ্ধিলাভ। কিন্তু এই বিশিষ্ট বামপন্থী শিল্পী তো একেবারেই উল্টো সুর গাইলেন। তাঁর দাবি জীবনের মোক্ষলাভের দাওয়াই নির্ভেজাল গ্রহরত্ন।
বলা বাহুল্য, এরকম নামজাদা এক শিল্পীর কথায় অনুপ্রেরণা পেতে পারেন অনেকেই। কিন্তু তারপরেই লোকঠকানো ব্যবসা প্রমাণিত হলে শিল্পী, শাসক আর শোষক, বঞ্চনার ইতিহাস আওড়ে নিজের দায় সারবেন নাতো?
শিল্পীর এই প্রচারে প্রভাবিত হতে পারেন সেই সব মানুষরাও, যাঁরা গতকাল পর্যন্ত সংগ্রামেই ভরসা রেখেছিলেন। নিষ্ঠাবান বামপন্থী। কিন্তু জীবন সংগ্রামে কোণঠাসা। দীর্ঘকাল সযত্নে লালিত বিশ্বাসে চিড় ধরতে পারে তাঁদেরও। একই মতাদর্শের এক বিশিষ্টজনের অভিনেতার হাতের আঙুলে একাধিক আংটির সমাহারে ভাগ্য বদলাক না বদলাক, আদর্শ বদলে যেতে পারে সেই সব মানুষের।
সংগ্রাম-টংগ্রামকে টংয়ে তুলে ভাগ্যবাদী হয়ে যেতে পারেন শুধু বামপন্থীরাই না, কঠোর আপোষহীন জীবন সংগ্রামে আস্থাবান ভদ্রজনেরাও। এক কথায়, জীবনদর্শনে একশো আশি ডিগ্রির পরিবর্তন। বাম থেকে রাম- ফর্মূলার সরলীকরণ।
তাহলে কি ব্যাপারটা ওসব আদর্শ-ফাদর্শ না। রুজি রোজগার। 'ডুডুও খাবো, টামাকও খাবো।'
বামপন্থী দুগ্ধ খাওয়ার দিন শেষ। এবার তামাকসন্ধান। আগে ছিল বিজ্ঞান এখন বিজ্ঞাপন। গ্রহরত্নের বিজ্ঞাপন। আদর্শ বিক্রি হয়ে গেল গ্রহরত্নের জেল্লায়।
আদর্শ-ফাদর্শের কথাও নাহয় বাদ দিলাম। একেবারে বাস্তবের কথায় আসি। শিল্পী গ্রহরত্ন চেনার ব্যাপারে বিশারদ তো?
কেন এই প্রশ্ন?
বড্ড ভুলে যান আপনারা।
এই তো কিছুদিন আগের কথা। বিজ্ঞাপন করতে গিয়েই হেনস্থা হয়েছিলেন বিগ বি, অমিতাভ বচ্চন। ম্যাগি ফুড প্রোডাক্ট মামলায় জড়িয়ে গেছিলেন তিনিও। একই সঙ্গে ফেঁসেছিলেন বলিউডের নায়িকা প্রীতি জিন্টাও। অভিযোগ উঠেছিল প্রোডাক্টের গুণবত্ত্বা নিয়ে। পরে টানাটানি হয় মাধুরী দীক্ষিতকে নিয়েও।
জানানো হয়েছিল, ফুড প্রোডাক্টটির বিজ্ঞাপনে যে মাত্রায় মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট(MSG) থাকার কথা প্রচার করা হতো, বাস্তবে ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি।
বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞাপনের সঙ্গে যাঁরাই জড়িয়ে থাকবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন তৎকালীন ফুড অ্যান্ড কনজিউমার অ্যাফেয়ার্স-এর মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান।
এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নের প্রসঙ্গে।
ইন্ডিয়ান সিনেমার আইকন যে জাঙ্গিয়াটা পরার কথা বলে চলেছেন, সেটা এক মাসের মধ্যেই ফেঁসে গেলে? কী জবাব দেবেন বলিউড শ্রেষ্ঠ? ধুতে গিয়ে ওই জাঙ্গিয়ার রং চটে গেলে? আবার ইলাস্টিক ঢলঢলে হয়ে কোমর থেকে গড়িয়ে যেতে পারে অবাধ্য জাঙ্গিয়া। মিথ্যা প্রচার চালানোর দায়ে তখন জাঙ্গিয়ার দাম ফেরত দেবেন তো অ্যাংরি হিরো?
গ্রহরত্ন হোক কী জাঙ্গিয়া, এই দুই প্রোডাক্টের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে নিজেদের মেধা, পরিশ্রমের কষ্টার্জিত ভাবমূর্তির সওদা করছেন দুই বিশিষ্ট শিল্পী। বেওসায়িরা ভালভাবেই জানেন, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা কাস্টমারের কাছে কখনোই সন্দেহের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু এই জনপ্রিয় শিল্পীদের গ্রহনযোগ্যতা নিয়ে বাজারে কেউ কোনও প্রশ্ন তুলবেন না।
অনেকের কাছেই এঁরা আদর্শ। আর সাধারণ মানুষের সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েই দুই প্রবীণ শিল্পী পকেটভারী করে চলেছেন। কিন্তু এর ঠিক উল্টোপথে হেঁটে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলেন মাত্র ছাব্বিশ বছরের এক তরতাজা তরুণী।
মালয়ালম সিনেমার পর্দায় ঝড় তোলা নায়িকা সাই পল্লভি। রং ফর্সা করার এক ক্রিমের বিজ্ঞাপনের বরাত পেয়েছিলেন তিনি। দক্ষিণা দু'কোটি টাকা। একটুও না ভেবে ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন পল্লভি। মেয়ের একটুও বুক কাঁপলো না। ভাঁজ পরলো না কপালেও। কেন?
বোন পূজা। তার গায়ের রং পল্লভির মতো ফর্সা না। সেই নিয়ে পূজার পেছনে লাগতো পল্লভি। নায়িকা বলছেন, 'গায়ের রং ব্যাপারটা সেনসিটিভ। আমি ফর্সা। কিন্তু আমার বোন কালো। দুনিয়ার অনেক মেয়েই এরকম কালো। আর চামড়ার রং কালো হওয়ার জন্য তারা বেশ চাপে থাকে। এই ব্যাপারটা থেকে মেয়েদের বেরোতেই হবে। তাদের বুঝতে হবে ফর্সা হওয়াটা কিছুই জরুরি নয়। তাই ওই ফেয়ারনেস ক্রিমের বিজ্ঞাপনে রাজি হইনি।'
পেশার জগতে ওই বামপন্থী বা আইকন, দুই তাবড় শিল্পীর সঙ্গে কোনমতেই এক সারিতে বসানোর এখনও সময় হয়নি ওই মালয়ালম নায়িকাকে। কিন্তু আদর্শগত দিক থেকে তিনি ওই দুই বিশিষ্ট শিল্পীকেও টপকে গেলেন। চোখে আঙুল দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিলেন নিজের ইমেজ সব জায়গায় বেচে দেওয়া যায় না। সামাজিক সচেতনতার প্রশ্নেও দায়বদ্ধতা আছে শিল্পীর।
আজকের প্রেক্ষাপটে এক প্রতিবাদের কথা নিপুণভাবে ফুটে উঠেছে।
ReplyDelete