রণজিৎ গুহ, লেখক ও সমাজকর্মী: সমাজের যে কোনও স্তরে যে কোনও মানুষ অন্যদের ডিঙিয়ে কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা আকাঙ্খা করে।এই সব সুযোগ সুবিধা যদি দেশের সংবিধান স্বীকৃত বা আইন মোতাবেক হয় তাহলে আর বিবেকের কাঁটা খোঁচা দেয় না।অনৈতিক হোক আইনত হলেই যেন আর কিছু বলার থাকে না।আবার নানারকম প্রতিপত্তি খাটিয়ে আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে ব্যাক্তিগত ভাবে অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে গেলে সমগোত্রীয়দের কথা ভাবার দরকারই বা কি? যদি সে সুযোগ না থাকে বা চেষ্টা চরিত্র করে বিফল হয় তবে যুক্তি তর্ক জলাঞ্জলি দিয়ে দল বেঁধে সুযোগ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা আমাদের জাতীয় অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নানা ক্ষেত্রে আমরা কেবলই নানা ধরনের গোষ্ঠী পরিচয়ে সংরক্ষণের আওতায় আসতে চাইছি। সোজা সরল প্রতিযোগিতায় সকলেরই অনিহা। দীর্ঘকালীন সামাজিক অসাম্য এবং স্বজনপোষণ ও দূর্নীতির আবহে কোনও প্রতিযোগিতাই সহজ সরল নয় বলেই বেশিরভাগ মানুষ মনে করেন।কাজেই সার্বিক প্রতিযোগিতা এড়াতে নানা কিসিমে’র সংরক্ষণের দাবী বেড়েই চলেছে। সকলেই কোন না কোন সুবিধাজনক দুর্বল শ্রেণীভুক্ত হয়ে সুযোগ সুবিধা আদায়ের তালে রয়েছে। কেউ জাতিগতভাবে দুর্বল কেউ নিছক সংখ্যায় দুর্বল। কেউ ভাষাগত ভাবে দুর্বল কেউ শারীরিক ভাবে দুর্বল। কেউ আর্থিকভাবে দুর্বল কেউ সামাজিক ভাবে দুর্বল। সকলেই কোনো না কোনও ভাবে অল্প সংখ্যক ভুক্ত।বা সংখ্যা লঘু। অতএব সংখ্যা গুরুদের থেকে আলাদা থাক।আলাদা সিড়ি। সংখ্যা লঘু বা অল্প সংখ্যক দের আলাদা ব্যবস্থা করা নাকি সমাজের মঙ্গল সাধনে সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য। সংখ্যা লঘু থাকার সুবিধা ভোগ করতে সংখ্যা লঘু থাকার অধিকার জোরালো করতে সচেষ্ট অনেকেই। এমনকি রামকৃষ্ণ মিশনের মত সংস্থাও সংখ্যা লঘু হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার জন্য কম মামলা মকর্দমা লড়েননি। ঐ এক উদ্দেশ্য, সাধারণ আইনের বাইরে কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধার আকাঙ্খা। জৈন ধর্মাবলম্বীরা সংখ্যা লঘু কমিশনভুক্ত হতে যারপরনাই চেষ্টা চালাচ্ছেন। দাবি উঠেছে আধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে প্রাচীন পেশা গুলি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরছে অতএব ঐ পেশার মানুষদের সংরক্ষণের আওতায় এনে সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।ভোট কমে যাওয়ার ভয়ে নতুন পেশায় যাওয়ার কথা বলাই যাবে না। সকলেই সংরক্ষণের সুযোগ চাইছে। সকলেই সমাজের মঙ্গলের জন্য বিশেষ সুবিধা দাবী করছেন। শিল্পপতিরা সমাজের জন্যই কম দামে জমি বিদ্যুৎ জল ও শ্রমশক্তি চাইছেন। কর মকুবের সুযোগ পাচ্ছেন। যৌনকর্মীরা সমাজে খুবই সংখ্যা লঘু তাই শিক্ষা স্বাস্থ্যে মাত্রারিক্ত ভর্তুকি দেওয়া সমাজের দায়িত্ব। ধর্মীয় সংখ্যা লঘু অতএব সাধারণ বিচার ব্যবস্থার বাইরে থাকব।চিকিৎসকরা পেশাগত ভাবে সংখ্যা লঘু। অতএব অবহেলার অভিযোগ এলে বিচার নিজের পেশার লোকেরা করবে।বয়স্কদের সংরক্ষণ চাই।অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা চাই।কম ভাড়ায় যাতায়াত। কম কর। অলচিকি ভাষীরা সংখ্যায় অল্প।কাজেই তাদের কিছু সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।প্রাক্তন সৈনিক প্রাক্তন সাংসদ তো অগ্রাধিকার পাবেই।খেলোয়াড়দের অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়ার দায়িত্ব সমাজেরই। কবি সাহিত্যিকরাও অল্প সংখ্যক হিসাবে জোট বাঁধছেন।চিত্রশিল্পীরা কমখরচে প্রদর্শনীর জন্য সমাজের উদ্যোগ চাইছেন। সবরকমের সংখ্যা লঘুদের মোক্ষম যুক্তি যে তারা সংখ্যা গুরুদের দ্বারা উপেক্ষিত অবহেলিত অত্যাচারিত। আবার এই সংখ্যা লঘু গোষ্ঠীগুলি সংখ্যা গুরুদের ভীড়ে মিলতেই চায় না।পৃথক সত্তা আলাদা পরিচয় থাকলে সমাজ কর্তৃপক্ষ খাতির করে।ভোট বড় বালাই। রাজনৈতিক দলগুলি ভোটের খাতিরে নানা কিসিমে’র সংখ্যা লঘুদের জিইয়ে রাখে।
অন্যায্য দাবী পূরনের প্রতিশ্রুতি দেয়। সংখ্যা লঘু নামাবলী গায় দিয়ে বিশেষ সুযোগ সুবিধা আদায়ের ফিকিরে সবাই ওস্তাদ। সংখ্যা গুরুরা যেটুকু যা পায় তাতো পাবই। নেবই।সংখ্যা লঘু পরিচয়ে অতিরিক্ত নেব। নিজেকে সংখ্যা লঘু ভাবা যে একরকমের আত্ম অবমাননা তা বুঝেও অনেকে কিছু সুবিধার লালসায় ক্ষুদ্র গোষ্ঠী পরিচয় এড়াতে পারেনা। বিবেচক মানুষজন কি সোচ্চারে বলবেন না আমার দাবির ঔচিত্য ঠিক হবে নৈতিকতার বিচারে।দলবদ্ধ উচ্চস্বরে কোনও দাবী আইনত প্রতিষ্ঠিত হলেও তা নৈতিক নাও হতে পারে।যে কোনও অল্প সংখ্যক গোষ্ঠী সমাজের কাছে অতিরিক্ত কিছু প্রত্যাশা করার সময় সমাজের সার্বিক মঙ্গলের কথা নিশ্চয়ই স্মরণে রাখবেন।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours