দেবাশিস ভট্টাচার্য, যুক্তিবাদী লেখক, কলকাতা: অলৌকিকের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান আর যুক্তির লড়াই চলছে সেই প্রাচীন যুগ থেকেই । কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাসের রক্তচক্ষু যেমন আছে, তেমনি প্রতিস্পর্ধা আর প্রশ্নও আছে চিরকালই । প্রাচীন গ্রিসে এপিকিউরাস, প্রাচীন ভারতে চার্বাকপন্থীরা, মধ্যযুগীয় মধ্যপ্রাচ্যে মুতাজলা দার্শনিক সম্প্রদায়, আধুনিক যুগের গোড়ায় ব্রিটেনে ফ্রান্সিস বেকন, অষ্টাদশ শতকে ব্রিটেনে ডেভিড হিউম এবং ফ্রান্সে ভলতেয়র-দিদেরো-এলভেতিউস-ওলবাক, এবং আজকের দিনে অসংখ্য বিজ্ঞানী-দার্শনিক-সমাজবিদ ও কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা --- এঁদের মধ্যে দিয়ে চলেছে অলৌকিকের বিরুদ্ধে যুক্তি আর বিজ্ঞানের সংগ্রাম । বিশ শতকের মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন, তিনি দেখতে চান, ঈশ্বর ইচ্ছে করলে এই জগতটাকে অন্যভাবে বানাতে পারতেন কিনা । একথার মধ্যে লুকিয়েছিল অলৌকিকের ধারণা এবং তার প্রতি বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জের সারাৎসার । জগতের সবই যদি যৌক্তিক নিয়ম দিয়ে চলে আর বিজ্ঞান যদি তা জানতে পারে, তাহলে তো সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় সবই হবে পূর্বনির্ধারিত, সেখানে ঐশ্বরিক লীলার জন্য কোনও জায়গা থাকবে না ।
অলৌকিকতার জন্য আসন বিছা্নো থাকবে শুধু সেখানেই, যেখানে আছে যুক্তির ফাঁক । কিম্বা হয়ত উল্টো করে বলা যায়, যুক্তির টান টান জালটি যেখানে যেখানে ছেঁড়া, সেই সব গহ্বরের ঠিক তলাতেই পাতা থাকে অলৌকিকের ফাঁদ । আইনস্টাইনের বিজ্ঞানী-মানস চেয়েছিল ওই জা্লটির সব গর্ত মেরামত করে এক সর্বব্যাপী যুক্তির জাল বানাতে, আবার তার তলায় হয়ত ছিল একান্ত মনুষ্যসুলভ এক সংশয়ও --- অতবড় কাজটা শেষপর্যন্ত পেরে ওঠা যাবে তো ? সব বিজ্ঞানীর মনেই হয়ত থাকে এই প্রশ্ন । কিন্তু তাঁর বৈজ্ঞানিক সত্তা সব সময়ই ভরসা যুগিয়ে চলে --- পারা যাবে, নিশ্চয়ই পারা যাবে । সেটা তুমিও জানো, না হলে কি আর গবেষণা চালিয়ে যেতে পারতে ? গবেষণাটা করছ কেন বলতো ? যুক্তির সর্বব্যাপী জালের আরও একটি ছিন্ন সূত্র শক্ত করে টেনে বাঁধবার জন্যই তো --- তাই নয় কি ? এমনি করে তোমরা যুগের পর যুগ, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চালাবে মানবীয় জ্ঞানের অনিঃশেষ অভিযান, আর অলৌকিকের আসনটি হয়ে পড়বে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর । অবশ্য এখানে একটা প্রশ্ন থাকছে । অলৌকিক কি শুধু সেখানেই, যেখানে সম্যক জ্ঞানের অভাব ? অবশ্যই না । যা জানা আছে তার মধ্যেও থাকতে পারে অলৌকিকতা, যদি যা জানা আছে তাকে স্বীকার করবার ইচ্ছেটুকু জলাঞ্জলি দেওয়া যায় । ওই আগের দিন যে পাঁচুগোপালের কথা বলছিলাম, মনে আছে তো ? সেই যে ফেলটুস পাঁচু, যে নাকি নারায়ণের সিন্নি খেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষাটা উৎরে গিয়েছিল । পাড়া-পড়শি আত্মীয়স্বজন সব সিন্নির কথা বললেও পাঁচুর বাপ কিন্তু বলেছিল অন্য কথা, যদিও কেউ তা কানেই তোলেনি । সে বলেছিল,
সিন্নি-টিন্নি কিছু নয়, মেলা গাঁটের কড়ি খরচা করে গুচ্ছ গুচ্ছ মাস্টার রাখা আর ফেল করলে সারারাত গোয়ালঘরে বেঁধে রাখার হুমকি --- এটাই নাকি পাশের আসল কারণ । কিন্তু তার কথা কে আর গ্রাহ্যি করে । কোথায় বলে নারায়ণের সিন্নি আর কোথায় পাঁচুর বাপ --- ছ্যাঃ ! অলৌকিকের ফাঁদ, অতএব, থাকছেই । অজ্ঞানে এবং সজ্ঞানেও । আর তাই সেই সঙ্গে থাকছে অন্ধকার ও অযুক্তির অত্যাচার, থাকছে তার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ । যুক্তির জালটা আমাদের হাতেই আছে, কিন্তু এবার ওটাকে কাজে লাগাতে হবে । আমরা প্রস্তুত তো, অলৌকিকের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে ?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours