Fiture
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ

'তারে' বলে দিয়ো....
উত্তমকুমার বলেছিলেন বিশ্বজিতকে।
সেই 1961 সালে। 'দুই ভাই' সিনেমায়।

'দিদিকে বলো'। 
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বললেন রাজ্যবাসীকে।
সাল 2019। নজরুল মঞ্চে।


কেন? 'তারে' বলে দিলে আর চলবে না। 'তারে'র ওপর আর ভরসা রইলো না! গোটাটাই একমেবাদ্বিতীয়ম।
'হ্যালো দিদি!'
এবার থেকে দরকার পড়লে, সরাসরি তাঁর সঙ্গেই যোগাযোগ করতে পারবেন সাধারণ মানুষ। সোমবার কলকাতার নজরুল মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের এক সাংগঠনিক বৈঠকে জানিয়ে দিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারজন্য কাজ শুরু করলো এক নতুন ফোন নাম্বার, সঙ্গে ওয়েবসাইট। নিবিড় হলো রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের সঙ্গে রাজ্যবাসীর যোগাযোগ ব্যবস্থা।

কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়।
দিদি আর রাজ্যবাসীর মধ্যে যাদের সমন্বয় করার কথা, তাঁদের হলোটা কী? শহরবাসী আমরা। হাত বাড়ালেই কাউন্সিলর। খাতায় কলমে অবশ্য। প্রয়োজনে দেখা পাওয়া ভার। আবার পেলেও পারিষদে ঘেরা। দর্শনার্থীর সংখ্যাও নেহাত মন্দ হয় না। ধৈর্য ধরতে হয়। দেখা করলেই সমস্যা মিটবে, এমনটাও নয়। 

"আচ্ছা, দেখছি।" আশ্বাসবাণী কাউন্সিলরের। সঙ্গে সেলের বাজারের মতো ডিসকাউন্টে কিছু পরামর্শ। "রেশন কার্ডের একটা জেরক্স কপি আনবেন। আর আধার কার্ডের একটা কপি আনতেও ভুলবেন না যেন।"
- "ঠিক আছে। কাল তাহলে এরকম সময়ে, বেলা দশটার মধ্যেই চলে আসবো।" আপনি আশ্বস্ত হতে চাইলেন।
- "বিশু, কাল অমুক ক্লাবের প্রোগ্রামটা কটায় রে?" কাউন্সিলর জানতে চাইলেন।
- "দশটায় দাদা।" পারিষদের জবাব।
- "আপনি বরং পরশুদিন চলে আসুন।"
ততক্ষণে আরেক দর্শনার্থী তাঁর অভাব অভিযোগের কথা শোনাতে লেগেছেন। অগত্যা, আপনি নমস্কার- টমস্কার সেরে বিদায় নিলেন। তিনদিন চক্কর মারার পর চতুর্থ দিনে দেখা পেয়েছিলেন কাউন্সিলরের। তাও কাজ গোটাতে পারলেন না। পরশুদিনই বা কী হবে, কে জানে!
ছাতাখুলে বাড়িমুখো হলেন। মনের যতো জমা ক্ষোভ গলগল করে ঝড়তে লাগলো শরীরের ঘাম হয়ে। "দাঁড়া, তোকে এবার ভোট দিচ্ছি!" মনে- মনে বিড়বিড় করতে- করতে হাঁটা লাগালেন।

কাউন্সিলর পর্যন্ত পৌঁছতেই এত হ্যাপা, তাহলে বিধায়ক, সংসদরাতো ডুমুরের ফুল হবেনই। তাঁদের তো আরও অনেক বড়ো জায়গা নিয়ে কাজ করতে হয়। আরও কাজ, আরও চাপ। বেবাক জনসাধারণের ভিড়। 

বেশকিছু মানুষ অফিসের ভেতর ভিড় জমিয়েছেন। কতক্ষণ ধরে কে জানে। টেবিলের ওপারে কয়েকজন বসে দর্শনার্থীদের আসার কারণ জেনে নিচ্ছেন। এঁরা বিধায়কের পারিষদ। ডান হাত, বাঁ হাতও হতে পারেন। অনেকে অনেকরকম কাগজপত্র, আবেদনপত্র জমা দিচ্ছেন টেবিলে। দর্শনার্থীদের কথাতেই পরিষ্কার, অনেকেই এর আগেও এসেছেন। আপনিও মনে- মনে ইষ্টনাম জপ করছেন, যাতে একবারেই আপনার কাজটা হয়ে যায়। বয়স হয়েছে। এখন আর দৌড়াদৌড়ি শরীরে দেয় না। বয়স হয়েছে তো! টেবিলের ওপারে বসা বিশিষ্টজনেরা টেবিলে জমা পড়া সব কাগজপত্র দেখে নিচ্ছেন। প্রয়োজন হলে টুকটাক কিছু জেনে নিচ্ছেন। আবার পরামর্শও দিচ্ছেন। আপনিও সময় সুযোগ বুঝে দরবার ঠুকে রাখলেন।
- "বসুন, স্যার আসছেন।"

উনি তো বলেই খালাস। এদিকে একটাও চেয়ার খালি নেই। মানুষের ভিড়। ঘরেও ঠিকঠাক ভাবে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। অগত্যা, বাইরে বেরিয়ে এসে মোবাইলে টাইমটা দেখলেন। এগারোটা বাজতে চলেছে। কয়েক পা এগোলেই চা- দোকান। পকেটে সিগারেট আছে। মনটাও কেমন যেন চা- চা করছে। কিন্তু বিধায়কের দপ্তরটাকে চোখের আড়াল করতে সাহস হচ্ছে না। কে জানে কোন শুভ মুহূর্তে আগমন হবে স্যারের। এসব সাতপাঁচ ভাবতে- ভাবতেই ফস করে সিগারেটে আগুন দিলেন।

একটার জায়গায় দুটো সিগারেট ফোঁকা হয়ে গেল। তবু দেখা নেই এমএলএ সাহেবের। দপ্তরের পাশেই তাঁর বাড়ি। মধ্যে-মধ্যেই দু- একজন সেই বাড়ির ভেতর ঢুকছেন। আবার বেরিয়েও আসছেন। আর আপনি হ্যাংলার মতো তাঁদের দিকে তাকিয়েই আছেন। ভাবছেন, কতো ক্ষমতাবান এঁরা। কী সুখেই না জানি থাকেন! দরকার হলেই সোজা বিধায়কের অন্দরমহলে ঢুকে পড়েন।
 
এদিকে আপনার চাতক প্রতীক্ষারও বাঁধ ভাঙতে চলেছে। একজনকে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই বসলেন, বিধায়ক বাবুর বেরোতে আর কতক্ষণ? শুনলেন ভেতরে মিটিং চলছে। থানার বড়বাবুও এসছেন। মিটিং শেষ হলে, স্নান পুজো সেরে দাদা বেরোবেন। বসতে হবে।
এরপর আপনি কপালে জোড়হাত ঠেকিয়ে আপনার ইষ্টদেবকে স্মরণ করে অবশ্যই বলেছেন, "রক্ষা করো প্রভু। এযাত্রা ভালোয়-ভালোয় পার করে দাও।" কাউন্সিলর, বিধায়কের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হলো, তারপর আর সাহস করে সাংসদের ত্রিসীমানায় পা রাখেননি। 

কাউন্সিলর, বিধায়ক, সাংসদ। ভোটে জেতার আগে একরকম জেতার পর অন্যরকম। আগে সহনাগরিক, প্রতিবেশি, পরে অভিভাবক। আমাদের স্থানীয় রাজনৈতিক অভিভাবক। তা কোন অভিভাবকরাই বা কনিষ্ঠজনদের ঠিকঠাক পাত্তা দেন? চেয়ার, টেবিল পেয়ে গেলেই হলো- সবাই রাজা। জনসাধারণ ছাড়া।
সরকারি কর্মচারীদের কাছে যান, একই অভিজ্ঞতা হবে। থানা, পোস্ট অফিস থেকে ব্যাঙ্ক, সর্বত্র একই হাওয়া। 'আমরা চলতি হাওয়ার পন্থী!'

রাজনীতি না, এটাই প্রচলিত সমাজ-সংসারনীতি। রাজনৈতিক অভিভাবকরাও এই সমাজেরই একজন। সুতরাং তাঁদের আদব- কায়দাও একইরকম। শুধু বাংলা না, ভূ- ভারতের ছবিটা প্রায় একইরকম। মাথাভারী সরকারি প্রশাসনের এই রীতিই ভারতবাসীর গা- সওয়া। এ নিয়ে অযথা রাজনীতি করাও যুক্তিযুক্ত না। 

ভেবে দেখুন, বামফ্রন্টের সময়েও ছবিটা ছিলো একই। আপনি মাঞ্জা মেরে কাউন্সিলরের কাছে একদিন গেলেন, আর হাসতে- হাসতে কাজ সেরে ফিরলেন, এমনটা মোটেই ছিলো না। বরং আজ লোকাল কমিটি, কাল জোনাল কমিটির কমরেডদের কাছে দৌড়তে গিয়ে, তখনও নাভিশ্বাস উঠতো। 
'আমরা করবো জয়' গুনগুন করতে করতে নিজের ভদ্রাবাসে ফিরতেন। আর মনে সাহস সঞ্চয় করতেন আগামিকালের জন্য।
দিন বদলেছে। শাসক বদলেছে। বদলায়নি আমাদের ছবিটা। 

আপনার এই গোটা অভিজ্ঞতার খবর রাখেন মুখ্যমন্ত্রী। তাই তিনি সরাসরি নিজের কাঁধেই সব দায়- দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। দরকারে ঘরে বসেই একটা 'হ্যালো' করুন। যা বলার বলুন, সরাসরি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানকেই। যাঁর মুখ দেখে আপনি ইভিএমের বোতামটা টিপেছিলেন। মন্দজনের কথাই কি তাহলে ঠিক? তৃণমূলে একটাই পোস্ট। বাকীসব ল্যাম্পপোস্ট!

সরকারি প্রশাসনের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনই না বাড়ালে নয়। রাজ্যের শাসকদলের কাছে, লোকসভার ভোটে স্পষ্ট ইঙ্গিত গৈরিক আগ্রাসনের। ঘাড়ের ওপর শ্বাস ফেলছে বিজেপি। বামফ্রন্ট, কংগ্রেসের ভোট তলানিতে ঠেকা, তৃণমূলের কাছেও সর্বনাশা ইঙ্গিত। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে পরিষ্কার, রাজ্যের ভোটব্যাঙ্কের স্পষ্ট বিভাজন দুই শিবিরের মধ্যে। হতে চলেছে সরাসরি টক্কর, তৃণমূল বিজেপি'র। সুতরাং সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা যেনতেন প্রকারেণ বাড়াতেই হবে। রাশ টানতে হবে মানুষের ক্ষোভের। তাই কি এই নয়া ব্যবস্থা? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সরাসরি ফোন। ওয়েবসাইট। বার্তালাপের সুযোগ সুবিধা।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা ঘটনার পেছনে নির্বাচনী বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কিশোরের ভূমিকা আছে বলে সন্দেহ করছেন। সন্দেহের কারণ, নবান্নে ইতিমধ্যেই আনাগোনা শুরু হয়েছে প্রশান্ত কিশোরের। তাঁর পরামর্শেই তৃণমূল দল এক কর্পোরেট ভাবমূর্তি তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে ধারনা। কিন্তু রাজ্যবাসীর যাবতীয় অভাব অভিযোগ শোনার যে গুরুদায়িত্ব মুখ্যমন্ত্রী নিজের কাঁধে তুলে নিলেন, তা বাস্তবোচিত তো? কারণ পাবলিকের চাহিদা কিন্তু অসীম। তা মেটাতে গেলে কল্পতরু হওয়া ছাড়া গতি নেই।

তাত্ত্বিক দিক দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করলে, গোটা ব্যাপারটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে অনায়াসেই প্রশ্ন তোলা যায়। ক্ষমতার বিকেন্দ্রিকরণই সুপ্রশাসনের দিক থেকে সুবিধাজনক এবং আদর্শও। এবার হলো ঠিক উল্টোটাই। গোটা প্রশাসনিক জিম্মাদারিটা যেন তুলে দেওয়া হলো মাত্র একটা কাঁধেই।

এর আগে রাজ্যের বড় জেলা ভেঙে এলাকা কমিয়ে প্রশাসনের সুবিধা করে দিতে চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এবার তিনি উল্টোপথে হাঁটলেন। পরিধি বাড়িয়ে নিলেন নিজের দায়- দায়িত্বের। শেষ পর্যন্ত, সব সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তো? কারণ ভালমন্দের যাবতীয় দায় বর্তাবে একমাত্র তাঁর ওপরেই। 

সাধু সাবধান, শেষ পর্যন্ত অঞ্জন দত্তের বেলা বোস কেস না হয়ে যায়। মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া নাম্বারে যখন কলের ঝড় উঠবে, তখন তা ধরার জন্য হয়ত হাতের সংখ্যাও কম পড়বে। বাস্তব বড় নির্মম। সদিচ্ছা থাকলেও, অনেক সময় সবকাজ ঠিকঠাক ভাবে করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সাংবিধানিক প্রধান মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সে কথাটি এতদিনে হাড়ে- হাড়ে টের পেয়ে গেছেন।

- "হ্যালো দিদি, আপনি শুনছেন?
হ্যালো!"


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours