Fitite
অনুপ চক্রবর্তী, নাট্যকার, কলকাতা: ‘’The historical meaning of the term Hindu has evolved with time. Starting with the Persian and Greek references to the land of the Indus in the 1st millennium BCE through the texts of the medieval era, the term Hindu implied a geographic, ethnic or cultural identifier for people living in the Indian subcontinent around or beyond the Sindhu (Indus) river.’’ হিন্দু ধর্ম হল আসলে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা। একটা পলিটি। কারা হিন্দু ? দেখা যাক। যে উচ্চবর্ণের মানুষেরা দলিত বর্ণের মানুষদের হত্যা বা নির্যাতন করছে তারা হিন্দু। আবার নিহত বা নির্যাতিত দলিত মানুষেরাও হিন্দু। নির্যাতিত দলিত ছাত্র রোহিত ভামুলার মৃত্যুর জন্যে দায়ী উচ্চবর্ণের মানুষেরা হিন্দু। আবার নিহত দলিত রোহিত ভামুলাও হিন্দু। আশ্চর্য এই হিন্দুত্ব যার মধ্যে আজও পূরোমাত্রায় সক্রিয় ঘৃণা ভরা জাতিভেদ। অনৈক্যের জাতপাত। অথচ এই ভারতবর্ষে ঋগ্বেদের যুগে জাতিভেদ ছিল না।
‘কারুরহং ততো ভিষগুপল প্রক্ষিণী না না। নানা ধিয়ো বসূযবোহনু গা ইব তস্থিমেন্দ্রায়েন্দোপরিস্রব।’ – ঋগ্বেদ ( ৯।১১২ সূক্ত )। অর্থাৎ একই পরিবারের কেউ স্তোত্র রচনা করত। কেউ ভিষক অর্থাৎ চিকিৎসক বা কেউ যব ভাঙতো। মহাভারতেও এই জাতিভেদ না থাকার কথাটা স্পষ্টভাবে আছে। ‘ন বিশেষোস্তি বর্ণানাং সর্ব্বং ব্রাহ্ম মিদং জগৎ। ব্রহ্মণা পূর্ব্বসৃষ্টংহি কর্ম্মভিঃ বর্ণতাং গতং।। ’ – শান্তিপর্ব। মহাভারত। এর অর্থ বর্ণভেদ নেই। সমস্ত জগতে এক ব্রাহ্মণ মাত্র ব্রহ্ম কর্তৃক পূর্বে সৃষ্ট হয়েছিলেন। তারপর কর্মের বিভিন্নতা বশতঃ বর্ণের বিভিন্নতা প্রাপ্ত হয়েছেন। পরবর্তীকালে হীন বর্ণভেদ বা জাতিভেদ সৃষ্টি হয়। ঋগ্বেদে বর্ণভেদের যে পুরুষসূক্ত আছে তা প্রক্ষিপ্ত। পরে লেখা। আধুনিক সংস্কৃতে পরবর্তীকালে লেখা এই পুরুষসূক্ত ঋগ্বেদে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পুরুষসূক্তে হীন বর্ণভেদ বা জাতিভেদের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। ‘ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহু রাজন্যঃ কৃতঃ। উরুতদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্র অজায়তঃ।।‘ - ঋগ্বেদ ( ১০।৯০ সূক্ত )। এই পুরুষসূক্তে সমগ্র সমাজকে একটা বিরাট পুরুষের মতো ভাবা হচ্ছে যার মুখ হল ব্রাহ্মণ, দুটো হাত হল ক্ষত্রিয়, উরু হল বৈশ্য ও পদযুগল হল শূদ্র। এইতো সমাজ যেখানে ব্যাপক সংখ্যক মানুষদের চূড়ান্ত অবমানিত করে পায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, অথচ রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যারা সভ্যতার প্রদীপের পিলসুজ, যারা ধারণ করে আছে ঐ সভ্যতাকে। আবহমান কাল ধরে যাদের শ্রম নির্মমভাবে নিংড়ে নিয়ে তথাকথিত সভ্যতার জয়রথ এগিয়ে চলেছে। অথচ যুগ যুগ ধরে যারা শুধু পেয়েছে চরম দারিদ্র্য, অনাহার, অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, অবমাননা ও ঘৃণা, দীর্ঘকালীন আর্যীকরণের লড়াইয়ে জয়ী আর্যরা যেসব বিজিত অনার্য কৃষিজীবী ও অরণ্যবাসী জনজাতিদের দাস নামে অভিহিত করে তাদের সমাজে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, যাদের পশুর মতো মনে করে নির্যাতন করত, নিংড়ে নিত যাদের সমস্ত শ্রম আর যাদের পারেনি তাদের নাম দিয়েছিল দস্যু।অনেকের মুখে একটা কথা আজকাল শোনা যায় ‘ মুসলিম আধিপত্য চলেছিল হাজার বছর’। মৌলবাদীরা বরাবর ঐরকম কথা বলে। কিন্ত ঐরকমভাবে সমগ্র বিষয়টা উপস্থাপিত করাটা ভুল। কারণ ইতিহাস অন্য কথা বলে। বৃটিশ শাসনের আগে পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্রের কোন অস্তিত্ব ছিল না। ভারতে পলিটিক্যাল nationhood এর জন্ম বৃটিশ শাসনে। তার আগে ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭৫০খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে স্রোতের মতো আর্য,গ্রীক,শক,হুন,তুর্কী,পাঠান,মোগল,পর্তুগীজ,ডাচ,ফ্রেঞ্চ ও ইংরেজরা আসতে থাকে। বৃটিশরা ছাড়া অল্পসংখ্যক ইয়োরোপীয় সমেত সবাই এখানে আদি ও অনার্য জনগোষ্ঠীগুলোর মানুষদের সঙ্গে মিশে যায়। এখানেই বিয়ে শাদি করে। সন্তান সন্ততির জন্ম দেয়। ব্যাপকভাবে ও গভীরভাবে সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ও সংস্কৃতির সমন্বয় হয় ভাষায়,সাহিত্যে,সংগীতে,স্থাপত্যে,চিত্রকলায়,পোশাকে,খাদ্যাভাসে,আচারে,আচরণে এমনকি অনেক রিচুয়ালে। ভারতীয় সংস্কৃতি হল এই মিশ্র সংস্কৃতি।যৌগিক সংস্কৃতি। এটাই রবীন্দ্রনাথ খুব প্রাঞ্জলভাবে তাঁর ভারততীর্থ কবিতায় বলেছেন। এর সঙ্গে নৃতাত্বিক সংমিশ্রণও কমবেশী হয়েছিল। এই সংমিশ্রণছাড়াও ভারতবর্ষ বহু ধর্মের,বহু ভাষার,বহু সংস্কৃতির ও বহু নৃগোষ্ঠীর দেশ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর Nationalism in India প্রবন্ধে nation এর ওপরে মানবতাকে স্থান দিয়েছেন। আজ তিনি জীবিত থাকলে ঐ প্রবন্ধ লেখার জন্যে হয়ত মৌলবাদী অন্ধ জাতীয়তাবাদীরা তাঁকেও দেশদ্রোহী বলত। এবার আসছে আধিপত্যের প্রশ্ন। এই আধিপত্যের ব্যাপারটা মূলতঃ রাজনৈতিক। বৃটিশপূর্ব ভারতীয় উপমহাদেশে বরাবরই ছোট বড়ো বহু রাজ্য ছিল যাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ, আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ লেগেই থাকত। ঋগ্বেদের যুগে রাজা সুদাসের সঙ্গে দশরাজার যুদ্ধ থেকে শুরু করে পৌরাণিক কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ বা পৌরাণিক রামরাবণের যুদ্ধ সমেত ঐতিহাসিক অসংখ্য যুদ্ধে বহু আর্য জনগোষ্ঠী,বহু অনার্য জনগোষ্ঠী,হিন্দু,বৌদ্ধ,পাঠান,মোগল,শিখ ইত্যাদিদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই লেগেই থাকত। এই সবই রাজনৈতিক লড়াই। ধর্মীয় নয়। বহু হিন্দু রাজাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের উদাহরণ ইতিহাসে ভুরিভুরি আছে। বস্তুত সুলতান যুগের আগে পর্যন্ত যাবতীয় যুদ্ধের অধিকাংশই হয়েছিল হিন্দু রাজাদের মধ্যে। এছাড়া বহু লড়াই হয়েছিল হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে। মোগলদের সঙ্গে রাজপুতদের বা মারাঠাদের লড়াই রাজনৈতিক আধিপত্যের লড়াই। ধর্মীয় লড়াই নয়। আকবরের ডানহাত মানসিংহ হিন্দু ছিল। শিবাজীর সৈন্যবাহিনীতে বহু মুসলিম সেনাপতি ছিল। শিবাজীর দেহরক্ষী ছিল মুসলিম। আফজল খাঁর দেহরক্ষী ছিল হিন্দু। মারাঠা হিন্দু বর্গী আক্রমণ থেকে বাংলাকে রক্ষা করেছিল বাংলার নবাব আলিবর্দী খাঁ। বারোভুঁইয়ার অন্যতম ভুঁইয়া রাজা প্রতাপাদিত্যরায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে হিন্দু ও মুসলিম প্রজারা একযোগে মোগল বাদশাহের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেছিল। রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানীর নাম ছিল মহম্মদপুর। লাতিন আমেরিকার জনগোষ্ঠীগুলোকে স্প্যানিশ ও পর্তুগীজ সামাজ্যবাদীরা যেরকম ভয়ংকরভাবে বলপ্রয়োগ করে খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করেছিল,ভারতবর্ষে সেভাবে ধর্মান্তরিতকরণ হয়নি। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বর্ণাশ্রম ধর্মের জাতপাত ঘটিত শোষণ,অত্যাচার ও অসম্মানের হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রধানত নিম্নবর্গীয় মানুষেরা দলে দলে বৌদ্ধ,জৈন,শিখ, ইসলাম,বৈষ্ণব ও খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিল। অবশ্য বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ বা পদোন্নতির জন্য ধর্মান্তরিতকরণও হয়েছিল। অন্যধর্মের ধর্মস্থান ভেঙে ফেলাটাও মধ্যযুগে অনেক হয়েছিল। বৌদ্ধ মন্দির ভেঙে হিন্দু মন্দির হয়েছিল। হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছিল। তবে ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষদের মধ্যে মোটামুটিভাবে শান্তিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান ছিল। হিন্দু,বৌদ্ধ ও মুসলিম সব শাসক ও সামন্তপ্রভুরা ব্যাপক সংখ্যক নিম্নবর্গীয় কৃষক ইত্যাদিদের শোষণ ও অত্যাচার করত। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের যুগের হিন্দু ও মুসলিম উভয় জমিদারদের তীব্র শোষণে গরীবচাষীদের ত্রাহি ত্রাহি রব উঠত। এরপরের ইতিহাস খুব সরল। চতুর বৃটিশরা বিভেদ করে শাসন করার নীতি অনুসরণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করা শুরু করল। উথ্থান হল হিন্দু ও মুসলিম উভয় প্রকার নানা মৌলবাদী সংগঠনের। তারপর ১৯৪৭ সালে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় চতুর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী লুন্ঠন ও মার্কেন্টাইল পুঁজিবাদী শোষণ অব্যাহত রাখার স্বার্থে তাদের বিভাজননীতি প্রয়োগ করে ভারতীয় উপমহাদেশকে দুর্বল করার জন্যে দ্বিখণ্ডিত করল শাসনক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্যে। সাধারণ মানুষের গণভোট না নিয়ে। তাদের মতামত না নিয়ে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের মদতে শাসনক্ষমতা লাভ করার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলো ভারতবর্ষকে পার্টিশনে সম্মতি দান করল। পাঞ্জাব ও বাংলায় হল ভয়ানক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা। রক্তে লাল হয়ে গেল পাঞ্জাব ও বাঙলা। দুই প্রদেশেই অজস্র হিন্দু ও মুসলিম মানুষ নিহত হল, জীবন্ত দগ্ধ হল, ধর্ষিত হল ও লক্ষ লক্ষ মানুষ উদ্বাস্তু হল।
রাজনৈতিক দলগুলোর করা এই পার্টিশনের জন্যে। আজ আবার NRC প্রয়োগ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এটা কি মানবিকতার বিচারে নায্য? সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও ঘৃণার আগুন জ্বলতে শুরু করেছে। সংকীর্ণ ও উগ্রজাতীয়তাবাদের আগুন জ্বলছে। বহুস্বরিক ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এসব কি দেশভূমির ও জনগণের শান্তির চরম পরিপন্থী নয়?



Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours