অনুপ চক্রবর্তী, নাট্যকার, কলকাতা:
(চরিত্রঃ সিরাজউদ্দৌলা)
সিরাজ ।। ওঃ! কী ভীষণ অন্ধকার! শুধু ওপরের জানলা দিয়ে এক চিলতে তারার আলো আসছে। আমি সুবে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধে হেরে গিয়ে এখন অন্ধকূপের মতো এই ছোট্ট ঘরে বন্দী। হয়ত আমাকে একটু পরেই এই অন্ধকূপে হত্যা করা হবে। আমি কিন্তু কলকাতায় ইংরেজ সৈন্যদের অন্ধকূপে হত্যা করিনি। হলওয়েল এই মিথ্যাটা সর্বত্র প্রচার করেছিল। আমি জানি না আমার নসীবে কী আছে। আমাকে কি বেইমান মীরজাফর এখন কোতল করবে? নাকি ইংরেজদের হাতে আমাকে তুলে দেবে আরো অসম্মানের জন্যে? নাকি ইংরেজরা আমাকে কোতল না করে তাদের গোলাম বানিয়ে মসনদে আবার বসিয়ে রেখে ওদের হাতের পুতুল করে রাখবে? এটাও করতে পারে ইংরেজরা। কেননা বেনিয়া ইংরেজরা জানে সুবে বাংলার অনেক মানুষ আমাকে খতম করা হয়ত ভালভাবে মেনে নেবে না। মীরজাফরও হয়তো সাহস করবে না আমাকে কোতল করতে। কেন না এখনও অনেক সৈন্য আর অনেক রাজ কর্মচারীও হয়ত আমার অনুগত। হয়ত অনেক প্রজাও এখনও আমাকে চায়।
কিংবা হয়ত আমাকে কেউ চায় না। হয়ত আমাকে কোতল করে প্রাসাদের বাইরে ঝুলিয়ে রেখে দিলে কারোর কিছু যায় আসবে না। কিন্তু আমি যদি যুদ্ধে না হেরে যেতাম - যদি মীরজাফররা আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা না করত - যদি পলাশীর আমবাগানে বেইমান মীরজাফর আমারই পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে কাঠের পুতুলের মত না দাঁড়িয়ে থেকে ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করত - যদি না হঠাৎ বৃষ্টিতে আমার গোলন্দাজের বারুদ ভিজে যেত - যদি মীরমদনের কামান ফেটে না যেত - যদি মীরমদন নিহত না হত - আমারই ভয়ানক ভুল হয়েছিল - ফোট উইলিয়াম যখন গুঁড়িয়ে দিয়েছিলাম, তখনই নির্মূল করা উচিত ছিল ইংরেজদের - কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না - একদিকে দিল্লির মুঘল বাদশার আক্রমণের ভয় - অন্যদিকে মারাঠা বর্গীদের আবার হামলার ভয় - আর এদিকে ইংরেজ - এই তিন মুখী বিপদের মধ্যে ইংরেজদের সঙ্গে আমার সাময়িক সন্ধি না করে উপায় ছিল না- আমি ভাবতে পারিনি চক্রান্ত এত গভীর হয়েছে - একদিকে ঘসেটি বেগম আর অন্যদিকে শওকত জঙ্গ - হ্যাঁ - শওকত জঙ্গকে হত্যা করে আর ঘসেটি বেগমকে অন্তরীণ করে আমি ঠিকই করেছি। আমি বুঝতে পারিনি মীরজাফর, জগৎ শেঠ, রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদরা তলে তলে ইংরেজদের সঙ্গে এত গভীর চক্রান্ত করেছে। আমার জাসুসরা আমাকে সেরকম কোন খবর যদি আগাম আমাকে দিত, তাহলে পলাশীর যুদ্ধে আমার পরাজয় হয়ত হোত না। তারপরেও আমি যদি পলাশী থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে ফিরে না যেতাম - ফিরে যেতে গিয়ে শেষ ভুলটা করলাম- ওঃ। কী ভয়ানক ভুল করলাম। সৈন্যদের মনোবল ভেঙে গেল। আমারই ভুলের জন্যে আজ আমি মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে। না। শুধু ভুল নয়। চরম বিশ্বাসঘাতকতা। চরম বেইমানির শিকার আমি। নাকি এসবই আমার গুনাহের ফল? আল্লাহ! আমি কি সারা জীবন ধরে শুধু গুনাহ করেছি? আমি কি শুধুই খারাপ ইনসান? হ্যাঁ। আমি অনেক গুনাহ করেছি। পাপ করেছি অনেক। প্রচণ্ড উচ্ছৃঙখল হয়ে চরম বিলাসে গা ভাসিয়ে অনেক নষ্টামি করেছি। অনেক আওরাতকে আমি জোর করে আমার হারেমে ঢুকিয়ে দিয়েছি। অনেকদিন ধরে শুধু শরাব আর আওরাতে ডুবে থেকেছি। অনেক কাছের মানুষের সঙ্গে অনেক সময় দুর্ব্যবহার করেছি। অনেক সময় অত্যাচার করেছি অনেককে। কিন্তু আমার নানাজির মৃত্যুর সময় আমি কসম খেয়ে ছিলাম যে আমি আর কোন গুনাহ করব না। কসম খেয়েছিলাম শরাব ছোঁব না। কসম খেয়ে ছিলাম আর কখনো জোর করে কোন আওরাতকে হারেমে ঢুকিয়ে দেব না। হ্যাঁ। আমার অনেক গুনাহ ছিল। কিন্তু আমি সেসব একে একে কাটিয়ে উঠেছিলাম মসনদে বসার পর। কিন্তু মসনদে বসে আমি অনুভব করছিলাম একটা গোপন চক্রান্তের কালো ছায়া। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কারা সাজিস করছে। সেই বুঝতে না পারাটাই আমার কাল হলো। আমি সুবে বাংলার নবাব। আমি কি এই বাংলাকে ভালোবাসি নি? আমার কাছে এই বাংলার সব হিন্দু মুসলমান প্রজা ছিল সমান। আমার অনেক গুনাহ থাকতে পারে। কিন্তু আমি কখনো ধর্মের কারণে কারোর উপর অত্যাচার করিনি। আমার সবচেয়ে অনুগত সেনাপতি ছিল মোহনলাল। মোহনলাল হিন্দু। তার বোন হীরাকে ভালবেসে শাদী করেছি। কোথায় এখন হীরা? ভালবেসে যার নাম দিয়েছিলাম আলেয়া। কোথায় এখন ওর গর্ভে জন্ম নেওয়া আমার শিশুপুত্র? মোহনলাল কি এতক্ষণে পদ্মা পেরিয়ে ওকে নিরাপদ কোন জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পেরেছে? না পারলে তো মীরজাফর বা ইংরেজরা আমার সঙ্গে আমার শিশুপুত্রকেও হত্যা করবে আমাকে নির্বংশ করতে। হায় আল্লাহ! মোহনলাল তো মুসলমান নয়। কিন্তু ও তো আমার সঙ্গে বেইমানি করল না। বেইমানি করল মীরজাফর। মুসলমান হয়ে। যে মীরজাফর কোরান ছুঁয়ে শপথ করেছিল কখনো বেইমানি করবে না। বেইমানি করল রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, জগতশেঠরা। ওরা হিন্দু। তাহলে মৃত্যুর আগে আমি এটাই বুঝতে পারলাম ধর্ম নয়, ইনসানই সবার ওপরে। আমাকে নানাজী আলীবর্দী খাঁ বলেছিল সাগর পাড়ি দিয়ে আসা বেনিয়া ইংরেজরা ভয়ানক কূট। ওরা চেষ্টা করবে বিবাদ বাঁধিয়ে এই দেশটা দখল করার। বলেছিল ‘খুব হুঁশিয়ার সিরাজ’। তাই হোল শেষকালে। ইংরেজ আজ দখল করল বাংলাকে। ফলে গেল নানাজীর কথা। নানাজী আমাকে ভালবেসে আমার আগের নাম বদলে দিয়ে নতুন নাম দিয়েছিল সিরাজ। আমাকে ভয়ানক মহব্বত করত নানাজী। সেই নানাজীর একবার অবাধ্য হয়েও গুনাহ করেছি। মীরজাফর,, জগতশেঠ,রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ,রাজবল্লভ, উমিচাঁদ! তোমরা সবাই এদেশকে ইংরেজদের হাতে তুলে দিলে? এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সব প্রজা পাশাপাশি শান্তিতে থাকত। ধর্মের নামে কখনো কোনো বিভেদ আমি দেখিনি। কিন্তু আমি জীবনের এই শেষ মুহূর্তে বুঝতে পারছি ওই ইংরেজ এসেছে আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে। ওরা আজ আমাকে খতম করে হয়ত মীরজাফর বা জগৎ শেঠ বা রায়দুর্লভ বা ইয়ার লতিফকে মসনদে বসাবে। তারপর ওদের হঠিয়ে দিয়ে নিজেরা দখল করবে এই বাংলার মসনদ। তারপর সারা হিন্দুস্তান দখল করবে। ওরা শান্তিতে থাকতে দেবে না হিন্দু মুসলমান কাউকে। বিভেদ আর বিবাদ লাগিয়ে ওরা লুঠ করে চলবে এই বাংলা আর তারপর সারা হিন্দুস্তান। আমার পেয়ারী বেগম লুৎফুন্নেসা! লুৎফা! তুমি কোথায়? তোমাকে কি ওরা হত্যা করেছে? নাকি বন্দী করে রেখেছে? কোথায় আমার কন্যা উম্মে জহুরা? ওরা কি তাকেও শেষ করে দিয়েছে? ওরা কি হত্যা করেছে আমার আম্মাকে? নাকি বন্দী করেছে? হত্যা করেছে কি আমার বেগম হীরা আলেয়াকে? মোহনলাল! তুমি কি রক্ষা করতে পেরেছ আমার পুত্রকে? পালাও মোহনলাল আমার পুত্রকে নিয়ে। পালিয়ে যাও। নাহলে কোতল করবে ওকে আমার বংশ নির্মূল করতে আমাকে হত্যা করার পর। রাত কত হলো জানিনা। হয়ত ভোর হতে চলেছে। একটু পরেই হয়তো আজান শুরু হবে। হয়ত এখনই ওরা আমাকে খতম করতে আসবে। একটু পরেই হয়ত ফুৎকারে নিভে যাবে আমার জীবনের প্রদীপ। শেষ হয়ে যাবে আমার এই চব্বিশ বছরের যৌবন। আমার জীবন যেন এখন এক অন্ধকূপ। আল্লাহ! আমার জীবনের এই অন্ধকূপ থেকে আমার প্রার্থনা কি তুমি শুনবে?
জানি না মৃত্যুর পর আমার বেহেশতে ঠাঁই হবে, নাকি দোজখে। জানি না। কিন্তু আল্লাহ তুমি তো জানো আমার হাজার গুনাহ থাকলেও বিদেশী ইংরেজদের হাত থেকে এই বাংলাকে রক্ষা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা আমি করেছিলাম। মীরজাফর, জগতশেঠ, রাজবল্লভ, উমিচাঁদের মতো ওদের হাতে তুলে দিইনি এই বাংলাকে। এটা যদি পুণ্য হয়, তাহলে যেন মৃত্যুর পর আমার ঠাঁই হয় বেহেস্তে। কার পায়ের শব্দ? তাহলে কি আমার মৃত্যু আসন্ন? ওঃ মুহম্মদী বেগ? তুমি? তুমি কি হত্যা করতে এসেছ আমাকে? একসময় তুমি অপরাধ করে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলে। আমি তোমার প্রাণ ভিক্ষা দিয়েছিলাম। আজ তুমি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করতে এসেছ কাপুরুষের মতো? তোমার বিশ্বাসঘাতক প্রভুদের জানিয়ে দিও বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদদৌল্লা মরার আগে মৃত্যুকে ভয় পায়নি। আর দ্বিধা কেন মুহম্মদী বেগ? কাপুরুষ! এগিয়ে এসো কাপুরুষ! এগিয়ে এসো। আমি প্রস্তুত।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours