Fiture
কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ

তাবড় তাবড় নেতারা যা পারেন না, নুসরত তা প্রথম দিনেই পারলেন। কট্টর বিরোধী শিবিরের দুই নেত্রীর নিঃশর্ত সমর্থন আদায় করে নিলেন তাঁর সাংসদ জীবনের একেবারে সূচনা মুহূর্তেই। এঁদের প্রথমজন বিজেপি'র রাজ্যসভা সাংসদ রূপা গাঙ্গুলি। দ্বিতীয়জন বিজেপি নেতা, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অগ্নিকন্যা বলে পরিচিত সাধ্বী প্রাচী। এই দুজনেই একেবারে স্বেচ্ছায় এসে দাঁড়ালেন সংসদের নতুন অতিথি নুসরত জহাঁ রুহির পাশে। তৃণমূল সাংসদ নুসরতের হয়ে তাঁরা সওয়াল করলেন, কট্টর মুসলিম মৌলবাদী ফরমানের বিরুদ্ধে। শাসক-বিরোধী শিবির সমন্বয়ের, ভারতীয় গণতন্ত্রের এক আদর্শ ছবি দেখা গেল সংসদ ভবনে।

বলা যায় সংসদ ভবনে, নুসরত এলেন। দেখলেন। জয় করলেন। সেই সঙ্গে আরও একটি জিনিস করলেন, নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক বিরোধী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করলেন একেবারেই নিঃশব্দে। কোনরকম তর্ক-বিতর্কে না গিয়েই।

তৃণমূল কংগ্রেসের নব-নির্বাচিত দুই অভিনেত্রী বসিরহাটের নুসরত জহাঁ রুহি আর যাদবপুরের মিমি চক্রবর্তীর সাংসদ হওয়া নিয়ে অনেকেই মরাকান্না জুড়ে দিয়েছিলেন। সোশ্যাল মেডিয়ায় উপচে পড়েছিল উপহাস আর কটাক্ষ।
- 'পর্দার মানুষ ওরা, রাজনীতির বোঝেটা কী?'
সত্যিই তাই। রাজনীতির প্যাঁচ পয়জারের কিই বা বোঝেন মিমি চক্রবর্তী, নুসরত জহাঁ রুহি? তাও আবার বয়সেও তরুণী। কিন্তু এটাই হলো শাপে বর।

দিনটা ছিল জুন মাসের পঁচিশ তারিখ।
তুর্কির বদরুম শহরে নিখিল জৈনের গলায় মালা পরালেন নুসরত। বিয়ের অনুষ্ঠান সেরে, নববধু নুসরত সংসদ ভবনে পৌঁছে গেলেন সাংসদের শপথ নিতে।
বাঙালি মেয়ে সবচেয়ে সুন্দর শাড়িতেই। তাও আবার এদিন গায়ে আঁচল তুলে, আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলার এই সুন্দরী নায়িকা।
গায়ে তখনও বিয়ের গন্ধ। কপাল, সিঁথি উজ্জ্বল রক্তিম সিঁদুরে। গলায় মঙ্গলসূত্র। হাতে মেহেন্দির কারুকাজ। পরিষ্কার বাংলাভাষায় শপথ নিলেন নুসরত।

এই সময়েই সেই তাক লাগিয়ে দেওয়া ঘটনাটা ঘটিয়ে ফেললেন নুসরত। স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি উচ্চারণ করলেন 'বন্দে মাতরম'। স্বাধীনতা সংগ্রামের সেই অগ্নিমন্ত্র। নুসরত তাঁর আবির্ভাবেই মুখবন্ধ করে দিলেন, তাঁর দল তৃণমূলের কট্টর বিরোধী শিবির বিজেপি'র।
মাত্র দু'শব্দের এই কথাটি মুসলিম সম্প্রদায় কেন মুখে আনবে না, সে প্রসঙ্গে অজস্রবার প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি আর তার শাখা সংগঠনগুলি। ঘটনাটা নিয়ে হয়েছে প্রচুর রাজনৈতিক, সামাজিক জলঘোলাও।

সংবাদমাধ্যমে খবরটা ছড়াতেই আর একটুও দেরি করলেন না কট্টর মৌলবাদীরা। নুসরতের বিরুদ্ধে সেই মান্ধাতা কায়দায় ফতোয়া জারি করে বসলেন দেওবন্দের উলেমা মুফতি আসাদ ওয়াসমি। সাহরণপুরের ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের তরফে স্পষ্টাস্পষ্টি বিবৃতি দিয়ে ঘোষনা করা হলো, ইসলামের শরিয়তী শাসনের অবমাননা করেছেন নুসরত। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে 'বন্দে মাতরম' উচ্চারণ নিষিদ্ধ। এ নিয়ে অতীত, বর্তমানে প্রচুর জলঘোলার ইতিহাসটাও নেহাত কম নয়। আর ভবিষ্যতেও যে এই বিতর্ক থামবে না তার প্রমাণ পাওয়া গেল এই সেদিনও।

এখানেই থেমে থাকলেন না উলেমা। সাংসদ নুসরতকে
হুঁশিয়ারি দেওয়া হলো এক অমুসলিম পুরুষকে বিয়ে করার জন্যও। তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো, মঙ্গলসূত্র গলায় ঝোলানোও ইসলামে নিষিদ্ধ।

মৌলবাদী রক্তচোখের সামনে সটান মুখোমুখি দাঁড়াতে পারেন এই মেয়ে, তা সম্ভবত আন্দাজ করতে পারেননি কেউ। অনেক দিগগজ রাজনীতির চাণক্যরাও যে কথাটি স্পষ্ট উচ্চারণ করতে ডরান, ঠিক সেই কথাটাই বিনা দ্বিধায় জানিয়ে দিলেন এই সদ্যনির্বাচিতা সাংসদ।
"আমি ধর্মনিরপেক্ষ," সাফ বললেন নুসরত। তিনি স্পষ্ট ভাষায় মৌলবীদের নিশানা করে বললেন, "জাতীয়তাবাদের আগে ধর্মের জায়গা নয়। আমি প্রথমে একজন ভারতীয়।"

মৌলবাদীদের সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নাম লেখালেন নুসরত। আর এই লড়াই চালাতে গিয়েই পাশে পেয়ে গেলেন তৃণমূলের কট্টর বিরোধী বিজেপির রাজ্যসভা সাংসদ রূপা গাঙ্গুলিকে। ছুটে এলেন বিজেপি নেতা সাধ্বী প্রাচী। তাঁর আরেক পরিচয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদের 'ফায়ারব্র্যান্ড' কন্যা। রাজনীতির লক্ষণ রেখা ধুয়েমুছে একাকার। আর এই গোটা কান্ডটা নির্ভেজাল নায়িকার মতো একাই সামলে নিলেন নুসরত। সেই সঙ্গে মেধাবী রাজনীতিবিদের মতো আরেকটি কাজও করে ফেললেন, নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসের মৌলবাদ বিরোধী ছবিটাও সংসদে প্রতিষ্ঠা করলেন কোনও তর্ক-বিতর্কে না গিয়েই।

"সলাম ওয়ালেকুম, নমস্কার, জয় হিন্দ, বন্দে মাতরম, জয় বাংলা" বললেন নুসরত সপ্তদশ লোকসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে। শপথ শেষে পা ছুঁয়ে প্রণাম করলেন লোকসভা অধ্যক্ষ ওম বিড়লার। দেখতে না দেখতেই, আবির্ভাবে নুসরত হৃদয় জয় করে নিলেন গোটা সংসদের।



নুসরতকে রূপা, সাধ্বী প্রাচীর সমর্থন করার এই ঘটনার যতোই মানবিক মুখ থাকুক না কেন, বাস্তবে তা  নির্ভেজাল রাজনৈতিক। নুসরতকে ফতোয়া জারি করার ঘটনাকে ইস্যু করে, এক ঢিলে দুই পাখি মারার সুযোগ পেয়ে গেল বিজেপি।
প্রথমত, তৃণমূলনেত্রীর বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের অভিযোগে হামেশাই সোচ্চার বিজেপি। এবার তৃণমূলের এক সাংসদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা তুলে ধরার ফায়দা চালাবে বিজেপি সমেত গোটা সঙ্ঘ পরিবার।
দ্বিতীয়ত, আরও একবার সুবর্ণসুযোগ হাতে এলো ইসলাম মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে তোপ দাগার।

"মুসলিম মেয়ে হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে বিন্দি, সিঁদুর মঙ্গলসূত্র পরলে তা 'হারাম'(অবৈধ)। আর লভ জেহাদের নামে, মুসলিম ছেলে হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে বুরখা পরালে তা 'হারাম' হয় না?" নুসরতের হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সাধ্বী প্রাচী।
ওদিকে রূপা গাঙ্গুলি কড়া ভাষায় সাফ জানিয়ে দিলেন, নুসরতের সিঁদুর মঙ্গলসূত্র নিয়ে কটাক্ষ করা আশ্চর্যজনক।

রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যাপারটা মন্দ না। তৃণমূল, বিজেপি উভয়ের জন্যই স্বাস্থ্যকর। কিন্তু মৌলবাদী শক্তির মোকাবিলায় শাসক, বিরোধী শিবিরের এই হাত ধরাধরি করে চলাটাও তো দৃষ্টান্ত। তাকেই বা অস্বীকার করবেন কোন যুক্তিতে? কারণ নীতিগতভাবে বিজেপি হোক বা তৃণমূল, দুই শিবিরই যে কোনও মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে।

ধর্মীয় মৌলবাদ। কট্টরপন্থীদের নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে আজ তুমুল বিতর্ক। এই ইস্যুতে সব দলই প্রতিষ্ঠা করতে চায় তার মতাদর্শকে। এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে, যুযুধান প্রতিটি দলেরই দাবি সেই একমাত্র সেকুলার। অন্যরা সাম্প্রদায়িক।
আরোপ প্রত্যারোপ দূরে সরিয়ে নাহয় মেনে নেওয়া গেল প্রতিটি দলই সেকুলার। ধর্মনিরপেক্ষ। তাহলে প্রশ্ন একটাই, হাতে হাত মিলিয়ে মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে অসুবিধা কোথায়? কী বলবো একে সদিচ্ছার অভাব? নাকি সেই চির পুরাতন ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি। সংসদের ডাকসাইটে সব সাংসদরা মৌলবাদ মোকাবিলায় সমন্বয়ের কথা বলেন বটে, তবে পারেন কোথায়? কিন্তু নুসরতের মতো রাজনীতিতে একেবারেই অনভিজ্ঞ এক সাংসদ বিনা আয়াসে এই কাজটা করে দেখালেন।

মোদ্দা কথা, 'আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখাও', এই নীতিবাক্যটি কেউই মেনে চলতে রাজি না। দলীয় রাজনীতির ওপরে উঠতে প্রবল অনিচ্ছা ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের। আর নুসরতের এই ঘটনা পোড় খাওয়া সংসদের বাস্তু ঘুঘুদের চোখ খুলে দেয় কিনা এখন সেটাই দেখার।

তবে সংসদের এই ঘটনার ছায়া যেন দেখা গেল বাংলার রাজ্য বিধানসভাতেও। তবে রাজনীতির পাক্কা দাবাড়ুদের হাতে পড়ে তার মূলবার্তাটি গেল বদলে। সোমবার কংগ্রেস বিধায়ক আবদুল মান্নান প্রস্তাব আনলেন, বাংলায় ধর্মীয় রাজনীতির আগ্রাসন রুখতে সর্বদল বৈঠক জরুরি। মান্নানের এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন সিপিএমের বিধায়ক সুজন চক্রবর্তী। প্রস্তাবের পাশে দাঁড়ালেন শাসক দলের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও। তবে রাজ্য-রাজনীতিতে তিন দলের সামনা-সামনি চলে আসার মূল উদ্দেশ্য কি মৌলবাদী শক্তিকে রোখা? মনে হয় না। নেতাদের কথাতেই স্পষ্ট গোটা ঘটনার নেপথ্যে সেই চিরাচরিত বিজেপি বিরোধিতা। রাজ্যে শক্তিবৃদ্ধির ঘটনায় বিজেপিকে রোখা।

কী বলবেন এবার অরাজনৈতিক সোশ্যাল মেডিয়া অনুরাগীরা? নুসরতকে নিয়ে আরেকবার ফেসবুকে ঝড় তুলবেন নাকি আপাতত মুখে কুলুপ আঁটবেন?
কোনও রাজনৈতিক কৌশল না, হৃদয়ের আবেগও যে রাজনীতির গতিপথ পাল্টে দিতে পারে, হাতেনাতে তা করে দেখালেন বসিরহাটের সাংসদ।


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours