Fichar
ভবানীপ্রসাদ, ভট্টাচার্য্য, ফিচার রাইটার, দুর্গাপুরঃ          আজ  চিকিৎসক  দিবস, এক  যুগ  নায়ক  বিশ্ব খ্যাত  ডাক্তারের  জন্ম  এবং  তিরোধান  দিবস! কথিত  আছে,  গৌতম বুদ্ধকে  নির্বান  লাভের জন্য  এক হাজার জন্ম  অপেক্ষা  করতে  হয়েছিল! কিন্তু  জন্মদিন  ও মৃত্যুদিন  একই  দিনে হ'লে  এক জন্মেই  নির্বান  লাভ  ঘটে!  এমনই  এক  ক্ষনজন্মা  পুরুষ  ডাঃ  বিধান  চন্দ্র  রায় ,           ডাঃ  রায় শুধু  একজন  ধন্ত্বত্বরী  চিকিৎসকই  ছিলেন  না ছিলেন  দুরদর্শী  সফল  প্রশাসক  এবং  পরিকল্পক! তাঁর  চিকিৎসা  পদ্ধতি  ছিল সম্পুর্ন  ভিন্ন  ধরনের! সেই  সময়ে  রোগ  নির্নয়ের  এতো  পরীক্ষা  পদ্ধতি  ছিল না, ডাঃ  রায়  শুধুমাত্র গন্ধ  শুঁকেই  টি,বি, রোগ  নির্নয়  করবে পারতেন! তাঁর  চিকিৎসা  পদ্ধতি  সম্পর্কে  কয়েটি  ঘটনা   যা  কিংবদন্তী হয়ে  আছে,            একবার  বাঁকুড়া  জেলার  এক ব্যক্তি হঠাৎ  নার্ভের  রোগে  আক্তান্ত  হয়ে  প্রায়  শয্যাশায়ী  হয়ে পড়লে চিকিৎসার  জন্য  পরিচিত  এক ব্যক্তির  মাধ্যমে  ডাঃ  রায়ের  কাছে  চিকিৎসার  জন্য গেলে  প্রেসক্রিপশন  লিখে দিয়ে  বললেন, এই  ওষুধটা  বাঁকুড়াতেই  পেয়ে  যাবেন, তিনি  ওষুধের  দোকানে  গেলে  দোকানদার  ভিরমি খেলেন  , প্রেসকিপশনে কোন  ওষুধ লেখা  ছিলন না  শুধু  পরামর্শ  ছিল  শোওয়ার  দিক  পরিবর্তনের, লোকটি  উত্তর  দিকে   মাথা দক্ষিনে  পা  রেখে  শুতেন, বিছানা  পূর্ব- পশ্চিমে  করার  পরই  সুস্হ  হয়ে  যান, ডাঃ  রায়  পরে  বলেছিলেন, পৃথিবীর  উত্তর  মেরুর  চুম্বকীয়  আবেশ  ওই  ব্যক্তির  স্নায়ুতে  প্রভাব  ফেলছিল!           ডাঃ  রায়  সারাদিন  প্রশাসনিক  ব্যস্ততার  মাঝেও  রোগী দেখতেন! তিনি  যে  ঘরে  রোগী  দেখতেন  সেটা  হলঘরের  মতো  রোগী তাঁর  কাছে  পৌঁছানোর  আগেই  তিনি  রোগীকে  দেখে  নিতেন, একবার  বাংলাদেশ  থেকে  একজন  মাঝবয়সী  মহিলা  তাঁকে  দেখাতে  এসেছেন, মাথায়  খুব  যন্ত্রনা, চোখ  জবা  ফুলের  মতো  লাল, ঘুমাতে  পারছেন  না, অনেক  ডাক্তার  দেখিয়েও  ফল  হয়  নি, ডাঃ  রায়  দেখে  বললেন," মাথায়  খুব  যন্ত্রনা, চোখ  খুলতে  পারছেন  না....."  তারপর  জিঞ্জাসা  করলেন  কি  সিঁদুর  ব্যবহার  করেন?...সিঁদুরের  ব্রান্ড  পাল্টান..এই  সিঁদুরে  এলির্জি  আছে  আপনার          আর  একটি  ঘটনা, বাংলা  দেশের  একটি  অভিজাত  পরিবারের  সদ্য পরিনীতা  বধূ  শ্বাসকষ্টে  ভুগছেন, অনেক  ডাক্তার  দেখিয়েও  কোন  লাভ হয়নি  তাই  বাধ্য হয়ে ডাঃ  রায়ের  দ্বারস্হ, ডাঃ  রায়  বধূটির  সাথে  একান্তে  কথা  বলে, পরিবারের  লোকেদের  ডেকে  বললেন মেয়েটিকে৩ সুস্হ করতে  প্রথম এক সপ্তাহ  দিনে  দুবার  হুকো  খেতে  হবে   পরের  সপ্তাহে  দিনে  একবার এইভাবে  প্রতি সপ্তাহে  কমিয়ে  শেষে  বন্ধ  করতে  হবে! ডাঃ  রায় মেয়েটির  সাথে  কথা  বলে  জেনেছিলেন  মেয়েটি  বিয়ের  আগে  তার  দাদুর  হুঁকো  তামাক  দিয়ে  তৈরী  করার  সময়  একবার  করে  খেতো! বিয়ের  পর  হুঁকো  খাওয়া একেবারে বন্ধ  হয়ে  যাওয়ায় বিপত্তি   শুরু  হয়  শ্বাসকষ্ট ....এমনই  ছিল  ডাঃ  রায়ের  পর্যবেক্ষন  এবং  চিকিৎসা  পদ্ধতি!          ডাঃ  বিধান  রায়, একজন  প্রথিতযশা  ডাঃ  হয়েও  এত বড়  প্রশাসক  কি করে  ভাবতে  অবাক  লাগে, ডাঃ  রায়  বাংলার  মুখ্যমন্ত্রী  হলেন  কোন  সময়ে? স্বাধীনতা  লাভের  পূর্বে  ১৯৪৬  এর  দাঙ্গার  দগদগে  ঘা  তখনও  শুকায়  নি, পূর্ব  পাকিস্হান ( বর্তমান  বাংলা  দেশ) থেকে  উদ্বাস্তুর  স্রোত  হুহু  করে  আসছে  এরাজ্যে  তখন  শিল্প  হুগলী  নদীর  তীরে  চটকলগুলি  যার  বেশীরভাগ  কাঁচা মাল  আসতো   সদ্য পর দেশ  হওয়া পূর্ব  পাকিস্হান  থেকে  , তাই  কাঁচা  মালের  অভাবে  ধুঁকছে  চটকলগুলি!আর  শিল্প  আসানসোল  রাণীগঞ্জের  কয়লা খনি.   স্যার বীরেন মুখার্জীর  বার্নপুর  ,ইস্কো ইস্পাত  কারখান! ডাঃ  রায়  অনুভব  করলেন, বাংলা  সুজলা  সুফলা  হলেও  শুধু  কৃষির  উপর  নির্ভর  করে  বাংলার  অর্থনৈতিক  অগ্রগতি  অসম্ভব! তাই  তিনি  কৃষি  আর  শিল্পের  মেলবন্ধন  করে  রাজ্য  এগিয়ে  নিয়ে  যেতে  চাইলেন! প্রথমদিকে  ভারতের  প্রধান মন্ত্রী   নেহেরু  এরাজ্যে  পঞ্চবার্ষিকী  পরিকল্পনায়  ভারীশিল্পে  বিনিয়োগ  করতে  না  চাইলেও  ডাঃ  রায়ের  যুক্তির  কাছে  হার  মানেন!          ডাঃ  রায়  ছিলেন  সত্যিই  জহুরী  তিনি  শিল্পের  জন্য  দুর্গাপুরকে  নির্বাচন  করার  পক্ষে  যুক্তি  ছিল,  এখানকার  শিল্পের  উপযোগী  পরিকাঠামো ,পর্যাপ্ত  জমি ( যার  বেশীর  ভাগ  জঙ্গল),দামোদর  ও অজয় নদের জল, রেলপথ  ও সড়ক পথ ( জি,টা রোড),  অসানশোল-রানীগঞ্জের  কয়লা, পার্শ্ববর্তী  রাজ্য  বিহার ( বর্তমান  ঝাড়খন্ড) ঊড়িষ্যার  উন্নত মানের  আকরিক!           জলের  জন্য  প্রথমেই  একদা  বাংলার  দুঃখ  দামোদরকে  বেঁধে দিলেন, শিল্পের  জন্য আর  কৃষির ( সেচের) জন্য  পর্যাপ্ত  জলের  ব্যবস্হা  করলেন, বিদ্যুতের  জন্য  নির্মান  করলেন  দুর্গাপুর প্রোজেক্ট  লিঃ, অনেকেরই  অজানা  ডাক্তার  হয়েও  ডি,পি,এল, বিদ্যুৎ  কেন্দ্রের  নকশা  করেছিলেন  টা বিধান  রায়  স্বয়ং,            এরপর  ইতিহাস, শাল, মহুয়া, পলাশ  পিয়েলে ঢাকা  অরন্যভুমি  ডাঃ  বিধান  রায়ের  যাদু স্পর্শে," ভারতের  রুর " নামে   পরিগনিত  হ'লো একে একে  গড়ে  উঠলো, দুর্গাপুর  ইস্পাত  কারখানা, মিশ্র ইস্পাত  কারখানা, এম, এ, এম, সি, ফার্টিলাইজার, ও,জি,পি   , টা,টা,পি,এস, এর  মতো রাষ্ট্রায়ত্ব  কারখানা , পাশাপাশি, গ্রাফাইট, পি, সি, বি, এল, এভিবি ( এবিএল) মতো  মাঝারি  ও বহু  অনুসারী ছোট  বড়, মাঝারি  বে সরকারী  কারখানা!           একটি  বিষয়  লক্ষনীয়, দুর্গাপুরের  সমস্ত  কারখানা জি, টি, রোডের  ( বর্তমান ২ নং  জাতীয়  সড়ক) দক্ষিনে  এবং  টাউনশীপগুলি  উত্তরে  এর  দুটি  কারন,
কারখানাগুলির  জল  দামোদর  থেকে  সহজে  পাওয়া  আর  বর্জ্য  নিষ্কাষন  করা  আর  একটি  কারন  ডাঃ  রায়  দুর্গাপুরে  সরকারী  পরিবহন  দুর্গাপুর  স্টেট  ট্রান্সপোর্ট  সার্ভিস ( বর্তমানে  দক্ষিনবঙ্গ  পরিবহন  সংস্হা ) চালু করলেও  ভবিষ্যতের  কথা  ভেবে  দুর্গাপুরে  চক্ররেল  চালু  করার  পরিকল্পনা  ছিল!           আজ  ভাবলে  সত্যিই  আশ্চর্য  লাগে  ৭০/ ৭৫  বছর আগেই  ডাঃ রায়  অনুভব  করেছিলেন  কোলকাতায়  জন সংখ্যার  চাপ  কতটা  বাড়বে  তাই  তিনি  সল্টলেক  সিটি  তৈরী  শুরু  করেন  ,পাতালরেলও  তাঁরই  পরিকল্পনা!            আর  একটি  বিষয়  না  উল্লেখ  করলে  এই  লেখা  নিরর্থক  হবে! ভারতের  কয়েকটি শহরে ইতিমধ্যেই  তীব্র  জল সংকট  নিয়ে  চিন্তিত  সারা  দেশ  ডাঃ  রায়  বহু  পূর্বেই  এটা  ভেবেছিলেন! তাই  তিনি  রানীগঞ্জ - আসানশোল   থেকে  রোপ ওয়েতে  দুর্গাপুরে  কয়লা  আনতে  চেয়েছিলেন,  এবং  সেই  ডুলিতেই  দামোদরের  বালি নিয়ে  ফিরতে এতে  যেমন  কয়লা  চুরি  সম্পুর্ন  বন্ধ  হ'তো, রেলপথ  বা  সড়ক  পথে  চাপ  পড়তো  না, দামোদরের  নাব্যতা  বজায়  থাকতো  জলধারনের  ক্ষমতা  অনেক বেশী  বৃদ্ধি  পেত, রাণীগঞ্জ  আসানশোল  ধ্বস  প্রবন  হতো  না, মানুষ  আতঙ্ক  নয়  নিশ্চিন্তে  বাস  করতো!         ভারত  সরকার  এই  দীর্ঘদেহী  অকৃতদার   বহুমুখী  প্রতিভাধর  কর্মবীর  সেবাব্রতী  মানুষটিকে  " ভারত রত্ন " উপাধিতে  ভুষিত  করে  যোগ্য মানুষকেই  সন্মানিত  করেছে! আজ  আফশোষ  হয়, এই  মানুষটির  সঠিক  যোগ্য সন্মান  তখনই  দেওয়া  হ'তো  যদি  এই  কর্মবীর  পরিকল্পক  মানুষটিকে  ভারতের  প্রধানমন্ত্রীরূপে ভারতবাসী  পেত...তাহলে  হয়তো  আমরা  অন্য  এক  সমৃদ্ধ  ভারতবর্ষ  পেতাম!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours