Fiture
স্বরূপ গুপ্ত, লেখক, কোচবিহার: সে আমলে পেপার আসতো দুপুরবেলা, তাও আগের দিনের। কামরূপ এক্সপ্রেস স্টেশনে ঢুকলে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হ'ত কাগজের বান্ডিল। স্টেশনেই খোলা হ'ত সেই প্যাকেট আর তারপর হকারেরা সেটা ভাগাভাগি করে পৌঁছতেন বাড়ি বাড়ি। ট্রেন লেট করলে কোনো কোনো দিন পেপার ঢুকতে ঢুকতে বিকেল তিনটে-চারটে। কলকাতা থেকে আসা সেই পেপারের গন্ধটা ছিল আলাদা। কাড়াকাড়ি পড়তো সেই পেপার নিয়ে। আমাদের বাড়িতে আসা পেপারের দু'নম্বর পাতায় নীচে বাঁদিকে রিপ কার্বি আর অরণ্যদেব দিয়ে শুরু করে ধীরে ধীরে সব খবর খুঁটিয়ে পড়ার মজাটাই ছিল আলাদা। এভাবেই তো জেনেছিলাম উত্তমকুমারের চলে যাওয়া কিংবা শচীন তেন্ডুলকর নামের এক কিশোরের রেকর্ড করা ব্যাটিঙের কথা। পুজো সংখ্যা নিয়ে উন্মাদনাটা আরও বেশি ছিল। তখন পুজো সংখ্যা বলতে বুঝতাম 'আনন্দবাজার পত্রিকা', 'দেশ', 'আনন্দলোক' আর 'আনন্দমেলা'। 'নবকল্লোল', 'উল্টোরথ' বা 'প্রসাদ'-এর কথা জানতাম না তা নয়। কিন্তু ওগুলি যেন কেমন একটু বড়দের বলে ধারণা ছিল। তুলনায় 'আনন্দলোক' বাদে বাকি তিনটে একেবারেই পারিবারিক। সত্যি বলতে বাবা পুজোর খরচের হিসেব করতে বসলে টাকা বরাদ্দ হ'ত এই পুজোবার্ষিকীগুলির জন্য। আর আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতাম কবে আসবে পুজো সংখ্যা। মহালয়াতে প্রকাশিত হত বেশির ভাগ পুজোসংখ্যা। আর আমাদের এখানে সেসব এসে পৌঁছতো আরও দু'তিন দিন বাদে।
পুজোসংখ্যার টাটকা গন্ধ ছাপিয়ে যেতো পুজোর জন্য কেনা নতুন জামাকাপড়ের গন্ধকেও। শিক্ষয়িত্রী মা পুজোর ছুটিতে দুপুরবেলায় মজে থাকতেন 'দেশ' নিয়ে। বাবার হাতে 'আনন্দবাজার পত্রিকা'। একদিন হাতবদল হত তা, বাবা 'দেশ' নিয়ে, মা 'আনন্দবাজার পত্রিকা'তে। আমরা ভাইবোনেরা কাড়াকাড়ি করতাম 'আনন্দমেলা'র জন্য। প্রোফেসর শঙ্কুর অনেক কাহিনী আনন্দমেলাতেই পড়া। আর কমিকসগুলো ঝটপট পড়ে ফেলা হত সবার আগে। খানিক বড় হলে 'দেশ' যখন আয়ত্ত্বে এলো তখন পড়ে ফেললাম রমাপদ চৌধুরী, কালকূট, শীর্ষেন্দু, সমরেশ-সহ কতজনকে! মনে আছে 'ফুলবউ' পড়ে খুব কেঁদেছিলাম। আজ এই এতো প্রকাশনার, লিটল ম্যাগাজিনের, সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্তের দিনে পুজোসংখ্যার সেই উন্মাদনা কি কোথাও কি নষ্ট হয়ে গেছে? এতো প্রকাশ, এতো অনুষ্ঠান, এতো গোষ্ঠী, এতো লেখক ইত্যাদি দেখে মাঝেমাঝে প্রশ্ন জাগে যে, এতো যে লেখা হচ্ছে তার পাঠক আছে তো? নাকি প্রকাশিত লেখা ও ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করাটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে? গোষ্ঠীবদ্ধ কিছু লোক নিজস্ব গোষ্ঠীর মধ্যে থাকা বাকিদের পিঠ চাপড়াচ্ছেন, পরিবর্তে তারাও একইভাবে আদৃত হচ্ছেন। এক গোষ্ঠী আর এক গোষ্ঠীকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। অপছন্দের লোকেরা অবশ্যই আমন্ত্রিতদের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছেন। চলছে এক অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। পুজো সংখ্যায় যে যা খুশী ছাপছেন, যেন ছাপাটাই সবকিছু, মান-টান নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলে আর কি। লিটল ম্যাগাজিনের জগতে এই ব্যাপারটা বেশি করে চোখে পড়ছে। প্রতিষ্ঠিত মিডিয়া হাউসের অনুষ্ঠান করে পুজোবার্ষিকী প্রকাশের দরকার হয় না একথা ঠিক। কিন্তু মোটামুটি পরিচিত লেখক-লেখিকারাও যখন পুজোবার্ষিকীর ছবি-সহ সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিতে শুরু করেন 'অমুক পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখাটি পড়ুন বন্ধুরা' তখন কেন যেন প্রশ্ন জাগে তবে কি পুজোবার্ষিকীগুলি আগের সেই মর্যাদা হারিয়েছে? পাঠক কি পড়ছেন না আর আগের মতো? একথা ঠিক অনলাইন শুরু হওয়ায় প্রিন্ট মিডিয়াকে আজকে কড়া চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে। যদি একটি ক্লিক বা টাচে সব পাওয়া যায় তবে কবে বই বেরোবে, কবে আসবে, কবে পাবো ইত্যাদির ভরসায় থাকবার প্রয়োজন নেই কোনো। সমাজের অবস্থাও পাল্টেছে সেদিনের তুলনায়। এটাই স্বাভাবিক। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি পুজোবার্ষিকী পড়বার সেই খিদেটা আজকের প্রজন্মের না থাকে, তবে দোষ দেওয়া যায় না তাদের। কেননা পরিবর্তনকে মানতেই হয়। কিন্তু আদৌ কি তাই? বোধহয় না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের কোনো ছাত্র বা কোচবিহারের কোনো গ্রামে থাকা কিশোরীকে যখন দেখি নিজে থেকেই হাতখরচের টাকা জমিয়ে পুজোসংখ্যা কিনছে তখন মনে হয় পুজোবার্ষিকী আজও তার আবেদন হারায় নি। আজকাল মহালয়ার বহু আগে প্রকাশিত হয়ে যায় পুজোবার্ষিকীগুলি। বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে যায় অনেক আগে থেকে। সেই টানটান দিন গোণার সময়টাও নেই আজকের ব্যস্ত জীবনে। কিন্তু রয়েছে ব্যস্ততার ফাঁকেও স্টলে গিয়ে খোঁজ নেওয়া প্রিয় পুজোবার্ষিকীর জন্য। রয়েছে সকাল সকাল উঠে পড়া হকারকে ধরবার তাগিদ, কেননা তাকে বলে রাখতে হবে ওই পুজোবার্ষিকীটি দেওয়ার জন্য। একবার শেষ হয়ে গেলে পরেরবারে কবে পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। আছে জানালা দিয়ে কোনো দোকানে ঝুলতে থাকা প্রিয় পুজোবার্ষিকীটিকে দেখে চলন্ত বাসকে থামিয়ে নেমে টুক করে নেমে পড়াটাও। এখনো চলে কোন পুজোবার্ষিকীতে কে লিখছেন তার খোঁজ এবং পড়া শেষে পাড়ার চায়ের দোকানে লেখা ও লেখক জোর আড্ডা। নষ্ট হয়ে যায় নি প্রিয় পুজোবার্ষিকীতে পড়ে ফেলা উপন্যাসটি কবে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হবে তার অপেক্ষা করা।
আর সে জায়গায় বোধহয় আট থেকে আশি সবাই এক। আমার নিজের ক্ষেত্রে বলতে পারি হকারের হাত ধরে পুজোসংখ্যা পৌঁছোনো মাত্রই অথর্ব হয়ে যাওয়া বাবা ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে পড়তে শুরু করেন হর্ষ দত্তকে, অশীতিপর মা শ্রীজাতর কবিতায় পুজোর ছুটির দুপুর খোঁজেন আর আমি এঘর-সেঘর খুঁজে পাই পুজোসংখ্যার দখল নেওয়ার জন্য হুটোপুটি করা সেই দুপুর। পুজোবার্ষিকীর সেই আঘ্রাণ আজ অম্লান।




Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours