Fichar
মোনালিসা মুখোপাধায়, ফিচার রাইটার হুগলিঃ                                    খড়খড়ি থেকে বাঙালির ঘষা কাচ। "মেরে সামনেওয়ালি খিড়কি মে এক চাঁদ সা টুকরা রহতি হ্যায়!" মনে আছে তো পড়োশন সিনেমার সেই গান? তবে সে ছিল খোলা জানলা। আর সেই জানলা দিয়েই নায়ক আর তার স্যাঙাতদের যতো 'তাকঝাক', উঁকিঝুকি। উল্টোদিকের বাড়ির চাঁদবদনি দর্শন। এই উঁকিঝুকি মারার ব্যাপারটাই অন্য মাত্রা পেয়ে যায় যদি সেই জানলায় থাকে খড়খড়ি। হাটখোলা জানলা না। জানলা আঁটা। কিন্তু সেই বন্ধ জানলা ভেদ করেই আপনি কখন ঠিক কতটুকু দেখতে চান, তা নির্ভর করছে আপনার ওপর। মর্জিমাফিক ঠিক যতটুকু চাই ততটুকুই খড়খড়ি ওঠান বা নামান।  দারুণ রোমান্টিক। অনেকটা যেন সজ্ঞানে দিবাস্বপ্ন দর্শন। আরেকটু উদার হলে 'ভায়া' বিদুর অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কুরুক্ষেত্র দর্শন বলতেই বা আপত্তি কোথায়?  মোট কথা, আপনি ঘরবন্দি। তবু ওই চার দেওয়ালের মধ্যে বদ্ধ থেকেই, জানলার খড়খড়ি টেনে আপনার বিশ্বদর্শন। ঠিক যেরকমটা করতো রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিতের চারুলতার নায়িকা। চারুলতা। কোনও এক দুপুরের অলস বেলা। সময়ও যেন থমকে দাঁড়িয়ে। ঘরবন্দি চঞ্চলা চারু। ঘরের নিস্তব্ধতায় মন হু-হু করে ওঠে। গুটিগুটি পায়ে চারু এগিয়ে যায় জানলার দিকে। খড়খড়ি তুলে বাইরে রাস্তার দিকে তাকায়। এক ভদ্রলোক চলেছেন। মাথাঢাকা কালো ছাতায়। বেশ মজা পেয়ে যায় চারু। ছুট্টে বাইনোকুলারটা নিয়ে আসে। আরও নিখুঁত ভাবে দেখতে হবে তো!  বাইরের দুনিয়ার ব্যস্ততা খড়খড়ির ফাঁক বেয়ে ছুঁয়ে যায় চারুর দারুণ অনুভূতিশীল মনকে। মনের জ্বালা বড় জ্বালা। চারুর জ্বালা জুড়ায় খড়খড়ির  স্নিগ্ধ আলো, বাতাসে। ঠিক ওই মুহূর্তে প্রাণ সঞ্চার হয় খড়খড়ির জানলায়। চারুর নিবিড় মনের একমাত্র সঙ্গী। খড়খড়ি তখন নিজেই যেন এক অনুভূতিশীল, জ্বলজ্যান্ত চরিত্র। খড়খড়ির জানলা দিয়েই ঘরের চার দেওয়ালের সঙ্গে বহির্বিশ্বের যোগাযোগ। তবে ঠিক কতটা যোগাযোগ আপনার পছন্দ, তা ঠিক করার সুযোগও দিতো খড়খড়ি। যতটা যোগাযোগ রাখবেন, ঠিক ততটাই খড়খড়ি ওঠান। বাকীটুকু থাক নামানোই। এভাবেই জল, আলো, বাতাস নিয়ন্ত্রণের গোটাটাই আপনার হাতের মুঠোয়। বং রেনেসাঁর প্রতীক খড়খড়ির জানলা। তা সে উত্তর হোক কী দক্ষিণ কলকাতা। পুরনো উঁচু বাড়ি মানেই পেল্লাই সাইজের ঘর আর মানানসই ঢাউস খড়খড়ি লাগানো জানলা। জানলার রং সবুজ। ইকো-ফ্রেন্ডলির জন্য নাকি? আর ছিল টকটকে লাল চকচকে মেজে। গোটা কনসেপশনটাই অবশ্য ধার করা মাল, সাহেব প্রভুদের থেকে। যে সময়ের কথা বলছি তখন জানলা মানেই খড়খড়ি। ওটাই তখনকার ট্রেন্ড। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী পার্ক ম্যানশন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইডেন হিন্দু হোস্টেল এরকম আরও অজস্র নিদর্শন আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে মহানগরে।    সেগুন কাঠের বিশাল  খড়খড়িওয়ালা জানলা। ফ্রেমের মধ্যে সলিড প্যানেল না। আড়াআড়ি ভাবে বসানো টুকরো টুকরো কাঠ। আবার সেই সব কাঠ ওঠানো নামানোর সোজা সরল ব্যবস্থাও ছিল। খড়খড়ি তুললেই ঘর ভরতো স্নিগ্ধ আলোয়। খড়খড়ি নামালেই অন্ধকার। ঠিক যতটুকু গঙ্গার বাতাস খেতে চান, খড়খড়ি ঠিক ততটুকুই খাওয়াতো। বিশাল মোটা দেওয়াল। জানালার পাশে দিব্য বসে সময় কাটানো যেত। আর আনমনে খড়খড়ি একবার তোলা, আবার নামানো। উদাসী নিঃসঙ্গ মনের নির্দোষ খেলা। আবার উল্টোদিকের বাড়ির খেন্তিপিসি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কী করছে গোপনে তাও দেখে নেওয়া যেতো। জানলা বন্ধ। কিন্তু খড়খড়ি তুললেই ওপাশে খেন্তিপিসির সংসার। তবে সবচেয়ে রোমান্টিক ব্যাপার ছিল খড়খড়ি ফাঁক করে অঝোর বৃষ্টি দেখা। বৃষ্টির ছাঁট ঢুকে পড়তো খড়খড়ির ফাঁক গলে। ঢুকে পড়তো বছরের প্রথম বৃষ্টিধারায় স্নাত শুকনো মাটির সোঁদা গন্ধ। কেমন যেন মনমাতাল এক অনুভূতি। খড়খড়ি ফাঁক করে, কবে যেন উঁকি মেরে কাকে দেখেছিলাম। আনচান করে উঠেছিল মনটা। হিসেবী মন তা বেমালুম হজম করে ফেলেছে।
সেই কবেই আধুনিকতার খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছি। তবু কোনও এক গোধুলিবেলায় যখন দূরের কোনও এক বাড়ি থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসে, সে মুহূর্তে ভীষন পুরাতনপন্থী হয়ে যায় অবুঝ মন। ভারী হয় চোখের পাতা। কতকিছু পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছি। কি জানি, আজও সে প্রাচীন দালানের চিলেকোঠায় আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে কিনা? শহর থেকে ধীরে ধীরে চুপিসাড়ে হারিয়ে গেছে সেই সব বাড়ি। হারিয়ে গেছে ঢাউস খড়খড়িওয়ালা জানলা।  এখন সেখানে বহুতল। শহুরে বাঙালির ঠিকানা এখন 'নিজের বাড়ি' না, 'নিজের ফ্ল্যাট'। ঘরের মাপ কমেছে, কমেছে জানলার মাপ।  এখন ইস্পাত যুগ। পাইকারি হারে অরণ্য নিধনের খেসারত দিতে, কাঠের দরজা জানলা মোটামুটি ভাবে ঠাই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। সেই সঙ্গে স্মৃতির খাতায় জমা পড়েছে খড়খড়ি। এখন স্টিল ফ্রেমে ফাইভার বা কাঁচের প্যানেল।  বৃষ্টি দেখা যায় বন্ধ কাচের জানলার ওপারে। ঢোকে না মাটির সোঁদা গন্ধ। আর মাটিই বা কোথায়? আজ তো বাস কংক্রিট জঙ্গলে। ইট-সিমেন্ট-বালি-ইস্পাতের সঙ্গে সহবাস করতে করতে, অনুভূতিগুলোও কেমন শক্ত কঠিন, পাষন্ডমার্কা হয়ে গিয়েছে। আবেগও ইস্পাত কঠিন। তাও মাথাচাড়া দেয় যথেষ্ট হিসেব কষে। সেই কবে নীরদ সি চৌধুরী বলেছিলেন, আত্মবিস্মৃত বাঙালি। সত্যিই, নিজের ঐতিহ্য রক্ষায় কোনদিনই তেমন প্রাণের টান ছিলো না বাঙালির। আধুনিকা আমি। তবু পথ চলতে হঠাতই নজর কাড়ে বট অশ্বত্থে ঘেরা প্রাচীন এক বাড়ির ধ্বংসস্তূপ।
ঈষৎ ফাঁক করা বিশাল লোহার গেট। মনে হয় কোনও এক সুদূর অতীত থেকে এখনই উঠে আসবে মৃণাল সেনের সেই চরিত্র। সব দেখেশুনে বলবে- "খন্ডহর বতাতি হ্যায় কী ইমারতে বুলন্দ থি!" কেমন যেন এক অপার্থিব টান অনুভব করলাম হাড় জিরজিরে ওই বাড়িটার ওপর। নিজেকে মনে হলো জাতিস্মর। অকৃপণ পূর্ণিমার চাঁদের আলো তখন সযত্নে ধুইয়ে দিচ্ছে ভগ্নপ্রায় ঐতিহ্যের মলিনতা। গা ছমছমে এক তরল অনুভূতি ছুটে চলেছে আমার শিরা-উপশিরায়। অপেক্ষা করতে লাগলাম সেই আগন্তুকের জন্য। একদিন যাকে দেখতে পেয়েছিলাম খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে। কান পাতলাম শহরের রাস্তায়। সন্ধের মৌনতা খানখান করে এগিয়ে এলো ঘোড়ার টগবগ। আলতো হাতে বাড়ির গেট ফাঁক করে ঢুকে গেল সেই অশ্বারোহী। মনে পড়ে গেল ওয়ালটার ডি লা মেরি'র দ্য লিজেনার্স কবিতার সেই লাইনগুলি। আমি জানি এবার ওই বন্ধ দরজার কড়া নেড়ে অশ্বারোহী বলবে- "টেল দেম আই কেইম!"


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours