Temple
রুমকি রায় দত্ত, লেখিকা, হুগলি: বিপুলবাবু (পরিবর্তিত নাম) কামাখ্যা মন্দিরের বাইরে এক নির্জন কোণে সবে মাত্র বসেছেন।এবার একটু শান্তির আরাধনায় চোখটা বন্ধ করবেন। পরনে সদ্য কেনা লাল বস্ত্র। বেশ কিছু সময় পর চোখ খুলে দেখলেন, চারপাশে বেশ কিছু কয়েন আর টাকা ছড়ানো রয়েছে। কি? কেন? ভাবার আগেই গুছিয়ে তুলে নিলেন ছড়ানো টাকা-পয়সা। আর কেউ না জানুক,তিনি নিজে বেশ ভালো করেই জানেন এই টাকাই তাঁর শান্তি হরণ করেছে। পরপর দু’দিন বসে টাকা উপার্জনের এই সহজ উপায়টা তিনি এত সুন্দর আয়ত্ত করলেন যে, মাস তিনেকের মধ্যে সম্পত্তি বস্তায় ভরে ফিরে এলেন বাড়িতে।

সেই বাড়ি, যে বাড়িটা দেনার দায়ে বন্দক রয়েছে। শুধু কি বাড়ি? দোকান,জমি যা কিছু স্থাবর সম্পত্তি কোনোটাই বন্দক দিতে বাকি রাখেননি। অতএব তাঁর কামাখ্যা যাত্রা যে পাওনাদারদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা মাত্র, একথা আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ফিরে আসার পর বিপুলবাবু স্বয়ং একথা জানিয়েছিলেন। যদিও তিনি এখন পরলোকবাসী। এখন প্রশ্ন হল বিপুলবাবু কি করেছেন সেটা তাঁর ব্যাপার,এতে আপনার বা আমার কী? সত্যিই কি আমাদের কিছু না? নাকি যা কিছু সব আমাদেরই? আমার, আপনার আমাদের সমাজের সকলের। ধর্ম আমাদের গ্রাস করেছে,নাকি আমরাই স্বেচ্ছায় পান করেছি ধর্মকে! এপ্রশ্নের মূল খুঁজতে গেলে অনেক বাক্‌বিতণ্ডার সৃষ্টি হতে পারে, তাই সেদিকে না হেঁটে বরং আরেকটি গল্প বলি। হয়তো উত্তর সেখান থেকেই খুঁজে পাওয়া যাবে! দিন তিনেক আগে ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ট্রেনে বাড়ি ফিরছি। বর্ধমান-হাওড়া মেইনলাইন। আমার গন্তব্য সিমলাগড়। নিমো আসতেই এক মাঝবয়সী মহিলা একটি বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। বাচ্চাটির মাথার ও দৈহিক গঠন ও আচরণগত কিছু বৈশিষ্ট্য বাচ্চাটির প্রতি আমাদের সকল যাত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। উঠেই বাচ্চাটি একটি পরিণত মানুষের মতো বসার জায়গা দখলের জন্য ছুটে এসে আমার পাশটিতে বসে পড়ল। একটা অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে বাচ্চাটির মধ্যে। খাবার জন্য ছটফট করছে। আমার সামনের মহিলা পেয়ারা কিনে দিলেন। সেটা সবে দু’কামড় দিতেই এক লজেন্সওায়ালা যেই এল, সে বায়না করতেই আমি লজেন্স কিনে দিলাম। ক্রমাগত দেখলাম যা আসছে সব তার চাই। পেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, শরীরের তুলনায় সেটার আয়তন অনেক বেশি এবং এতক্ষণে আমরা বুঝে গিয়েছি বাচ্চাটি কথা বলতে পারে না। ঠাকুমা আক্ষেপ করে জানালেন,বাচ্ছাটির বাবা-মা ডাক্তার দেখালে হয়তো ঠিক হত! দেখায় না কেন জানতে চাওয়াতে ঠাকুমা জানালেন, - ‘ বাবা ট্রেনে হকারি করে আর মা,মাঠে খাটে, পুরোনো কাপড়ের ব্যবসা করে, তাদের সময় নেই’। একটা অজানা অসহায়তায় মনটা মোচড় দিয়ে উঠল। ‘গ্রাহম বেল সেন্টার ফর ডেফ্‌’ তো শুধুমাত্র হুগলি জেলায় এমন বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে। ভাবতে লাগলাম বর্ধমান জেলায় এমন কোনো সংস্থা আছে কিনা। না, মনে পড়ল না এমন কোনো নাম। হয়তো আছে! আমার জানা নেই। যখন চোখের সামনে এমন অসহায় শিশুদের দেখি ভীষণ অসহায় লাগে, মনে হয় আমার কি কিছুই করার নেই? কি করা যায় ভাবতে ভাবতেই বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে দেখলাম কাগজ সমেত লজেন্সটি মুখে ঢুকিয়ে খাচ্ছে। ঠাকমা জল দিতেই চোঁ চোঁ করে খেয়ে ফেলল জল। তারপর এক থাপ্পড় দিল ঠাকুমাকে। দিয়েই খিলখিল করে হাসতে লাগল। ওর হাসি দেখে আমরাও হেসে উঠলাম। ওর ঠাকমা হাসতে হাসতে আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললেন— ‘একদম বদমাস আছে। বাড়িতেও সবাই ওকে খাবার কিনে দেয় পাড়ার লোকজন। আসলে কি জানোতো, ও বান্দর আছে। ও হনুমানের অংশে জন্মেছে’। আমি মহিলার দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই তিনি আরও যত্ন নিয়ে আমাকে বিশ্বাস করাতে উঠে পড়ে লাগলেন যে, বাচ্চাটি আসলে হনুমানের অবতার। আমার মুখে অবিশ্বাস দেখে বাচ্চাটির হাত ধরে টেনে আমাকে ওর গায়ের শক্তি পরখ করে দেখতে বলল। পিছিয়ে এলাম আমি। ওর ঠাকুমার চোখ-মুখে যে ভক্তিভাব লক্ষ করলাম, তাতে আমি আশঙ্কিত ঐ বাচ্চার একটা কল্পিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। স্পষ্ট বুঝতে পারছি বচ্চাটি শুধু বোবা নয়, ওর শারীরের সাথে মানসিক সমস্যাও আছে। বাচ্চাটির এই অস্বাভাবিকতা এক শ্রেণীর মানুষের কাছে তাকে ধীরে ধীরে অবতার করে তুলছে। যে বয়স একটা বাচ্চা আগামীর উজ্জ্বল স্বপ্ন চোখে আঁকতে আঁকতে বেড়ে ওঠে, এই বাচ্চাটি কী সেই স্বপ্ন ভরে নিতে পারবে তার চোখে! সংশয় আছে অনেক।
এই রকম একটা নিম্নবিত্ত আর্থ-সামাজিক পরিবেশে এই ধরণের শিশুকে সুস্থ জীবন দিতে যে লড়াই প্রয়োজন, তা ঐ বাচ্চার বাবা-মা’র পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না। তবে বাচ্চাটিকে অসুস্থ না ভেবে ঈশ্বর প্রতিপন্ন করার এই অদম্য প্রচেষ্টা কি শুধু ধর্মীয় ভাবনা থেকেই উৎপত্তি! আবার সেই একই প্রশ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে হয়। ধর্ম কি মানুষকে গ্রাস করেছে? না মানুষ প্রয়োজনে ধর্মকে ঢাল করেছে! হয়তো দুটোই সত্যি অথবা নয়। তবে একটা আশঙ্কা থেকেই গেল বড় হয়ে কোনো একদিন হয়তো এই ছোট্ট বাচ্চাটি বিপুলবাবুর মতো উপার্জনের সহজ উপায়টিও শিখে নেবে!


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours