পার্থ বসু লেখক, হাওড়াঃ
গত শতাব্দীর চারের দশকে একটি লোকগীতিএইচ এম ভির ডিস্কে বাজারে আসে। এক পিঠে আব্বাস সাহেব। বাংলা লোকগানের সম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমেদ। আর একপিঠেহেমলতা ঘোষ। আমার মা। মায়ের কথা পরে সবিস্তারে বলা যাবে। আজ গানের কথায় আসি।
দেশভাগের পর আব্বাস সাহেব পাকিস্তানে গেলেন। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ হয় নি। আমি নির্মলেন্দু চৌধুরীকে মনে রেখেই বলছি। নাগরিক রুচির সাথে তাল মেলাতে তিনি লোকগীতির যে বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন তা ক্ষমার অযোগ্য। তিনি লোকগীতিরনগরায়ন করেছিলেন। ফলত লোকগীতির বাজার তৈরি হয়। বাজার থেকে লাভ তুলতে ভেজাল দিতেও তাঁর বাঁধে নি। আমি চরিত্র হননের চেষ্টা করছি না। অকপট ভাবে কিছু সত্যি কথা শোনাতে চাইছি কেবল।
শিরোনামে এই যে দেখছেন-- নাক ড্যাংরার-- এটি আমার মায়ের গাওয়া গানটির শুরুর লাইন। গানটি অমর পালের কণ্ঠেরিমেক শুনেছেন অনেকেই। বিশদে যাওয়ার আগে গানের আরও কয়েকটি লাইন স্মৃতি থেকে বলছি, পড়ে নিন বরং
নাকড্যাংরার ব্যাটাটা , চোখড্যাংরার নাতিটা
মোর মন ভুলাইলি সতের খাড়ু দিয়া।
তহনে না কছিস তুই রে
তোর দো মহলা তিন মহলা
দালান বাড়ির নেকাই জোকাই নাই।
আর বাড়ি আইস্যাদেখনুমুই
চাতুরালি করলি তুই---
গল্পটা নিশ্চয় ধরতে পারছেন। এতো পরিষ্কার এক বিশ্বাসভঙ্গের গল্প। গাঁয়ের মেয়েটিকে লোভ দেখিয়ে বিয়ে করেছে এক ভিনদেশী , ভিনগাঁয়ের লোক। বিয়েতে শাঁখাও জোটে নি। কিন্তু ফলাও করে শুনিয়েছিল নিজ গাঁয়ে তার বৈভবের কথা ,
তার দালান কোঠার কথা , হাল চার পাঁচ গরু ছয় সাত আর অগুনতি সেউটি গরু মানে বাছুরের কথা। বাস্তবে সে প্রতারিত হয়েছে।
মা-কে জানতে চেয়েছিলামনাকড্ যাংরা কথাটি কি গালি ? ুরালি টের পেলে সেটাই তো স্বাভাবিক। মা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন- ড্যাংরা কথাটির উৎসডাঙ্গর তথা ডাগর। মেয়েটি দোষ দেবে কাকে ? সেও তো রূপে মজেছিল। তবে গ্রামের মেয়ে তো। স্বামীকে সরাসরি সুন্দর বলতে বাধছে। নাকড্যাংরা মানে নাক যার ডাগর এমন লোকের ব্যাটা যে তার নাক সুন্দর তাকি বলার অপেক্ষা রাখে ? তেমনি চোখড্যাংরার নাতি , ডাগর যার চোখ এমন লোকের নাতি – কিছু বলতে বাকি রইল ? তার ভালবাসার মানুষকে সে আক্ষেপের সঙ্গে বলছে বটে তহনে না কছিস তুই-- তখন কি তুই বলিস নি-- এইসব, কিন্তু সে কিছু ঝগড়া করছে না, ঝাঁটা হাতেও মারতে যাচ্ছে না। গানে তার স্বগত বিলাপ।
কোলকাতার এক ক্যয়ার গানটির নৃত্যরূপ দিতে গিয়ে ঠিক ওই কলহদৃশ্যদেখিয়েছিলেন মঞ্চে। তিক্ত মুখে ড্যাংরা বলে গালি দিতে দিতেতেড়ে যাচ্ছে মেয়েটি , জোড় হাতে পিছু হটছে প্রতারক।
প্রশ্ন উঠবে নির্মলেন্দু এখানে কোথায় ? বলছি। বলছি ।
নির্মলেন্দুর নিজের গাওয়া একটি গানের কথা শুনুন। কলেজ ফেস্টেগাইছেন। বাজছে বঙ্গো, ড্রাম--। আগে গানের কথাগুলি শুনে নেওয়া যাক
আবু নওদাড়িটা মরিয়া
মোর সে হইছন হানি
আন্ধার ঘরতবইসন আবু
পড়ন চোখের পানি
আবু , টপ্পাস কি টাপ্পুস করিয়া।
আশ পড়শী নাইয়র যায়
দোকুলবান্ধিয়া
মোর নওদাড়ি থাকিল আবু
লাল শাড়িটা পিন্ডিল হায়
পাছত গিলা ছলালাত কি
ছলালাত করিয়া---
এই গানে আবু মানে দিদিমা বা দাদীমার কাছে নওদাড়ি মানে নতুন বৌ মরে যাওয়ার দুঃখ উজাড় করে দিচ্ছে বাঙালী মুসলমান এক চাষি। আঁধার ঘরে বসে তার চোখের জল বয়ে যাচ্ছে। কিভাবে ? টপ্পাস কি টাপ্পুস করিয়া। লাল শাড়ি পরে যে বধুরা দোকুল মানে জোট বেঁধে নাইয়র মানে পিতৃগৃহে চলেছে। বউটা থাকলে সঙ্গে যেত। চাষির কল্পনায় সে পিন্ডিল মানে পরেছে লাল রঙের শাড়ি। চলার ছন্দে নতুন শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে যে শব্দটি তা ছলালাত কি ছলালাত। বর্ণনায় আরও আছে। বর্ষাকালে চাষিসুখনিদ্রায়। বগলেতে বসিল বৌ, মাছ কাটছে। কি রকম ?-- ঘ্যাঁচাত কি ঘ্যাঁচোত করিয়া।
এই গানটির মানেও মা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। দুঃখের গান। শোকের গান। চমকে গিয়েছিলাম ধ্যণ্বাত্মক শব্দে শোক এত নিবিড় করে বলা যায় ! শেষ স্তবকে চাষিগাইছে – আবু নওদাড়িটা মরিয়া মোর সে হইছেদুখ / নদীর জাঙ্গালের মত ভাইঙ্গা পড়ে বুক আমার-- কি ভাবে ? – হাড়ারাম কি হিড়িরিম করিয়া ! কলেজ ফেস্টে , আমিও ছিলাম শ্রোতা , নির্মলেন্দু স্টেজে এই গানটি গমকে ঠমকে গাইতে শুরু করলেন। নাচতে শুরু করল ছেলেরা। এ তো প্রায় ক্রিমিনাল অফেন্স !
করিমগঞ্জে কবি দিলীপকান্তি লস্করের বাড়ি স্বনামধন্য খালেদ চৌধুরীর সাথে আলাপ হয়েছিল। তিনিও কোলকাতা খাবে না এই ভয়ে সোহাগ চাঁদ বদনি--র দুটি লাইন পালটে দিয়েছিলেন নির্মলেন্দু এই অভিযোগ করেছিলেন। ওই যে--নাচেন ভাল সুন্দরী বাঁধেন ভাল চুল / হেলিয়াদুলিয়া নচে নাগকেশরের ফুল-- এই দুই ছত্রে আপত্তি তুলেছিলেন খালেদভাই। নাগকেশরের ফুল হেলেদুলে নাচবে কি করে ? আসল গানে ছিল জালি সন্ধির বেত। আগের লাইনেও চুল নয় অন্য একটি শব্দ ছিল। মনে আসছে না।
কোলকাতা যখন অখণ্ড বাংলার রাজধানী ছিল তখন আঙুরবালারকণ্ঠে ' হরি হে তুমার বাঁশের বাঁশি ', কিংবা ' কে দিল তুমার গলে-- ' সোনামুখ করে শুনেছে। তোমার নয় তুমার এই উচ্চারণে সে আঁতকে উঠত না। বাংলাভাষার বিভিন্ন ডায়ালেক্টে কান তার অভ্যস্ত ছিল। এখন পুবের হাওয়া রুখে দিয়ে তার গায়ে বইছে পশ্চিমের হাওয়া। একই সঙ্গে আঞ্চলিক আর অফিসিয়াল হিন্দির অনৈতিক দাপট। কোলকাতা এখন বাংলাভাষার নিরিখে একটি দূষিত কুয়া যার জল অপেয় , আর কুয়োর ব্যাঙরা সমস্ত স্বাস্থ্যবিধিকে না মেনেই কোনক্রমে জিন্দা থাকার চেষ্টায় রত।
মজার কথা হল কোলকাতার যে প্রমিত বাংলা তা তো আসলে নদীয়াশান্তিপুরেরলব্জ। ঈশ্বর গুপ্ত বা হুতোমের নক্সায় যে ভাষায় কোলকাতা মুখর থাকত তা এখন অতীত। মান্য বা প্রমিত বাংলা নিয়ে উন্নাসিকতার কোন জায়গা নেই এটুকুই প্রাসঙ্গিক ভাবে বলার। কোলকাতা না শুনুক , গ্রাম ঢুকে আছে মজ্জায় যার সে তো শুনবে ? না, কলকাতাই বা বাদ যাবে কেন ?কোলকাতাও শুনুক।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours