কাজল ভট্টাচার্য, সিনিওর জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ রাজনীতি বরাবরই রঙিন।
ক্রিকেট বিশ্বকাপ 2019 এ টিম ইন্ডিয়ার জার্সির রং বদলের খবর চাউর হতেই, রং নিয়ে রাজনৈতিক খেয়োখেয়ির ছবিটা যেন ভীষণভাবে প্রকট হয়ে উঠলো।
কোনও দলের রং সবুজ। কারও বা নীল, কারও লাল। কোনও দল বেশ পুরনো। কেউ বা আবার কৈশোরে। কম বয়সে অতিরিক্ত পাকা দলের সংখ্যাও ভারতীয় রাজনীতিতে নেহাত মন্দ নয়। বিশেষ করে আঞ্চলিক দলগুলির বোলবালা বাড়ার পর। এরই মধ্যে একেবারে হইহই করে ঢুকে পড়লো গেরুয়া।
"রং দে মুঝে তু গেরুয়া," বাজারে পড়তে না পড়তেই সুপার-ডুপার হিট।
"মোদি সরকারের কলকাঠি নাড়াতেই ওই গান এমন হিট।" ভাগ্যিস, এমন কোনও কথা ওঠেনি। কারণ খেলার মাঠেও গেরুয়াতঙ্ক পেয়ে বসেছে কংগ্রেসকে।
"একরোজ সব লাল হো জায়েগা।"
মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের সেই ঐতিহাসিক বাণী। আমাদের রাজ্য একসময় লালে লাল হয়েছিল। বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসতেই। তবে আসমানি নীলের কাছে পরাজিত হয়ে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিতে হয়। এরপর বামপন্থী লালদুর্গের গায়ে চাপলো আসমানি নীল। মা-মাটি-মানুষ সরকার বাংলার নীলায়নকে উৎসাহ দিতে ফরমান জারি করলেন- বাড়ির রং আসমানি নীল করলেই করে বিশেষ ছাড়। এরই মধ্যে নয়া সংযোজন, উত্তরপ্রদেশের সরকারি সম্পত্তির গৈরিকীকরণ। মসনদে যোগী আদিত্যনাথ বসতেই রাজ্যের রংবদল।
তাহলে কি রংয়ের ঘাড়ে চেপেই ক্ষমতা জাহির? হতে পারে। ঘটনার ইঙ্গিত সেরকমই। তবে একটা ব্যাপার স্পষ্ট, ক্ষমতা বদলের সঙ্গে রং বদলায়। রংয়ের ওপর অদ্ভুত মোহ ভারতীয় গণতন্ত্রের রাজনৈতিক অভিভাবকদের।
কি বলি একে, রাজনীতির রংবাজি?
ক্ষমতা বদল হয়েছে ভারতীয় রাজনীতির ভরকেন্দ্র দিল্লিতে। দেশের মোট দশটি রাজ্যে বিজেপি'র সরকার। দুটিতে বিজেপিজোট সরকার। যেখানে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ। আরও পাঁচটি রাজ্যে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও তার সমর্থনে চলছে সরকার। বিরোধীদের মতে, গৈরিক আগ্রাসন।
ঠিক এরকম অবস্থায় টিম ইন্ডিয়ার গায়েও চাপতে চলেছে গেরুয়া জার্সি। স্বাভাবিক ভাবেই সিঁদুরে মেঘ দেখেই জোর আপত্তি কংগ্রেস শিবিরের। গলা মিলিয়েছে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদীরাও। টিম ইন্ডিয়ার গায়ে গৈরিক জার্সি চাপানো চলবে না।
কেন? গৈরিক জার্সি চাপালে টিম ইন্ডিয়া কি টিম মোদি হয়ে যাবে? ভয়টা সেরকমই।
ইতিমধ্যেই জার্সির রংবদল নিয়ে তুমুলকান্ড হয়ে গেল মহারাষ্ট্র বিধানসভায়। কিন্তু বাস্তবে মহারাষ্ট্রের আবেগ জড়িয়ে আছে গেরুয়ার সঙ্গে। ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের নিশানও ছিল গৈরিক। রাজ্যের আঞ্চলিক দল শিবসেনার দলীয় পতাকাও গৈরিক।
আসলে সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই গৈরিকাতঙ্ক আরও ব্যাপক ভাবে চেপে বসেছে বিজেপি বিরোধী শিবিরের ওপর। সন্দেহ সন্দেহ আর সন্দেহ। সন্দেহ সর্বত্র। কংগ্রেস, সমাজবাদীদের অভিযোগ, এবার টিম ইন্ডিয়ার গৈরিকীকরণের চক্রান্ত করছে মোদি সরকার। বিসিসিআই-এর ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। যার ফলে বদলে যেতে চলেছে ভারতীয় ক্রিকেট দলের জার্সির রং।
30 জুন ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম শহরে বসছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ 2019 এর জমজমাট আসর। ওই দিন মুখোমুখী হবে ইংল্যান্ড, ভারত। কিন্তু গোল বাঁধে প্রতিযোগী দুই দলের জার্সির রং নিয়ে। দুই দলের জার্সির রংই মূলত নীল। তাই আইসিসি'র নির্দেশ, জার্সির রং বদলাতে হবে টিম ইন্ডিয়ার। আয়োজক দেশ হিসেবে ইংল্যান্ড তাদের পছন্দের হাল্কা নীল রংয়ের জার্সি পড়েই মাঠে নামার সুযোগ পাবে।
ওই নির্দেশ পাওয়ার পরেই বিসিসিআই গৈরিক জার্সি বেছে নেয়। এখানেই রাজনৈতিক বিতর্কের সূত্রপাত। গৈরিক কেন? অন্য রং কেন নয়? বিজেপি বিরোধী শিবিরের অভিযোগ, রাজনৈতিক প্রভাব শিরোধার্য করেই বিসিসিআই টিম ইন্ডিয়ার জন্য গেরুয়া জার্সি বেছে নিয়েছে। তবে বিরোধী শিবিরের প্রশ্নেরও জবাব আছে। অতীতে টি-20 ম্যাচে টিম ইন্ডিয়ার জার্সিতে গেরুয়া রং চোখে পড়তো। তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই নতুন এই জার্সির ডিজাইন করা হয়েছে।
টিম ইন্ডিয়ার জার্সির রং বদলের ঘটনায় স্পষ্ট, রাজনৈতিক বিরোধিতার সংক্রমণ ক্রিকেট মাঠেও। আসলে লোকসভা ভোটে বিজেপির দুরন্ত সাফল্য চোখের ঘুম কেড়ে নিয়েছে বিরোধীদের। গৈরিক দেখলেই এখন তাঁরা আরএসএস-এর ছায়া দেখেন। কারণ এই সংগঠনের পতাকাও গৈরিক। ওদিকে দেশের বর্তমান রাজনীতিতেও গৈরিক শিবির ক্ষমতার সমীকরণে সেরা। দেশের যে প্রদেশ থেকে অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রী এসেছেন, সেই উত্তরপ্রদেশে এখন যোগীরাজ। মুখ্যমন্ত্রী নিজেও গৈরিকধারী। তাঁর রাজ্যের সরকারি ইমারত, বাস, রাস্তার ডিভাইডার, টোল প্লাজা সবই গেরুয়া।
তবে গেরুয়ার এক অন্য, একেবারেই স্বতন্ত্র আবেদন আছে এই উপ-মহাদেশে। এই রং জড়িয়ে আছে ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে। তাই সনাতনপন্থীদের এক দুর্বলতা আছে গেরুয়ার ওপর। তবে এই আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে কোনমতেই হিন্দুত্ববাদকে গুলিয়ে ফেলাটা হবে চরম অনৈতিক। আর ঠিক এই চেষ্টাটাই করে চলেছেন রাজনীতির কারবারীরা। তবে গৈরিক আবেগের ফায়দা তুলে বিজেপিও যে দলের কলেবর বাড়িয়ে ফেলতে চাইছে না, এমনটাও নয়।
বৌদ্ধ আর শিখ ধর্মীয় চেতনার সঙ্গেও জড়িয়ে আছে গৈরিক। হিন্দুসন্ন্যাসীর মতোই বৌদ্ধভিক্ষুদের পরিধেয়ও গৈরিক। আবার শিখদের ধর্মীয় নিশান সাহিবের রংও গেরুয়া।
গেরুয়াই কেন? এরও ব্যাখ্যা আছে সনাতন ধর্মে। আগুনের রং গেরুয়া। এই আগুনই মানবসভ্যতার প্রথম ধাপ। অন্ধকার দূর করে আনে আলো। মনের কালিমা ঘুচিয়ে, দেয় জ্ঞান। আবার সাম্যের জয়গান গায় এই অগ্নি। রাজা প্রজা, গরীব ধনী- আগুনের কোপে পড়লে সবার একই বিচার। পুড়ে ছারখার। এই আগুনরঙা আলখাল্লা গায়ে চাপিয়েই বাউলরা মনের আনন্দে গেয়ে বেড়ান। তাঁরা তো আবার নিজেরাই এক স্বতন্ত্র সম্প্রদায়।
গৈরিক আবার প্রতীক ত্যাগ, তিতিক্ষারও। তাই আমাদের তেরঙা জাতীয় পতাকার একটি রং গৈরিক। গৈরিকের ওপর দুর্বলতা মানেই হিন্দুত্ববাদ, এমনটা বলা কোনভাবেই যুক্তিসিদ্ধ নয়। বরং বলা যায়, ভারতের সুপ্রাচীন আধ্যাত্মবাদ, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে গৈরিক।
রাজনীতির দাবা খেলছেন খেলুন। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, রাজনীতি করতে গিয়ে যেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের আবেগে আঘাত করে বসবেন না।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours