রণজিৎ গুহ , লেখক ও
সমাজকর্মী, দুর্গাপুরঃ
সাম্প্রতিক সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা সংকট আপাত ভাবে মিটে যাওয়ায় অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। সংকট সুরাহায় জুনিয়র চিকিৎসকরা ও মূখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে রাজ্য সরকার উভয় তরফকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন সাধারণের অধিকাংশ। সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে কেউ আশান্বিত কেউ সন্দিহান। সময়ে বোঝা যাবে সেসব।আন্দোলনের সাফল্য বা ব্যার্থতা সবসময় কতটা দাবী পূরন হল তা দিয়ে বিচার করা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে কোনও ঐকান্তিক আন্দোলনই ব্যার্থ হয় না।কিছু না কিছু সুফল দিয়েই যায় যা কিনা পরে কাজে লাগে। ডাক্তারবাবুদের এই আন্দোলন আরও অনেক গুলো বিষয় আলোচনায় নিয়ে এসেছে। বিষয়গুলো একে অন্যের সাথে যুক্তও আবার আলাদা ভাবেও আলোচনা যোগ্য।
সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রচার আন্দোলনের কথা বাদ দিলে গত কয়েকমাসে রাজ্যে যেকটা নজর কাড়া আন্দোলন হয়েছে তার কোনটাই রাজনৈতিক দল সংগঠিত নয়। সে শিক্ষক পদপ্রার্থীদের হোক বা হবু চিকিৎসকদের।আবার এই আন্দোলন পেশাদারদের নিজস্ব সংগঠন এর সমর্থন পাওয়ার আগেই সাধারণ মানুষের জোরালো সমর্থন পেয়ে যায়।কারণ গুণ্ডাগর্দি বা দলগত হামলা মানুষ কখনও পছন্দ করেনা।পক্ষপাত দুষ্ট হয়ে পুলিশের অতি সক্রিয়তা বা নিস্ক্রিয়তাও আম জনতা পছন্দ করেনা।নিজেরা সাহস করে বলতে পারেনা।কিন্তু অন্য কয়েকজন এব্যাপারে প্রতিবাদ করলে খুব ঝুঁকি না থাকলে পাশে এসে দাঁড়ায়।
এই চিকিৎসকদের আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলি বেশ বেকুব হয়েছে।বিজেপি ডাক্তারবাবুদের ওপর হামলাকে সাম্প্রদায়িক চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করেও হালে পানি পায়নি।মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবীও জনমানস আমল দেয়নি।কংগ্রেস সরকারে না থাকলে এধরণের আন্দোলনে কোনদিনই মাথা গলায় না।সামাল দেওয়ার ঢং কায়দাও জানেনা।এও হয় তাও হয় বলে বিবৃতি দিয়ে দায় সারে।তৃণমূল কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনের পর অনেকটা হীনবল।তৃণমূল কংগ্রেসের ডাক্তার নেতৃত্বকে আন্দোলন কারীরা প্রথম থেকেই কাছে ঘেঁষতে দেয়নি।তবে খুব গুরুত্বপূর্ণ যে এই প্রথমবার তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীরা ঠারেঠোরে হলেও নেত্রীর অনমনীয়তার সমালোচনা করেছেন। সিপিএমের বড়মাথারা ইদানীং খুবই নিস্তেজ। মেজ সেজরা আন্দোলনে উঁকিঝুঁকি দিয়েছেন।তেমন কল্কে পাননি। সোস্যাল মিডিয়ায় কিছু সমর্থক আন্দোলনটাকে সমস্যা সমাধানের বদলে মমতা বিরোধিতায় নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তাতে সুবিধা কিছু হয়নি।বামফ্রন্ট আমলে যখন রামনারায়ণ গোস্বামী স্বাস্থ্যমন্ত্রী তিনি ডাক্তারবাবুদের আন্দোলন কি ভাবে সামলেছিলেন জনসাধারণতো ভুলে যায়নি। কাজেই দালাল মুর্খ ইত্যাদি বলে ঝাল মিটিয়েছেন বড় জোর।
অতিবামরা খুব চেষ্টা করেছিলেন সংকট প্রলম্বিত করতে।সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক উদ্বেগ উৎকন্ঠাকে পাত্তা না দিয়ে সরকারের সাথে আলোচনার শর্তগুলো ঘোরালো করার চেষ্টা চালিয়েছে।যুক্তিবাদের পয়গম্বর সেজে অবিশ্বাস ও সন্দেহের আবহাওয়া তৈরীতে অতিবামদের চেষ্টা ফলপ্রসু হয়নি।এই আন্দোলনে হবু চিকিৎসকরা রাজনৈতিক দলের মাতব্বরি বুদ্ধিমত্তার সাথে এড়াতে পেরেছেন।
রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনও সংস্থা কিংবা ব্যাক্তি মানুষ সকলেই চায় সংবাদ মাধ্যম তার নির্দেশনায় চলুক।আমার কথা বলুক।আমার মত করে বলুক।আমার ভাবনায় পরিচালিত হোক।অন্য ভাবনা অন্যমত প্রচার করা মানেই বিকৃত বা বিক্রিত খবর।সংবাদ মাধ্যম বিরোধিতায় সব পক্ষের এক রা।অথচ স্বচ্ছতার দাবীতে, স্পষ্টতার প্রয়োজনে সংবাদমাধ্যমেরই শরণাপন্ন হতে হয়।
রুগী মৃত্যু কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে যাতে হাসপাতালে হামলা না হয় সে ব্যাপারে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা কতদুর কি এগোচ্ছে সকলেরই নজরে থাকবে।কিন্তু এই আন্দোলনের ফলেই স্বাস্থ্য পরিষেবার মৌলিক সমস্যাগুলি আবারও জোরালোভাবে উঠে এসেছে।
চিকিৎসক, বিশেষজ্ঞ, সমাজকর্মী, সাধারণ মানুষ সকলেই সমস্যার গোড়া ধরে সমাধানে আগ্রহী।কেউ কেউ চান স্বাস্থ্য পরিষেবা পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসুক।বাস্তব পরিস্থিতিতে তা কতটা সম্ভব তা নিয়ে যথেষ্টই অনিশ্চয়তা আছে। অন্য বিকল্প সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যাবস্থার সুপরিকল্পিত পরিকাঠামো উন্নয়ন। এব্যাপারে সরকারের সীমাবদ্ধতা সবাই জানে।কিন্তু সদিচ্ছা কতটুকু তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
এই আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে নানা মতামত সাপেক্ষে আরেকটা জরুরি বিষয় উঠে এসেছে। চিকিৎসক-রুগী সম্পর্ক। বেসরকারি হাসপাতালের বিপুল চিকিৎসা ব্যয় ও সরকারি ব্যাবস্থার অপ্রতুলতা এবং অব্যাবস্থার কারণে শেষমেশ ডাক্তারবাবুদের ওপরে রুগী পরিবারের বিরুপতা বৃদ্ধি পায়।এব্যাপারে সরকারকে যথাযথ ব্যাবস্থা নিতে হবে।খুব আন্তরিক সামাজিক আন্দোলনও এব্যাপারে কার্যকরী ভুমিকা নিতে পারে।
লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল এরাজ্যে গনতান্ত্রিক শক্তিকে সামান্য হলেও শ্বাস ফেলার অবসর দিয়েছে। হবু চিকিৎসকদের এই আন্দোলন প্রতিবাদের কণ্ঠস্বরকে অনেক শক্তিশালী করবে।সরকারকে নমনীয় করতে সাহায্য করবে।
Post A Comment:
0 comments so far,add yours