করা উচিতও না। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া মুখ্যমন্ত্রীর। তখন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের একত্রিশ প্রতিনিধি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের একেবারে শেষ লগ্ন। সোমবার বিকেল। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা।
নবান্ন থেকে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময়ের বৈঠক সেরে, যেন যুদ্ধজয়ের আনন্দে বেরিয়ে এলেন আন্দোলনকারী ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা। তাঁরা জানালেন, ডাক্তারকে পেটানো যায় না। এই বৈঠকের পর, মানুষের কাছে এই বার্তা গেছে।
কিন্তু যাঁরা সেদিন টিভির পর্দায় চোখ রেখে গোটা ঘটনার সাক্ষী ছিলেন তাঁরা জানেন, সেদিন নবান্নে আদৌ কোনও যুদ্ধই হয়নি। গত সাতদিন আন্দোলন সমর্থনকারীদের সমর্থনে যাঁরা টগবগ করে উত্তেজনার আনন্দে ফুটছিলেন, তাঁদের উত্তেজনায় প্রথমেই জল ঢেলে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা। দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনের সুর বাঁধা হয়ে গিয়েছিল আবেদন-নিবেদন আর প্রশংসার সুরে।
সমাজের অচিকিৎসক সম্প্রদায়, যাঁরা শর্তহীন ভাবে গত সাত দিন আন্দোলনকে সমর্থন করে চলেছিলেন, তাঁদের অনেকেই অবাক হয়েছিলেন। তাঁরা আশা করেছিলেন, খোদ মুখ্যমন্ত্রীকে সামনে পেয়ে প্রতিনিধিরা জোরালো প্রতিবাদ করবেন তাঁদের 'বহিরাগত' বলার জন্য। বারবার প্রেসের সামনে বিবৃতি দিয়ে জানানো, তাঁদের একরাশ ক্ষোভের প্রতিফলন দেখা যাবে বৈঠকে। প্রতিনিধিরা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবেন লাগাতার সাতদিন রাজ্যের সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধে সরকারের ভূমিকার প্রতিবাদে। ঠিক যেমনটা করেছিলেন তানিয়া ভরদ্বাজ। প্রেসিডেন্সি কলেজের পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্রী।
দিনটা ছিল সম্ভবত, 2012 সালের 18মে।
টাউন হলে এক প্রখ্যাত টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে, ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখী হয়েছিলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুষ্ঠানে রাজ্যের আইন ব্যবস্থার অবনতি, মহিলাদের ওপর বেড়ে চলা অপরাধের কারণ জানতে চেয়েছিলেন তানিয়া। ছাত্রীর ক্ষুরধার প্রশ্ন শুনেই রেগে আগুন হয়ে অনুষ্ঠান মঞ্চ ছেড়ে চলে গেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। যাওয়ার আগে তানিয়াকে চিহ্নিত করে গেছিলেন, মাওবাদী, সিপিএমের কাডার হিসেবে। পুলিশকে প্রকাশ্যেই নির্দেশ দিয়েছিলেন তানিয়ার অতীত নিয়ে তদন্ত করতে। সম্ভবত সেকথা মনে রেখেই মেধাবী জুনিয়র ডাক্তাররা কোনও ঝুঁকি নিতে চাননি। সরাসরি কোনও অপ্রিয় প্রশ্নের উত্তর চাননি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
'মধুরেন সমাপয়েত' হল দীর্ঘ প্রতিক্ষিত বৈঠকের। মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে আপ্যায়িত করা হলো আন্দোলনের প্রতিনিধিদের। আন্দোলনের ভরকেন্দ্র এনআরএস চত্বরে বসে গোটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। এরপরেই উচ্ছ্বাসে ভেসে গেল এনআরএস চত্বর। উৎসবের মেজাজ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ফারাক। আর তাতেই আমূল পাল্টে গেল ছবিটা।
'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'-এর দাবিতে গত এক সপ্তাহ রীতিমত বাজারগরম করে দিয়েছিলেন বাংলার আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তাররা। মুখ্যমন্ত্রীর বলা 'বহিরাগত' শব্দের বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। দাবি তুলেছিলেন, এনআরএসে সশরীরে হাজির হতে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে। তাঁদের 'বহিরাগত' বলার জন্য দুঃখপ্রকাশ নয়, চাইতে হবে ক্ষমা। কিন্তু সোমবার বিকেলে নবান্নের বৈঠকে কার্যত অপ্রিয় প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন আন্দোলনকারীরা। বরং সান্ত্বনা পুরস্কার পেয়েই খুশি তাঁরা। নবান্ন থেকে এনআরএসে ফিরে আন্দোলনকারীরা জানালেন এখন আর তাঁরা 'বহিরাগত' না। তাঁরা 'লক্ষ্মীছেলে'। দিদি বলে দিয়েছেন।
'উই ওয়ান্ট জাস্টিস'-এর শ্লোগান বদলে হয়ে গেল 'লক্ষ্মী ছেলে'।
কথা রাখলেন মুখ্যমন্ত্রীও। আন্দোলনকারীদের আবদারে বৈঠক সেরেই তিনি ছুটলেন চিকিৎসাধীন প্রহৃত জুনিয়র ডাক্তার পরিবহকে দেখতে।
এদিনের বৈঠকে আন্দোলনকারীদের কথাতে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় তাঁদের ক্ষোভটা কোথায়, আদৌ বোঝা গেল না। বরং বিভিন্ন প্রসঙ্গে প্রতিনিরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলি নিয়ে। ওদিকে মুখ্যমন্ত্রীও মনোযোগ দিয়ে প্রতিনিধিদের কথা শুনেছেন। জানতে চেয়েছেন, কিভাবে প্রকল্পগুলিকে আরও নিবিড় জনমুখী করে তোলা যায়। রাজ্যের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা আধুনিক করে তোলার ব্যাপারেও প্রতিনিধিদের পরামর্শ শোনেন তিনি।
কথা প্রসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও আন্দোলনকারী ডাক্তারদের প্রতিনিধিদের বুঝিয়ে দেন যে রাজ্যের যাবতীয় সরকারি হাসপাতালগুলির বাস্তব অবস্থা তাঁর হাতের তালুর মতোই চেনাজানা। প্রতিনিধিদের সামনেই মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় বলেন, "সব ব্যাপারে সরকারকে দোষারোপ করা ঠিক না। অনেক হাসপাতালেই চিকিৎসার জন্য জরুরি বেশকিছু দামী সাজ-সরঞ্জাম পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে।"
"তোমরাই আমার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হওনি,' কোনও রাখঢাক না করেই প্রতিনিধিদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন,"ঘটনার পরেই আমি ফোন করে কথা বলতে চেয়েছিলাম।"
এরপরেই তিনি জানান, এনআরএস কান্ডের গোটা ঘটনার দিকে তিনি কিভাবে অতন্দ্র প্রহরীর নজর রেখে চলেছিলেন। অনবরত খবর নেওয়া হচ্ছিল জখম জুনিয়র ডাক্তার পরিবহর। চিকিৎসার যাবতীয় খরচ-খরচার দায় রাজ্য সরকারের বলে আশ্বস্ত করেন মুখ্যমন্ত্রী।
আগামিদিনে যাতে ডাক্তার পেটানোর ঘটনা পুনরাবৃত্তি না হয়, সে ব্যাপারেও বেশকিছু জরুরি পদক্ষেপের পরিকল্পনার কথা জানানো হয় প্রতিনিধিদের। পাশাপাশি প্রতিনিধিদের সতর্ক করে জানানো হয়, বেশকিছু মহল থেকে এনআরএসকান্ডকে কেন্দ্র করে ডাক্তার-সরকারের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির চেষ্টা চলছিল। আন্দোলনের ঘটনায় ডাক্তারদের বিরুদ্ধে সরকার কোনও আইনি পদক্ষেপ করবে না বলে জানানো হয়। মুখ্যমন্ত্রীর মুখে "তোমরা তো আমাদের ভবিষ্যত" শুনে যারপরনাই স্বস্তির শ্বাস নেন প্রতিনিধিরা।
যাঁরা গত সাতদিন বাইরে থেকে ডাক্তারদের কর্মবিরতিকে সমর্থন করে, মুখ্যমন্ত্রীর কড়া বিরোধিতা করে চলেছিলেন, এবার কী বলবেন তাঁরা? সোশ্যাল মেডিয়ায় ঝড় তুলেছিলেন রাজ্য প্রশাসনের অবস্থানে। বরং বৈঠকে সরকার পক্ষের কথায় স্পষ্ট হলো, আন্দোলনকারীদের বারো দফা দাবি পেশের আগেই হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়ে গেছিল।
ঘটনায় স্পষ্ট, সরকারের বিরুদ্ধে কিছু ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে সাতদিনের কর্মবিরতি চালিয়ে গেলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এনআরএসকান্ডের পরদিন থেকেই মুখ্যমন্ত্রী ধর্মঘটি ডাক্তারদের বারেবারে আশ্বস্ত করছিলেন তাঁদের দাবিদাওয়া সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করা হবে বলে।
মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে কর্ণপাত না করে এনআরএস চত্বরে বসে ঠান্ডা মাথায় কেন খেলে চলেছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা? মধ্যে-মধ্যেই জিবি মিটিং আর একের পর আরেক বিবৃতি। অনড় মনোভাব। সব মিলিয়ে বেশ একটা কুরুক্ষেত্রের প্রস্তুতি। সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন কিছু সিনিয়র চিকিৎসক, তাঁদের একাধিক সংগঠন। রাজ্য-রাজনীতির সীমানা ছাড়িয়ে আন্দোলনের আঁচ দেশ ছড়িয়ে পড়েছিল আন্তর্জাতিক স্তরেও।
দিনের পর দিন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে ক্রমেই খেপে উঠছিলেন রাজ্যবাসী। ধর্মঘটি ডাক্তারদের ওপর ক্ষোভ দানা বাঁধছিল অসহায় সাধারণ মানুষের মনে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে আন্দোলনকারীরা একবার সাড়া দিতেই ছবিটা পাল্টে গেল। আন্দোলনকারীরা আলোচনার টেবিলে বসতেই সরকারও সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিল।
তাহলে শুধু জেদের বশে ডাক্তাররা লাগাতার সাতদিন রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবা অচল করে রাখলেন কোন যুক্তিতে?
রাজ্যবাসীর এই ভোগান্তি, বেশকিছু অকালমৃত্যুর দায় নিতে কি রাজি হবেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা?
Post A Comment:
0 comments so far,add yours