NRS hospital

কাজল ভট্টাচার্য, সিনিয়র জার্নালিস্ট, কলকাতাঃ

"আপনার রুগীর অবনতির জন্য দায়ী কিন্তু প্রশাসন, আমরা নই।" ধর্নায় সাফাই জুনিয়র ডাক্তারদের।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পাওয়া খবরে, চিকিৎসার অভাবে এক নবজাত সমেত মারা গিয়েছেন কমপক্ষে আরও দুজন রোগী।
এই তিন মৃত্যুর দায় কে নেবে? জেহাদি জুনিয়র ডাক্তারদের কথা মতো, এই দায় প্রশাসনের। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে কি প্রশাসন চিকিৎসা চালায়? তাহলে, ওই জুনিয়র ডাক্তাররা হাসপাতালের কোন কাজে লাগেন?

অন্য আরেক প্ল্যাকার্টে জুনিয়র ডাক্তারদের বক্তব্য- প্রশাসনকে আমাদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। একদম সঙ্গত দাবি।
কিন্তু এই দাবি আদায়ের জন্য রুগীদের চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ রাখা শুধু অমানবিক না অপরাধ। সোমবার রাতে এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে ডাক্তার পিটিয়ে মারমুখী পেশেন্ট পার্টি যে মারাত্মক অপরাধ করেছে, চিকিৎসকদের এই কর্মবিরতির একরোখা জেদ তারচেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধ।
মাত্র এক পেশেন্ট পার্টির অপরাধে জুনিয়র ডাক্তাররা তাঁদের একতরফা সিদ্ধান্তে কাঠগড়ায় তুলে ফেলেছেন আপামর রাজ্যবাসীকে।
দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ঘটনায় নিঃশর্ত সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের সিনিয়র চিকিৎসকরাও। ব্যতিক্রমিরাও আছেন। হাতেগোনা কিছু সিনিয়র ডাক্তার, অধ্যক্ষরা এই একতরফা কর্মবিরতির মধ্যেও সাধ্যমতো রুগী পরিষেবা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর এই কাজ করতে গিয়েও যে তাঁরা বাধার মুখে পড়েছেন এর নজির আছে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে।

ঘটনায় রাজনীতির রং লেগেছিল গোড়াতেই। জুনিয়র ডাক্তারদের সমর্থনে বিজেপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইস্তফা দাবি করে। রাজনীতির সেই রংকেই বৃহস্পতিবার আরও গাঢ় করে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। গন্ডগোলের নেপথ্যে সিপিএম, বিজেপি, জাতপাত এবং 'বহিরাগত'র গন্ধ পেয়েছেন তিনি। মারমুখী মেজাজে চিকিৎসকদের আন্দোলন মোকাবিলা করতে গিয়ে তিনি ধর্মঘটি জুনিয়র ডাক্তারদের হস্টেল খালি করে দিতে বলেন।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘটনাস্থল এনআরএসে না গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী এসএসকেএমে বসে থাকলেন। আর সেখান থেকেই সময়সীমা বেঁধে, ধর্মঘটি চিকিৎসকদের কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এমনকি নির্দেশ অমান্য করলে এসমা'র মতো কড়া আইনের হুঁশিয়ারিও দেন। এরপরেই কার্যত আগুনে ঘৃতাহুতি হয়।
সরকারের নীরবতায় অসন্তুষ্ট জুনিয়র ডাক্তাররা মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাকে তুঘলকি বলে মন্তব্য করেন। ঘটনার পাল্টা চালে কর্মবিরতিতে অনড় জুনিয়র ডাক্তাররাও স্পষ্টাস্পষ্টি জানিয়ে দেন- মাননীয়া আপনার চ্যালেঞ্জ আমরা স্বীকার করলাম। ওদিকে চিকিৎসকদের আন্দোলনকে আরও তীব্র করে তুলতে পাশে দাঁড়ানোর ঘোষনা করে চিকিৎসকদের বেশকিছু অন্যান্য সংগঠন।

সব মিলিয়ে সরকার, আন্দোলনকারী ডাক্তারের টানাপোড়েনে রোগীর চিকিৎসা উপেক্ষিতই থাকল। দুপক্ষের ভূমিকায় একটা ঘটনা স্পষ্ট, রোগীর প্রাণ বাঁচানোর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা জাহিরের খোলা প্রদর্শন।

এরই মধ্যে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর করে তুলতে বেশকিছু চিকিৎসক গণ-ইস্তফার পথে হাঁটেন। ডাক্তারদের এই আন্দোলনে সামিল হতে গেল নার্সদেরও। শুধু মুখ্যমন্ত্রীই না রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠিরও কাজে ফেরার ডাকে কর্ণপাত করলেন না ডাক্তাররা।

কিন্তু যাঁদের কেন্দ্র করে এত ঝামেলা, সেই পেশেন্ট পার্টিরা কি হাসপাতালে মারামারি করতেই আসেন? নাকি তাঁদের অসুস্থ প্রিয়জনদের জীবনদানের আশাতেই আসেন। শরণাপন্ন হন চিকিৎসকদের।
তবু কেন বারেবারে চিকিৎসক পেশেন্ট পার্টির মধ্যে কুরুক্ষেত্র বাঁধে?

শত চিকিৎসা সত্ত্বেও, চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যু হতেই পারে। কিন্তু বারেবারে অভিযোগ ওঠে চিকিৎসায় গাফিলতির। প্রতিটি রোগীর মৃত্যুই চিকিৎসকের গাফিলতিতে, কোনও উন্মাদও এমন কথা বলে না। বাস্তবে, চিকিৎসকের ওপর আর ভরসা রাখতে পারছেন না পেশেন্ট পার্টি। আর এ যে কোনও বিক্ষিপ্ত ঘটনা না, তা আমি আপনি সবাই জানি।

বরং পেশেন্ট পার্টিরা সমীহ করেই চলেন চিকিৎসকদের। ধরেই নিলাম তা সৌজন্যবোধে না স্বার্থের তাগিদে। আবার ভয়েও হতে পারে। কারণ পেশেন্ট পার্টি জানেন, চিকিৎসকের ওপরেই নির্ভর করে তাঁদের ঘনিষ্ঠজনের মরণ-বাঁচন।
তারপরেও পেশেন্ট পার্টিরা মারমুখী হন কেন? তাঁরা কি এতটাই আহাম্মক!

কারণগুলিও সবাই জানেন।
চিকিৎসক, পেশেন্ট পার্টি, পাবলিক সবাই। তবে ঘটনার এক আর্থিক সামাজিক প্রেক্ষাপটও আছে। চিকিৎসা মানেই আজ শাঁখের করাত। সরকারি হাসপাতালে খরচ-খরচার চাপ নেই। কিন্তু উপচে পড়া রোগীর ভিড় সামলে, চিকিৎসা পরিষেবার নাজেহাল অবস্থা। তিতিবিরক্ত রোগীর পরিবার, অসহায় চিকিৎসকরাও।

ওদিকে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা বহু ক্ষেত্রে আজ মধ্যবিত্ত কেন, উচ্চ মধ্যবিত্তেরও সাধ্যাতীত। একদিকে যখন চিকিৎসার খরচ সামলাতে চোখে অন্ধকার দেখছেন পেশেন্ট পার্টি, ঠিক তখনই ঢালাও আয়ের সুবাদে নেহাত মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা চিকিৎসকরা নাম লেখাচ্ছেন এলিট ক্লাসে। আর রোগীর টাকাতেই যে চিকিৎসকদের ফুলে ফেঁপে ওঠা, সমৃদ্ধি, তা অস্বীকার করার উপায় আছে কি?

আজ বাংলার অনেক মানুষই সুচিকিৎসার আশায় দক্ষিণমুখী। কিন্তু কেন? তাকি ভেবে দেখেছেন রাজ্যের চিকিৎসক বা স্বাস্থ্য ভবনের কর্তারা?

রাজ্যের সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবায় অসহায় পেশেন্ট পার্টি রোগীর মনমতো চিকিৎসা করাতে না পারার ক্ষোভ বহু পুরনো। এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ দেখা গেছে অসংখ্যবার। সিস্টেমের বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা নেই সাধারণের। তাই সফট টার্গেট হন চিকিৎসক। ওদিকে একই ভাবে চিকিৎসকদেরও সফট টার্গেট হন রোগীরা।
চিকিৎসক, রোগী, পেশেন্ট পার্টির সম্পর্কের এই তিক্ততা তৈরির দায় কার? সমস্যার বল একে অন্যের কোর্টে না ঠেলে, দরকার ছিল গোটা স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ পর্যালোচনা। তারপরেই কড়া প্রশাসনিক পদক্ষেপ করা। এ ব্যাপারে অতীতে খাপছাড়া সাময়িক কিছু সক্রিয়তা দেখা গেলেও, সমস্যার স্থায়ী সমাধানে কেউ কোনও আগ্রহ দেখায়নি।

এনআরএস কান্ডে চিকিৎসক, সমাজের তথাকথিত অভিজাত, এবং সাধারণ মানুষের অনেকেই চোখ বন্ধ করে বিক্ষুব্ধ চিকিৎসকদের পাশেই দাঁড়ালেন। বারেবারে দাবি উঠল দোষী পেশেন্ট পার্টির শাস্তির, আর চিকিৎসকদের নিরাপত্তার।
এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ করে চিকিৎসকরা কাণ্ডজ্ঞানহীন ভাবে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন গোটা সমাজের দিকে। এক পেশেন্ট পার্টির দোষের সাজা ভোগ করতে বাধ্য করা হলো অগুনতি রোগী, রোগীর পরিবারকে।
কর্মবিরতির প্রথম দিন থেকেই অনেক পেশেন্ট পার্টিকে দেখা গেছে, ধর্মঘটি জুনিয়র ডাক্তারদের সামনে হাতজোড় করে দোষী পেশেন্ট পার্টির হয়ে ক্ষমা চাইতে। কোলে মৃত নবজাতকে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে বাবাকে। তবু বিন্দুমাত্র টলেননি জুনিয়র ডাক্তাররা।
রোগীদের প্রাণের বিনিময়ে, জেহাদি চিকিৎসকদের নিরাপত্তার দাবি আদায়ের তথাকথিত আন্দোলনে স্পষ্ট হয়েছে তাঁদের অমানবিক মুখ। আন্দোলন ইতিমধ্যেই রূপ নিয়েছে জেহাদের। আগামী দিনে কোনও পেশেন্ট পার্টি কি এই চিকিৎসকদের ওপর ভরসা রাখতে পারবেন? রোগী চিকিৎসকের মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করলেন কিন্তু খোদ চিকিৎসকরাই।
সরকার পরিবর্তনশীল। আজ আছে কাল নেই। কিন্তু চিকিৎসক, রোগীর সম্পর্ক বাস্তব এবং চিরকালীন।

জুনিয়র ডাক্তাররা একবার ভেবে দেখেছেন কী, পেশেন্ট পার্টিরাও চিকিৎসকদের মতো দলবাজি করে ময়দানে নেমে পড়লে, পরিণতি কী হবে? ব্যাপারটি নিয়ে মাথাব্যথা থাকা উচিত রাজ্যের সরকারি প্রশাসনেরও।

বাস্তবে আজও মানবিক বোধসম্পন্ন চিকিৎসকরা আছেন। যাঁদের কাছে চিকিৎসা নিছক পেশা না। আছেন সহিষ্ণু পেশেন্ট পার্টিও। চিকিৎসা পরিষেবার ওপর বহু ক্ষোভ রয়েছে দু'পক্ষের। তবু সভ্য সমাজের রীতানীতি মেনে কেউ কোনও গন্ডগোল পাকান না।
কিভাবে?
এঁরাও তো এই বাংলার মানুষ।

সমস্যার মূলে যান।
চিকিৎসকরা আরও মানবিক হোন। পরিষেবার গুণগত মান বাড়ান। গর্জে উঠুন চিকিৎসা পরিষেবার বেহাল পরিকাঠামো নিয়ে। চিকিৎসার নামে মুনাফা লোটার চক্রের কড়া বিরোধিতায় নামুন। বন্ধ করুন সরকারি হাসপাতালের দুর্নীতির দুষ্টচক্রকে।
তাহলেই পেশেন্ট পার্টির ক্রোধ প্রশমিত হবে। নিজেদের স্বার্থেই পেশেন্ট পার্টি চিকিৎসকদের বিপদে তাঁদের পাশে দাঁড়াবেন। পুনরুদ্ধার হবে ডাক্তারবাবুদের হারানো গৌরব।

বাস্তবের মাটিতে পা রেখে একবার ভেবে দেখুন,
পুলিশ দিয়ে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায় কি?


Share To:

THE OFFNEWS

Post A Comment:

0 comments so far,add yours