বিজন কুমার সরকার, সিনিওর জার্নালিস্ট, নয়াদিল্লিঃ
কাট মানি ইস্যু যে বুমেরাং ঘাস শিবিরের কাছে। লোকসভা নির্বাচনের রাজ্যে বিজেপির প্রবল উত্থানকে সামাল দিতে কাট মানি তাসকে সামনে আনতে গেলেন দলের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধায়। আর তা করতে গিয়ে তিনি নিজেই প্রবল পাল্টা অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছেন পুরো দলটাই। নিজের সততা ইমেজকে পুনরুদ্ধার করার প্রয়াস হয়তো করতে গিয়েছিলেন এক দলীয় সভায় গরম গরম বচনে, কিন্তু তার অবনমনের মূল্য চোকাতে হচ্ছে প্রান্তিক জোড়া ঘাসের মানিব্যাক পলিসির এজেন্টদের উষ্ণ উষ্ণ ধোলাইয়ে। এমতাবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষক একাংশের মতে, এই কাট মানি ইস্যুই না শেষ পর্যন্ত তৃণমূলের কাছে ডুবন্ত টাইটানিকের ট্র্যাজিক উপমা হয়ে যায়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আচমকা নিজে সততার নামাবলী পড়ে এই কাট মানি ইস্যু বাতাসে আন্তরিক ভাবে ভাসিয়ে দিয়েছেন এমনটা কিন্তু মোটেও নয়। অনেকেই ভাবতেই পারেন এ যেন অন্ধকার আকাশে এক পূর্ণ পূর্ণিমার চাঁদের মতো এক অপরূপ সততার স্নিগ্ধ বাণী, ‘কাট মানি ফেরত দাও’! মোটেও তা নয়। আসলে এই দুর্নীতির ইস্যুটা খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দফতরেই প্রথম সুনামির মতো আছড়ে পড়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এহেন মন্তব্যের এক বছরের বেশি সময় আগে। আর সেই কাট মানি সুনামির ধাক্কাটা মুখ্যমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী।
নয়াদিল্লির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী ২০১৮ সালের ৭ মার্চ কাট মানি সংক্রান্ত একটি গোপন রিপোর্ট হাতে পান। যে রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রধান টেবিলেও স্থান পেয়েছিল। যাতে ছত্রে ছত্রে উল্লেখ রয়েছে, রাজ্যের গ্রামীন এলাকা জুড়ে কিভাবে কাট মানির লেনদেন হয়েছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা-গ্রামীন স্কিমকে (Pradhan Mantri Awas Yojana - Gramin scheme (PMAY-G) কেন্দ্র করে।
২০১৬-১৭ সাল থেকে রাজ্যে এই প্রকল্পের অধীন নানান জায়গায় পাকা ঘর নির্মাণের প্রকল্প শুরু হয়েছিল এবং ২০১৮-১৯ নাগাদ এই প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার কথা। ৮১,৯৭৫ কোটি টাকার আনুমানিক ব্যয় বরাদ্দ নির্ধারণ করা হয় প্রকল্পে। এই ঘরগুলি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের সহায়তায় সমতল এলাকায় ৬০-৪০ শতাংশ অনুপাতে এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলির জন্য ৯০-১০ শতাংশ অনুপাতে নির্মিত হওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গেও একই বিধিকে সামনে রেখে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামীণ উন্নয়ন বিভাগের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল এলাকায় এবং শহুরে ও মফঃস্বল অঞ্চলে স্থানীয় পৌরসভার মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
আর এখান থেকেই রাজ্যে সুচনা হয় কাট মানির সার্বজনীন উন্মুক্ত কালচার। এই স্কিমের কাঁধে ভর দিয়ে রাতারাতি সংশ্লিষ্ট সিংহভাগ পঞ্চায়েতের প্রধান, পঞ্চায়েত সদস্যরা এবং পুর এলাকার কেষ্টবিচ্ছু থেকে ক্ষমতাসীন দলের নানা গোষ্ঠীর তস্য অলিগলির নানা মাপের নেতারা যেন মুঠোয় নিয়ে ফেলেন কাট মানি সংগ্রহের গোটা এটিএম কাউন্টার। নিজের নিজের এলাকায় তাঁরা অনেকেই হাঁক দিলেন, গৃহ তৈরির মোট মূল্যের পঞ্চাশ শতাংশ কাট মানি অগ্রিম দিতে হবে তাঁদের পকেটে। তবেই মিলবে সরকারী প্রকল্পের নির্মিত ঘর। আর এই পঞ্চাশ শতাংশ হারে কাট মানি বহু দরিদ্র মানুষ তাঁদের নেতাদের হাতে তুলে দিতে পারেননি নিতান্ত আর্থিক অক্ষমতায়। ফলে বহু আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষ সরকারী এই আবাস প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। আর এখান থেকেই রাজ্যে শুরু হয়ে যায় তথা কথিত তৃণমূলের কাট মানি আগ্রাসন নীতি। যা রাজ্যপাল সেই সময়েই সতর্ক করে দেন রাজ্য প্রশাসনের প্রধানকে। সঙ্গে তিনি গোটা অভিযোগটি তদন্ত করে দেখতেও অনুরোধ করেন রাজ্যকে। কিন্তু সামগ্রিক বিষয়টা প্রশাসনের বদান্যতায় হিম ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোন এক অজানা কারণে।
যে দুর্নীতির তদন্ত করে দেখার জন্য রাজ্যপাল অনুরোধ করেছিলেন এক বছরেরও পূর্বে তা প্রকারন্তে লাল ফিতের ফাঁসে আটকে রাখা হয়েছিল কি পরম সযন্তেই। অথচ বিপদে পড়ে নিজের সততার ইমেজ আরও একবার প্রকাশ্যে উষ্কে দিতে মুখ্যমন্ত্রী নজরুল মঞ্চে এমন ভাব দেখালেন যেন সম্প্রতি তিনি এইসব কাট মানির অভিযোগ গুলো পেয়েছেন একেবারে নিজস্ব সুত্রে। কিন্তু হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন রাজনীতিতে কিছুটা হলেও কম ধুরন্ধর তৃণমুল সাংসদ শতাব্দী রায়। এই চলচিত্র অভিনেত্রী ফাঁস করে দিয়েছেন, এই কাট মানির টাকা শুধু সংগ্রাহক দলের নেতা কর্মী পুরোটা পাননি তার সিংহ ভাগ চলে গিয়েছে একেবারে চেন সিস্টেমে তৃণমূল বাগিচার বৃহৎ হস্তিদের টেবিলের তলায়।
আর এই বিশ্বস্ততার শৃংখল নিশ্চয় একদিনে তৈরি হয় না, তা কোলের শিশুও বোঝে। এইখানেই যে দলের প্রান্তিক আঁতুর ঘরে বুমেরাংয়ের গৃহপ্রবেশ।
দীর্ঘদিনের লড়াকু নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায় বিরোধী নেত্রী হিসেবে যতটা পরিণত প্রশাসনিক আঙ্গিকে কিন্তু ততটাই অসফল। অন্তত রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার একাংশ তো তাই বলে থাকেন আবডালে। পঞ্চায়েতের কুশীলবদের সামনে তিনি তাই যখন বলেন কাট মানি ফেরৎ দেবার কথা, ভেবেছিলেন তাঁর মুখ নিঃসৃত বানীতে বঙ্গ সমাজ গদগদ হয়ে তাঁকে অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসিয়ে দেবে। আসলে এই কাট মানির চোরাগোপ্তা ইস্যুতে রাজ্যের গোটা পঞ্চায়েত প্রশাসন অক্টোপাশের মতো জড়িয়ে গিয়েছেন। অনেকেই বলছেন, বিগত বছরের গোড়ায় যদি রাজ্যের অভিভাবকের পরামর্শ শুনে মুখ্যমন্ত্রী এই কাট মানি প্রসঙ্গে উদ্যোগী হতেন তবে আজকের এই অরাজক রাজ্য তৈরি হতো না। সময় নির্বাচনে তিনি ভুল চাল দিয়ে ফেলেছেন। সেদিন কিন্ত প্রশাসনের রাস পুরোটাই ছিল তাঁর মুঠোয়। কিন্তু এই লোকসভা নির্বাচনের জনমত তাঁর সেই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত যে অনেকটাই আলগা করে দিয়েছে। তাই লাগাম ছাড়া হয়ে পড়েছে কাট মানির পালটা বিপ্লব। আসলে সেদিনের গিমিক তৈরি করা বিরোধী নেত্রী এদিন প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে কল্পনাও করতে পারেননি যে কাট মানি ফেরৎ দেওয়ার খাস্তা ভাষণের মুল্য এভাবে চোকাতে চোকাতে হবে সার্বিক দলটাকে। বিরোধীরা ইতিমধ্যেই টিপ্পনী কাটছেন, মানি ব্যাক পলিসির দল হল টিএমসি। প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধায়ের সময়ের কাজ ভাই করে ঠিক তত্ত্বটাকে অবজ্ঞা করায় আজ যে ডুবন্ত নৌকা! আপনি কি তাই বলেন?
Post A Comment:
0 comments so far,add yours